সুবেদারের কথা শুনে আমার পাহারাদার ছেলেটা এবার পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এল, তালা পাব কই স্যার।
ছেলেটা আমার হাতের শক্ত বাঁধন খুলতে গিয়ে রাইফেলটা ঘরের টিনের বেড়ায় ঠেক দিয়ে রেখে এল।
সুবেদার বলল, তালা যোগাড় করতে হবে। এখন ঘরে ঢুকিয়ে শিকল তুলে দে। পালাবার চেষ্টা করলে অমনি গুলী। কুছ পরোয়া নেই। আগামীকাল ক্যাম্পে চালান। আর এটার সাথে কথা হয়ে গেলে এটাকে রান্না ঘরের বাঁশের সাথে বাঁধবি। কি দড়িদড়াও যোগাড় করতে পারবি না দামড়া কোথাকার?
পারব।
হাসল ছেলেটা। একুশ বাইশ বছর বয়েস হবে। পরনে লুঙ্গি ও কালো গেঞ্জি। দেখতে রেলের কুলির মতো চেহারা। মনে হয় এসব কাজে এখনও তেমন দক্ষ হয়ে ওঠে নি। খাওয়া পরা ও নগদ টাকার লোভেই এদের সাথে জুটেছে। ছেলেটা আমার বাঁধন খুলে দিল। হাতের কবজি ও কনুই হঠাৎ দারুণভাবে ব্যথা করে উঠল। এতক্ষণ রক্ত চলাচল অসার থাকায় কোনো অনুভূতি ছিল না। তবুও আমি বাহুটা ঝাঁকুনি দিতে পারছিলাম না। আস্তে করে শুধু কনুইয়ের নিচের অংশটা নাড়ালাম। ততক্ষণে অন্য দুজন রাইফেলধারী তরুণ ও দিলা সীমা আর নন্দিনীর কোমরের বাঁধন খুলে দুজনের হাতে তাদের শাড়ি তুলে দিল। নন্দিনী সাথে সাথেই শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে আঁচল কাঁধের ওপর রাখল। কিন্তু সীমা শাড়িটা হাতে নিয়ে শূন্যদৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পরল না। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া সিঁথিতে এখনও আবছামতো লালের তোবড়ানো রংটা রয়ে গেছে। হাতে শাদা শাখা দুগাছি মাত্র।
আমি বললাম, দিদি শাড়িটা পরুন।
আমার কথায় সীমা কোমরে আঁচলের প্রান্ত ভাগটা গুঁজল।
সুবেদার হেসে বলল, তুমিও মালোয়ানের বাচ্চা নাকি?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। সীমার শাড়ি পরা হয়ে গেলে দিলা এদের ঠেলতে ঠেলতে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। তার সাথে গেল সীমা ও নন্দিনীর পাহারাদার দুজন। খালি বারান্দায় আমাকে বসতে ইঙ্গিত করে সুবেদার উল্টানো শূন্য মাটির ঠিলার গোল পেটের ওপর বসল। আবার একটি সিগ্রেট ধরিয়ে আমার মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সিগ্রেট খাও?
না।
বড় মাগিটা তোমার বৌ?
না।
এরা তোমার কে?
এ প্রশ্নের জবাব দেবার আগে আমি একটু চিন্তা করে নিলাম। আমি চুপ করে আছি দেখে সুবেদার আবার প্রশ্ন করল, এদের সাথে তোমার কী সম্পর্ক? এদের কোত্থেকে এনে বর্ডার পার করে দিচ্ছিলে? তোমাকে তো দেখে মালোয়ান বলে মনে হচ্ছে না? তুমি মুক্তিবাহিনীর খবর জানো? তোমাকে যা জিজ্ঞেস করি ঠিক ঠিক জবাব দেবে। মিথ্যে বলে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করলে এক্ষুণি তোমাকে মাঠে নিয়ে গিয়ে এই পিস্তলের গুলীতে শেষ করে দিয়ে আসব।
আমি বললাম, নন্দিনী আমার স্ত্রী। আর সীমা তার বড় বোন।
তুমি হিন্দু?
না। আমি মুসলমান।
তোমার বিবি তবে মালোয়ান হয় কি করে! তুমি হিন্দু বিয়ে করেছ?
একটু বিস্ময় মেশানো গলায় সুবেদার জানতে চাইল।
আমিও অসংকোচে মিথ্যে বললাম, হ্যাঁ।
কতদিন বিয়ে হয়েছে?
ছাব্বিশ মার্চ রাতে।
আমার সাথে ফাজলেমি করছ?
ফাজলেমি করব কেন?
আমিও সহজভাবে জবাব দিতে গিয়ে একটু বাড়িয়ে বললাম, ছাব্বিশে মার্চ গোলযোগ বাধার সম্ভাবনা আছে ভেবেই আমরা সন্ধে রাতে বিয়ের আয়োজন করি।
কাজী ডেকে বিয়ে?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
তোমার বৌ কলেমা পড়েছিল?
হ্যাঁ। মুসলমান না হলে কী করে কাজী ডেকে বিয়ে হয়।
আমার কথায় লোকটা কী যেন একটু চিন্তায় পড়ে গেল। শেষে আচমকার মতো আমার নাম জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
সৈয়দ আবদুল হাদি মীর।
ঢাকায় কী করতে?
সরকারি চাকুরি। পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ান।
আমি বেশ দৃঢ়তার সাথেই আমার আত্মপরিচয় দিতে চেষ্টা করলাম। মনে হল আমার অকম্পিত কণ্ঠস্বরে লোকটা রেগে গেল, তুমি সরকারি কর্মচারী হও আর যাই হও তুমি মুক্তিবাহিনীর লোক। আমি তোমাদের তিনজনকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঞ্জাবিদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেব। আগামীকাল সকালে আমাদের টহল বোট আসবে। আজকে রাতটা শুধু তোমার বৌ আর শালীকে নিয়ে একটু মজা করব। পরে তো পাঞ্জাবিরাই এদের শেষ করবে। তার আগে আমরা একটু করলে কী আর ক্ষতি হবে? কী বল!
লোকটা অদ্ভুত ভাবে হাসল।
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, মেয়েদের ইজ্জতের ওপর হামলা হলে, তুমি যেই হও তোমাকে এবং তোমার সমস্ত পরিবার পরিজনকে এর মারাত্মক খেশারত দিতে হবে, এটাও ভেবে দেখো।
আমার কথা শেষ হওয়া মাত্রই হারামজাদা হঠাৎ পায়ের বুট তুলে আমার মুখের ওপর সজোরে লাথি মেরে আমাকে বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিল। রাজাকার ছেলেটাকে চেঁচিয়ে বলল, শুয়োরের বাচ্চাটাকে মাগীগুলোর পাশের কামরায় হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখ। ওর তেজ আমি কমিয়ে দেব।
বারান্দার নিচে পুদিনার ঝোপের ওপর চিৎ হয়ে পড়া আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে সে বলল, আজ রাতেই তোর বৌ আর শালীর ইজ্জত পিছলা করে দেব। ও ঘরে কাট্টা হয়ে শুয়ে শুনতে পাবি কুত্তার বাচ্চা।
রাজাকার ছেলেটা লাফিয়ে নিচে এসে আমাকে উঠে বসতে সাহায্য করল।
সুবেদার তার হোলস্টার থেকে পিস্তল টেনে বের করে আমার মাথার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে উঠে দাঁড়ালাম। আমার কষ বেয়ে থুতনির ওপর রক্তের আঠালো ফোঁটা ঝুলছে। বাম চোখটা ফুলে মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ প্রায়। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মাথা ঘুরছে। এর মধ্যেই ছায়ার মতো দেখলাম দিলা তার সঙ্গী দুজনসহ ঘরের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে আমাকে বারান্দায় টেনে তুলতে গিয়ে বলল, বেকুফ।