নন্দিনী সামনের দিকে মাথা নুইয়ে তার পেট চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার দেখাদেখি সীমাও কাঁদছে। আমার তখন একটা দিশেহারা অবস্থা। আমি নন্দিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। আমার মুখে সান্ত্বনার কোনো ভাষা না যোগালেও বললাম, নন্দিনী একটু সহ্য করে আরেকটু হাঁটতে হবে। আমরা বোধহয় বর্ডারের খুব কাছেই চলে এসেছি। এখন তো ভেঙে পড়লে চলবে না। আর একটু সাহসের পরিচয় দিতে হবে। যদি কিছু মনে না করো তবে আমার কাঁধে ভর রেখে, আমাকে জড়িয়ে ধরে চলো।
আমার কথায় নন্দিনী হঠাৎ আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল, আমাকে এরা একদম শেষ করে দিয়েছে। রক্ত তো থামছে না। এখন আমি কী করি বলুন না। আমি তো আর দাঁড়াতেই সাহস পাচ্ছি না। আমি কী করে যাব, মাগো।
যদিও নন্দিনীর ভয়াবহ শারীরিক অসুবিধার দিকটা আমার ও সীমার বুঝতে বাকি রইল না তবুও তাকে আমরা উভয়েই পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। সে তার দু বাহু আমাকে ও সীমাকে জড়িয়ে ধরেই হাঁটার চেষ্টা করতে লাগল। আমরা তাকে প্রায় হিঁচড়ে নিয়েই চলা শুরু করলাম।
সকাল বেলার আমেজ কেটে গিয়ে তখন গাছের ওপর ও পাতার ফাঁক দিয়ে পথের পরিচ্ছন্ন সূর্যের আলো এসে পড়ল। রোদের তাপ বাড়ছে। নন্দিনীর পা বেয়ে যে রক্তের ধারা নামছিল তা সম্ভবত এখন একটু থেমেছে। সে তার কাঁধ থেকে আমার ও সীমার হাত সরিয়ে নিতে ইঙ্গিৎ করলে আমরা তাকে ছেড়ে দিলাম। সে হাঁটছে। যদিও খুব ধীরে তাকে পা ফেলতে হচ্ছে তবুও নিজের শক্তিতে হাঁটতে পারছে দেখে আমি মনে মনে একটু স্বস্তি বোধ করলাম। উৎসাহ দেয়ার জন্য একবার বললাম, আগরতলা গিয়েও আমি তোমাকে ফেলে পালাব না। আমি দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তোমার সাথেই থাকব।
নন্দিনী কিছু না বলে মাথা নুইয়ে খুব ধীরে হিসেব করে পা ফেলে সামনের দিকে চলতে লাগল। শুধু একবার ঘাড় ফিরিয়ে আড়চোখে আমাকে দেখল। আমি তার চোখে চোখ রেখে আপনজনের মতো একটু হাসির আভাস ব্যক্ত করতে চাইলাম। নন্দিনী আমার আশ্বাসের ইঙ্গিৎ সম্ভবত খানিকটা বুঝতে পারল। কারণ তার চোখের কোণ মুহূর্তের জন্য ভিজে গিয়ে একটু চিক চিক করে উঠতেই আমি বললাম, এই যুদ্ধে যা কিছু ঘটেছে এবং ঘটবে তার নিরপেক্ষ সাক্ষী হব তুমি আর আমি। আমরা যুদ্ধ চলাকালে কোনো অবস্থাতেই পরস্পরকে ছেড়ে যাব না, তুমি আমাকে কথা দাও।
আমাকে নিয়ে আপনার শুধু ঝামেলাই বাড়বে।
বেশ স্পষ্ট করে কথাগুলো বলল নন্দিনী। সীমা যে আমাদের সাথেই আছে একবারও সেদিকে তাকাল না। আমি বললাম, ঝামেলাটাতো আর আমাদের ইচ্ছেয় তৈরি হয় নি। দৈবই আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে।
নন্দিনী আর কোনো কথা না বলে হাঁটতে লাগল।
০৩. একটু হেঁটে এগিয়ে গেলে
আমরা একটু হেঁটে এগিয়ে গেলেই দেখতে পেলাম আমাদের পায়ে চলার পথটি একটা ঘন জঙ্গলের ভেতরে সরু হয়ে ঢুকেছে। জঙ্গলের ওপাশে সার বাঁধা একটানা ঝিঁঝির ডাক কানে এল। সম্ভবত বেশ কিছুকাল যাবত এপথে মানুষের চলাচল নেই। বুনো সবুজের এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধ এসে নাকে লাগল। নন্দিনী এখানে অরণ্যের একটি আড়াল পেয়ে হঠাৎ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ধপ করে পথের ওপরই বসে পড়ল।
আমি আর চলতে পারছি না।
আমি আর সীমা কোনো কথা না বলে, নন্দিনীর গা ছুঁয়ে তার পাশে বসে পড়লাম। সীমা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, ভগবান আমাদের বাঁচাও।
সীমার কান্নায় নন্দিনীও ফুঁপিয়ে উঠল। আমি দুজনের মুখের দিকে আর তাকাতে না পেরে মাটির দিকে চোখ নামিয়ে চুপ করে থাকলাম। এসময় হঠাৎ বেশ দূরে স্টেনগানের গুলীর আওয়াজ থেমে থেমে বেজে উঠল। আমি মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে ফেললাম টহল বোট থেকেই গুলী বিনিময় হচ্ছে। আমি আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে নন্দিনীকে ঠেলে তুললাম, জোরে হাঁটো। দেরি করলে বিপদ হবে।
নন্দিনী আর সীমা উঠেই প্রাণপণ দৌড়াতে লাগল। আমিও এদের পেছন পেছন দৌড় দিলাম। নন্দিনী ও সীমা হাত ধরাধরি করে দৌড়ে যাচ্ছে। আমি আর একটু এগিয়ে গিয়ে নন্দিনীর বাঁ হাতটা ধরলাম। নন্দিনী আমার স্পর্শ পেয়েই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আমার গলায় দুহাত জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ফেলল, আমাকে বাঁচান। আমাকে এরা মেরে ফেলবে।
আমি তাড়াতাড়ি আমার গলা থেকে তার হাত দুটি সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, নন্দিনী শেষ মুহূর্তে মনে সাহস রাখো। নইলে আমরা সবাই ধরা পড়বো। সবাইকে মরতে হবে।
আমার কথা শেষ হবার আগেই সীমা আর্ত চিৎকার করে উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল। মেশিনগানের শব্দটা খুব দূর থেকে ভেসে আসছে বুঝতে পারলেও আমি নন্দিনীকে এক ধাক্কায় রাস্তার উপর শুইয়ে দিয়ে আর পাশে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। সীমার হাঁটুটা জবাই করা গাভীর মতো নড়তে লাগল। আমি এক পলক তার দেহের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সারা শরীর তাজা রক্তে ভেসে গিয়ে এক ধরনের খিচুনীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। গুলী তার কানের একটু ওপরে লেগে বিরাট গর্তের সৃষ্টি করেছে। আমি মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম সীমার আর আশা নেই। নন্দিনীও একবার মুখ তুলে সীমার অবস্থাটা দেখে চকিতে বোনের দেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আমি আরো কতক্ষণ চুপচাপ রাস্তার ওপর শুয়ে থেকে কর্তব্য স্থির করলাম। এতক্ষণে সীমার প্রাণপন্দনও স্তব্ধ হয়ে এল। এখন তার শরীরের কোনো অংশই কাঁপছে না। সম্ভবত সীমাদি আর বেঁচে নেই। মেশিনগানের গুলীটা যে আকস্মিকভাবে এবং অতিশয় দুর্ভাগ্যক্রমে তার গায়ে লেগেছে এটা বুঝতে পেরে আমি অত্যন্ত মুষড়ে পড়লাম। আর নিজের বেঁচে থাকতে পারাটাকে মনে মনে ধিক্কার দিয়ে রাস্তার ওপর উঠে দাঁড়ালাম। এখন গুলীর শব্দ আর আসছে না। আমি এগিয়ে গিয়ে নন্দিনীকে সীমার দেহের ওপর থেকে সরিয়ে আনার জন্য হাত বাড়ালাম। নন্দিনী দিদিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মূৰ্ছা গেছে। তাকে টেনে তুলতে গিয়ে রক্তে ভেজা সীমার কপালে হাত দিলাম। কপালটা এখনও উষ্ণ। নন্দিনীকে টেনে একপাশে সরিয়ে দিয়ে সীমার মুষ্টিবদ্ধ ডানহাতটি হাতে নিয়েই বুঝলাম সীমাদি মারা গেছেন। আমি আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে নন্দিনীকে রাস্তার পাশে ঝোপের ভেতর টেনে আনলাম। আমার টানাটানিতে নন্দিনী হঠাৎ ভয়ার্ত চোখদুটি মেলে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল। আমি ডাকলাম, নন্দিনী?