বারান্দায় উঠলে আর আমাকে এখানে দাঁড়াতে দেওয়া হল না। টেনে হিঁচড়ে একটা কামরায় এনে গরুবাঁধার শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে মেঝেয় ঠেলে শুইয়ে দিল। আমার পিঠের নিচে সিমেন্টের ছোঁয়া লাগামাত্র আমার সারা শরীর ও মাথা হিস্টিরিয়া রোগীর মতো থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। অসম্ভব শীতে আমি কুঁকড়ে যেতে লাগলাম।
.
এ অবস্থায় ঘোরের মধ্যে কতক্ষণ পড়েছিলাম কিছুই আমার মনে নেই। সম্ভবত আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন চেতন পেলাম তখনও শরীরটা স্বাভাবিক বলে মনে হল না। এখনও মাথাটা ঝিম ধরে আছে। একটা পা উরতসহ ঝটকা দিয়ে কেঁপে উঠছে। এই প্রথম আমার মনে হল আমি বোধ হয় দুদিন ধরে কিছু খাই নি। পেট, নাড়িভুড়ি খিদেয় এখন ব্যথা করছে। বাইরে একটানা ঝিঁঝির ডাক শুনে আন্দাজ করলাম এখন গভীর রাত।
রাত? আমি চমকে উঠলাম আর তক্ষুণি মনে পড়ল আমার শারীরিক খিঁচুনির কোনো এক সময় আমি নন্দিনীর আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম। সে ভগবানের দোহাই দিয়ে এদের হাত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল। সীমার ফুঁপিয়ে কান্নার সাথেও যেন আমি কয়েকবার ভগবানের নাম শুনতে পেয়েছিলাম।
এখন সারাটা বাড়ি নিস্তব্ধ হলেও ঝিঁঝির তীক্ষ্ণ সূঁচালো আওয়াজে আমার সচেতনতা ধীরে ধীরে সজাগ হচ্ছিল। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হাতপায়ের অসাড়তা খানিকটা অনুভব করলেও কোমরের বেদনা বোধই টের পাচ্ছি না। হঠাৎ কেন জানি মনে হল, অতীতে আমি কোনো দিশেহারা বিপদে হতভম্ভ হয়েও আমার নিজের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর ভরসা হারায় নি। মুখে প্রকাশ না করলেও আমার বন্ধুরা আমাকে একজন নাস্তিক বলেই জানে বা ধারণা করে এসেছে। আমার সামান্য রচনায় স্বাভাবিক উপমা উত্থাপনে বাস্তবতার বোধ বা কল্পনার দৌরাত্ম্য দৈব নির্ভর ছিল না। এখন হঠাৎ মনে হল আমি এখন যে অবস্থায় আছি এ অবস্থায় একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। আমার এ ভাবনায় আমি অত্যন্ত মুষড়ে পড়লাম এবং ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে, আল্লাহ আল্লাহ শব্দটি ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে লাগল। আমি আবার গত সকাল বেলার ঘোরের মতো অবস্থায় তলিয়ে যেতে লাগলাম।
.
প্রচণ্ড গোলাগুলীর আওয়াজে সকাল বেলা আমার ঘোর আর ঘুম উভয় অবস্থাই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। আমি মেঝের ওপর থেকে দারুণ বিস্ফোরণের শব্দে হকচকিয়ে গেলেও মাথা তুলতে পারছিলাম না। আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে অথচ মাথাটা একটা গোল ভারী পাথরের মতো মেঝেতে লুটানো। বাড়িটার বারান্দায়, প্রাঙ্গণে এবং পাশ্ববর্তী কামরায় মানুষের ছোটাছুটি, কান্না ও গোঙানির শব্দে আমি আরও একবার আপ্রাণ চেষ্টায় মাথাটা উঁচু করা মাত্র দড়াম করে আমার ঘরের দরজাটা খুলে আনিস ঘরের ভিতর লাফিয়ে পড়ল। তার হাতে স্টেনগান বাগানো। তার পিছে পিছে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তড়িৎ চাতুর্যে কামরায় প্রবেশ করে, জয় বাংলা বলে ধ্বনি দিল। আনিস তাদেরকে তাড়াতাড়ি আমার বাঁধন খুলে দিতে বলে দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। নন্দিনীদের কথা জিজ্ঞেস করার আগেই আনিস চলে যাওয়াতে আমি যে মুক্তিযোদ্ধাটি আমার দড়ির বাঁধন দাঁত দিয়ে টেনে খুলে দিচ্ছিল তাকে বললাম, আমার সাথে আরও দুজন মহিলা ছিলেন। পাশের কামরায় এদের ওপর রাতে নির্যাতন হয়েছে। এরা কই?
এদের বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দাঁড়াতে পারছেন না। এরা মারাত্মকভাবে রেপড। একজনের সেন্স এখনও ফেরে নি। চলুন আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে।
দড়িদড়া খুলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাটি আমাকে উঠে বসতে ঘাড়ের নিচে হাত রেখে টান দিল। আমিও আপ্রাণ চেষ্টায় শরীরটা তুলে কোনো মতে বসলাম। পা দুটো ও মাথা অসম্ভব রকম টন টন করে উঠল। আমি ছেলেটাকে আবার তাড়াতাড়ি মেঝেয় শুইয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে কঁকিয়ে উঠলাম, বসতে পারছি না। শুইয়ে দাও।
ছেলেটি তাড়াতাড়ি আমাকে আগের মতো শুইয়ে দিয়ে বুকটা মালিশ করতে লাগল। সে এখন আমার অবস্থা পুরোপুরি আন্দাজ করতে পেরেছে। আমি বললাম, রাজাকাররা কী পালিয়েছে?
সবগুলো খতম। একটাও পালাতে পারে নি।
উৎফুল্ল মুখে বলল মুক্তিযোদ্ধা তরুণটি। বয়স বাইশ তেইশের বেশি হবে না। মুখে একটা দুঃসাহসী প্রাণমাতানো সরল বিজয়ী হাসি।
আমি বললাম, পালের গোদাটা, খাকি জামাপরা গোঁফঅলাটাকে মারতে পেরেছ?
বাইরে এসে দেখুন না, ঘরে সিঁড়ির পাশে গেঁদাফুলের ঝোপের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ওর নাড়িভুড়ি সারা উঠোনটায় ছড়িয়ে গেছে। আর বাকিগুলোর লাশ রাস্তায় পড়ে আছে। পালাতে চেয়েছিল। দুই ব্রাস ফায়ারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ছেলেটা মুখে আবার হাসি ছিটকে ছড়িয়ে গেল। আমি বললাম, আনিস তাহলে দৌড়ে আবার কোথায় গেল?
গাঁটা সার্চ করতে গেছে। লোকজন নেই যদিও। তবুও একবার সার্চ করে যাওয়া ভালো।
ছেলেটার উদ্দীপনা দেখে এবার আমি বুকের ওপর থেকে ওর হাত আস্তে সরিয়ে দিয়ে নিজের চেষ্টায় দাঁতে দাঁত চেপে উঠে বসলাম। সারা শরীরে টনটনে ব্যথা অনুভব করলেও আমি শক্ত হয়ে বসে থাকলাম। ছেলেটা বলল, আরও একটু বসে থাকুন এখুনি উঠবার চেষ্ট করবেন না। আমি তার কথা না শুনে মনের জোরে তার কাঁধের ওপর ভর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। বললাম, আমাকে মেয়েদের কাছে বারান্দায় নিয়ে চলো। ছেলেটি আমার কোমর হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরার জন্যে তার স্টেনগান ডান হাত থেকে বাঁ হাতে বদল করল এবং দ্রুত ডান হাতে আমার কোমরটা পেঁচিয়ে ধরল। আমি তার সাথে হিঁচড়ে এগোতে লাগলাম। আমার শরীরের নিম্নাংশ প্রবল কাঁপুনি ঝটকা দিয়ে উঠলেও আমি হাঁটা না থামিয়ে ছেলেটির সাথে বারান্দার দিকে প্রাণপণে চলতে লাগলাম। ছেলেটা আমাকে টেনে হিঁচড়ে বারান্দায় এনে বসিয়ে দিল। আমি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা সীমার পাশে এসেই বসেছি। নন্দিনী চুপচাপ উদাস দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার পরনে শুধু সায়া। শরীরে ব্লাউজ বা ব্রেসিয়ার কিছু নেই। পিঠ ও বুক নগ্ন এবং পাশবিক অত্যাচারের চিহ্নে ক্ষত বিক্ষত। আমাকে কতক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে দেখেই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল। আমি কোনো মতে টেনে হিঁচড়ে নন্দিনীর কাছে গিয়ে তার হাত ধরতেই সে দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে জোরে বিলাপ করে কেঁদে উঠল। আমার মুখ থেকে কোনো কথা বেরুল না। আমি বারান্দায় পড়ে থাকা রক্তে ভেজা নোংরা শাড়িটাই টেনে এনে তার শরীরের ওপর মেলে দিলাম। আমার এতটুকু সহানুভূতিতেই নন্দিনীর সম্ভ্রমবোধ যেন ফিরে এল। সে বসে থেকেই শাড়িটা পেঁচিয়ে পরে নিল। এ সময় অকস্মাৎ সীমাও পাশ ফিরে আমার দিকে চোখ পড়ায় ফুঁপিয়ে কতক্ষণ কাঁদল। আমি সীমার মাথায় হাত রাখতেই সীমা উঠে বসল। তার পরণেও একটা সায়া ছাড়া আর কিছু নেই। মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটা অবস্থা দেখে ঘরের ভেতর থেকে সীমার পরিত্যক্ত শাড়িটা কুড়িয়ে এনে আমার হাতে দিল। সীমা আমার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে পরতে গিয়ে চীৎকার করে পিছিয়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে পুদিনা ঝোপের দিকে তাকিয়ে রইল। পুদিনা ঝোপে স্টেনগানের ব্রাস ফায়ারে বিদীর্ণ সুবেদারের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সারা উঠোনের ঝোপঝাড় আর লতাগুল্ম রক্তে মাখামাখি। মানুষের পীতাভ হলদে নাড়িভুড়ি লাশটার পাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এক ধরনের দুর্গন্ধে মুহূর্তের মধ্যে আমার বমির উদ্রেক করলেও আমি ঢোক গিলে আমার অস্বস্তি চাপবার চেষ্টা করতে লাগলাম। সীমা ও নন্দিনী উভয়েই এখন বিস্ফারিত চোখে সুবেদারের লাশটা দেখছে। আমি বললাম, আনিসের দল আমাদের বাঁচিয়েছে। রাজাকাররা সবি মারা পড়েছে। এখন আর ভয়ের কিছু নেই।