আমি বুঝলাম এ মেয়েটির কথাই কাল দিলা বলেছিল। বলেছিল মেয়েটির স্বামী তাকে ফেলে ইণ্ডিয়া চলে গেছে। আমি মেয়েটির দিকে তাকালাম। আনিসের টানা হ্যাঁচড়াতে মেয়েটির পরনের শাড়ি খুলে গেলেও সে প্রাণপণে শাড়ির একটা প্রান্ত হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে। তার চুলের গোছা আনিসের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। আনিসের পাশে তার অন্য চারজন সঙ্গি, এদের মধ্যে বাহাউদ্দিনও আছে, মেয়েটাকে তাদের হাতিয়ার দিয়ে কখনো গুঁতো আবার কখনো নির্মমভাবে বাড়ি মারছে।
আমি সোজাসুজি আনিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, একে ছেড়ে দাও আনিস।
আপনি কী বলছেন? একটা কোলাবরেটরের মেয়েকে ছেড়ে দেব? যার বাপ গত রাতে আপনার সাথের ভদ্র মহিলাদের র্যাপ করেছে?
ঐ কাজের জন্য এই মেয়েটি দায়ী নয়।
তার বাপ দায়ী।
তার বাপ এবং বাপের সঙ্গিরা তাদের কৃতকর্মের সাজা পেয়েছে। যদিও আমার জানা নেই গতরাতে দিলা সীমা ও নন্দিনীর ওপর কোনো জুলুম করেছে কিনা। করুক বা না করুক কোলাবরেটরের যোগ্য শাস্তি তারা পেয়েছে। মৃত্যুর ওপর কোনো সাজা নেই। তোমরা তাদের সকলকেই গুলী করে মেরেছে। এই মেয়েটি এর জন্য দায়ী নয়। একে ছেড়ে দাও।
আমি এগিয়ে গিয়ে আনিস যে হাতে দিলার মেয়েটার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে রেখেছে সে হাতেরই কব্জিটা ধরলাম। আমার ব্যবহারে আনিস মুহূর্তের জন্য একটু বিব্রতবোধ করলেও হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠল, সরে দাঁড়ান কবি সাহেব। আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। আমি আনিসের হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম, তুমি একে নিয়ে কী করতে চাও?
গত রাতে আপনার সঙ্গিনীদের সাথে রাজাকাররা যা করেছে আমরাও এর ওপর এখন তাই করব। ভয় নেই, এর বেশি কিছু করবো না।
বলে আনিস তার সঙ্গিদের দিকে তাকিয়ে একটু ব্যঙ্গের হাসি হাসল। আমি অসহায়ের মতো একবার নন্দিনী ও একবার সীমার দিকে তাকালাম। দেখলাম, তারা কী করবে ভেবে না পেয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভেবেছিলাম সীমা ও নন্দিনী মেয়েটাকে বাঁচাতে এখনি আনিসের ওপর বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু পরিস্থিতি তাদেরও এমন নিরুপায় করে রেখেছে দেখে আমি নিজেই আবার আনিসের হাত চেপে ধরলাম।
আনিস, আমি তোমাদের একাজ করতে দিতে পারি না।
আপনি সরে যান।
আনিস আমার হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলে, আমি আরও শক্ত করে তার কব্জি চেপে ধরতে চেষ্টা করলাম। আনিস আমার ব্যবহারে অত্যন্ত চটে গেল। এবার সে তার হাতের হাতিয়ার দিয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, সরে যা শুয়োরের বাচ্চা। এটা এ্যাকশনের সময়। এখন আমার সামনে যেই দাঁড়াবে তাকেই ব্রাশ মেরে দেব। এটা লড়াইয়ের স্পট। কবিতা-ফবিতার জায়গা নয়।
স্টেনগানের একটা গুঁতো এসে আমার কণ্ঠার হাড়ের ওপর পড়ল। আমি বাহাউদ্দিনের হাতের ধাক্কায় দুহাত পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। আর সাথে সাথেই আনিসের অন্য সঙ্গিরা আমাকে জাপটে ধরে এমন প্যাঁচ কষল যে আমি মুহূর্তের মধ্যে নন্দিনীর পায়ের কাছে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। নন্দিনী ও সীমা এসে আমাকে ধরল। আর এই সুযোগে দিলার মেয়েটাকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে আনিস ও তার সঙ্গিরা ঘরের ভেতরে ঢুকে গিয়ে খিল এঁটে দিল। ভেতর থেকে মেয়েটা আর্ত চিৎকার করে আল্লার সাহায্য চাইতে লাগল, আল্লাগো বাঁচাও। আপনারা আমার ধর্মের ভাই। আমারে ছাইড়া দ্যান।
ঐ সেই ঘর, গত রাতে রাজাকাররা সীমা ও নন্দিনীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছিল আর তারা ভগবানের নাম ধরে ডাকাডাকি করে রেহাই পায় নি।
আমি তাড়াতাড়ি নন্দিনীর কাঁধে ভর রেখে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়েই বললাম, আর এক মুহূর্তও এখানে নয়। চলো বর্ডারের দিকে হাঁটা দিই।
নন্দিনী বলল, চলুন আমরা যেতে পারব। আমাদের আপনি শুধু পথ দেখিয়ে নিয়ে চলুন।
আমরা দ্রুত উঠোন পেরিয়ে বাইরে এসে দেখি, একেবারে গেটের সামনেই দিলার গুলী খাওয়া মৃত দেহটা পড়ে আছে। মৃতের চোখ দুটি একটু অস্বাভাবিকভাবে বিস্ফারিত। আর পথের ওপর বিক্ষিপ্ত ভাবে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে অন্যান্য রাজাকাররা। যে কুত্তাটা গতকাল আমাদের দেখে ঘেউ ঘেউ করে কিছু খাবারের লোভে পিছু নিয়েছিল এখন সে রাস্তায় ছিটকে পড়া জমাটবাধা মানুষের রক্ত মজা করে চাটছে।
অবস্থাটা দেখে সম্ভবত নন্দিনীর গা ঘুলিয়ে উঠল। সে পথের ওপরই বসে পড়ে ওয়াক করে বমি করতে লাগল। আমি ও সীমা তাকে টেনে তুলে রাস্তা ধরে সামনের দিকে ছুটে চলতে লাগলাম।
.
কিছুদূর এগিয়েই পথ সোজা পূর্বদিক বাঁক নিয়েছে। নিবিড় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথটা সরু হয়ে সামনের দিকে গেছে। আমরা এতক্ষণ নন্দিনীকে মাঝখানে রেখে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। অল্পক্ষণ ছুটেই সকলে হাঁপিয়ে গেলাম। নন্দিনী হঠাৎ তার গতি কমিয়ে সাধ্যমতো হেঁটে চলতে লাগল। আমি বুঝলাম সে আর দৌড়ুতে পারছে না। আমি ও সীমা গতি কমিয়ে তার সাথে হেঁটেই চলতে লাগলাম। এর মধ্যে পথের মাঝেই নন্দিনী একটা গাছের গুঁড়িতে তলপেট চেপে ধরে বসে পড়ল। আমি লক্ষ করলাম তার পায়ের পাতায় উরু বেয়ে তাজা রক্তের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে আমার ও সীমার মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হল না। আমরাও তার সাথে গাছের গোড়ায় বসে পড়লাম। আমি বললাম, কোনো ভয় নেই। তার চলতে অসুবিধে হলে এখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা ধীরে সুস্থেই হেঁটে যাবো।