আমার কথার সমর্থনে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটিও সায় দিল, আর একশো গজের মধ্যে বর্ডার। আপনারা একটু হাঁটতে পারলেই পার্বত্য ত্রিপুরায় ঢুকে যাবেন। আমাদের লোকজন আনিস ভাইয়ের সাথে গাঁটা সার্চ করতে গেছে। এখনই ফিরে আসবে। আপনারা মনে একটু সাহস আনুন। আমরা রাতেই অপারেশন বেরিয়েছিলাম। কিন্তু আপনাদের হদিস বের করতে পারি নি। আনিস ভাই পথ চিনে এগিয়ে আসতে না পারায় আপনাদের এই দুর্গতি পোহাতে হল। তবুও ভাগ্য ভালোই বলতে হবে যে আমাদের কেউ প্রাণে মারা পড়ে নি। আপনারা যাওয়ার জন্যে রেডি হোন, আমি দেখছি। আনিস ভাই ও আমাদের এ্যাকশন পার্টির ছেলেরা কোন দিকে গেছে।
আমি ছেলেটাকে হাতের ইঙ্গিতে দাঁড়াতে বলে বারান্দায় উঠে দাঁড়ালাম। যদিও আমার পা দুটি তখনও থর থর করে কাঁপছে। বললাম, দাঁড়াও। তোমার নাম কি?
বাহাউদ্দিন।
ছাত্র?
হ্যাঁ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়তাম।
বাহাউদ্দিন কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমার দিকে মুখ তুলে হাসল।
আমি বাহাউদ্দিনকে বললাম, তোমরা যাই করো একটু তাড়াতাড়ি করো। কাল এই হতভাগা সুবেদারটার মুখে শুনেছি আজ এদিকে পাঞ্জাবিরা টহল বোট নিয়ে আসবে। এরা আসার আগেই আমি যাতে মেয়ে দুজনকে নিয়ে বর্ডার পার হয়ে যেতে পারি তার ব্যবস্থা করা দরকার। তোমাদের হাতে অস্ত্র আছে। তোমরা হয়তো ওদের কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রেখে ধীরে সুস্থে পালাতে পারবে কিন্তু আমাদের একটু আগেই যাওয়া দরকার।
আমার কথা শুনে বাহাউদ্দিন দ্রুত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি এখনই আনিস ভাইকে খবর দিচ্ছি। আপনি আপনার পাশের মহিলার জ্ঞান ফিরিয়ে আনুন।
আমাদের কথাবার্তার চেতন পেয়েই কিনা জানি না সীমা ধড়মড় করে উঠে বসেই বলল, চলুন। আমি হাঁটতে পারব।
জানি না এতক্ষণ সীমা অজ্ঞান অবস্থায়ই ছিল কিনা। কিংবা হয়তো সম্ভ্রম হারানোর লজ্জায় অচেতনের ভান করে পড়ে ছিল। আমি বললাম, দিদি, একটু অপেক্ষা করুন। আনিস আসুক।
আমার কথায় সীমা নন্দিনীর দিকে তাকাল। নন্দিনী আগের মতোই উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আমার ইঙ্গিতে সীমার দিকে ফিরে বলল, শাড়িটা পরে নাও। এখন আর কারো সাহায্যের দরকার হবে না। চলো আমরা নিজেরাই হাঁটা শুরু করি। সামনে যদি বর্ডার হয়ে থাকে তবে আর ভয় কি?
নন্দিনীর কথায় যে শ্লেষ আছে তা যে আমাকেই বিদ্ধ করার জন্যে উচ্চারিত তা আমি বুঝতে পেরে লজ্জায় ও অক্ষমতার গ্লানিতে মাথা নুইয়ে রাখলাম।
নন্দিনী এগিয়ে এসে সীমাকে বারান্দায় সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে গেলে আমিও সাহস করে সীমার ডান কনুই ধরে দাঁড়ালাম। এখন আমার ও নন্দিনীর মুখ একেবারে সামনা সামনি। নন্দিনী আমাকে ধরতে দেখে বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে সীমার পায়ের কাছে চটচটে শুকনো রক্তের দাগে ভরা লুটিয়ে পড়া শাড়িটা তুলে তাকে পরিয়ে দিতে লাগল। শাড়িটা গিট দিয়ে নাভির ওপর বাঁধতে গিয়ে একবার আড়চোখে আমার দিকে চাওয়া মাত্রই আমি কথা বলার সুযোগ পেয়ে বললাম, নন্দিনী আমার অক্ষমতাকে মাফ করে দাও। তুমিই বলো, কালকের পরিস্থিতিতে ওদের হাতে বাধা থেকে বেদম মার খেয়ে অজ্ঞান অবস্থায় আমি কী করতে পারতাম?
নন্দিনী কতক্ষণ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল, আমাকে আর দিদিকে ওরা চিরকালের মতো শেষ করে দিয়েছে হাদী ভাই। এখন আমাদের কী গতি হবে আপনিই বলুন?
আমি জবাবে বললাম, ওরা সুযোগ পেয়ে তোমাদের যে ক্ষতি করেছে, নন্দিনী, তা আমার মা বোনের ওপরই করেছে। এ জন্য কী তোমাদের কোনো সামাজিক জবাবদিহির প্রয়োজন আছে? অত্যাচারিত ও অসহায়ভাবে ধর্ষিতা বাংলাদেশের প্রতিটি নারীই এখন স্বাধীনতার বলি। এখন এ নিয়ে কথা বলে বা অনুযোগ করে কী কোনো লাভ আছে নন্দিনী? যদি তোমাদের হাঁটার শক্তি থাকে তবে চলো আমরা এক্ষুণি বর্ডারের দিকে চলা শুরু করি। আমাকেও এরা বেঁধে রেখে পিটিয়ে সারা রাত অজ্ঞান আর অচল করে দিয়েছে। তবুও আমি মাইল খানেক প্রাণপণ চেষ্টায় হেঁটে যেতে পারব।
নন্দিনী আমার কথায় হঠাৎ যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে সীমার মুখের দিকে তাকিয়ে বল, চল দিদি।
কিন্তু আনিসরা ফিরে এসে আমাদের না পেয়ে আবার খোঁজা শুরু করে বিপদে পড়বে। বরং একটু অপেক্ষা করে এদের সাথেই যাওয়া ভাল।
সীমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরা বাড়ির বাইরে একটা হই চই শুনতে পেলাম। একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের সাথে মানুষের কথাবার্তা শোনা গেল। আনিসের গলাই আমাদের কানে এল, হারামজাদি রাজাকারের মাগী। আজ তোর বারোটা বাজাবো।
বলতে বলতে একটা মেয়েকে প্রায় অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে আনিস বাড়িটার ভেতর এসে ঢুকল। মেয়েটা বাজান গো কে তোমারে এমন কইরা মাইরা ফালাইয়া রাখছে গো–বলে সামনে বিলাপ করছে এবং আনিসের হাত থেকে তার মাথার চুলের গোছা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
আনিস ভেতরে ঢুকেই আমাদের দেখতে পেয়ে বলে উঠল, এই হারামজাদিকে দিলা রাজাকারের বাড়ি থেকে ধরে এনেছি। এদের ভয়েই এই গাঁয়ের সব মানুষ ইণ্ডিয়া পালিয়ে গেছে। দিলা রাজাকার আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হেফজু সুবেদার পাঞ্জাবিদের পথ ঘাট চিনিয়ে দিয়ে বহু পরিবারের সর্বনাশ করেছে।