আমরা এতক্ষণে মাঠ পার হয়ে গাঁয়ের পায়ে চলা পথ ধরেছি। লাল মাটির পিচ্ছিল পথ। এখানে সেখানে খানাখন্দে পানি জমে আছে। সতর্ক হয়ে না হাঁটলে পা পিছলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। পথের দুপাশে কাটায় ভর্তি কেয়াঝোপ আর আনারস গাছের মেশামেশি জঙ্গল। মাঝে মাঝে বুনোকুল পেকে গাছের ডালসহ রাস্তায় ঝুঁকে পড়েছে। আমরা রাতে এদিকে যে সব বড় গাছের জন্য মাঠ থেকে এলাকাটাকে অন্ধকার অরণ্য। ভেবেছিলাম, এখন দেখছি এগুলো সবি কাঁঠাল গাছ। রাস্তা থেকে আশে পাশে তাকিয়ে গ্রামটিকে একটা মস্ত কাঁঠালবাগান বলে মনে হচ্ছে। একটু এগিয়ে মাটির দেয়াল তোলা দুএকটা ছনের ঘর ও শূন্য উঠোন দেখে বুঝলাম যে পুরো গাঁটাই জনশূন্য মৃত্যুপুরীর মতো পড়ে আছে। একটা বাড়ির ভেতর থেকে হঠাৎ একটা দেশী কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, লাফিয়ে এসে আমাদের সামনে লেজ নেড়ে কুঁই কুঁই শব্দ করে কাঁদতে লাগল। সম্ভবত কুকুরটা ক্ষুধার্ত। গাঁয়ে মানুষজন না থাকায় খাবার খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ এখন কয়েকজন মানুষ দেখে রাস্তায় বেরিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যাকুল। নন্দিনীর সায়ায় ঢাকা হাঁটুর কাছে মুখ তুলে শুঁকতে লাগল। নন্দিনী কুকুরটার কাণ্ড দেখে মুহূর্তমাত্র একটু দাঁড়াতেই দিলা রাইফেলের বাট দিয়ে কুকুরটাকে মারতে গেলে সে লাফিয়ে সরে চিৎকার করে কঁকিয়ে উঠল। নন্দিনীর পিঠে অন্য একটি অস্ত্রধারী তরুণ রাইফেলের নল ঠেকিয়ে, হাঁট মাগী। কুত্তার সাথে আর রঙ্গ করতে হবে না। যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানকার পাগলা কুত্তাটাই তোর রস চেটে খাবে।
ছেলেটার কথায় তার সঙ্গীরা হঠাৎ হেসে উঠল। গ্রুপটার এখনকার নেতা দিলা অবশ্য হাসল না। সে বরং ঘাড় বাঁকা করে ছেলেটার দিকে একবার তাকাল মাত্র। আর এতেই সবার হাসি উবে গেল। কেউ আর টুঁ-শব্দটি করছে না। আমরা বন্দি তিনজন কোনো কথা না বলে হেঁটে চললাম।
রাস্তাটা একটু এগিয়েই বাঁক নিয়েছে ডান দিকে। ডান দিকে ঘুরে আমরা আরও কয়েকটি গৃহস্থ বাড়ির মতো ঘরবাড়ি ও উঠোন দেখতে পেলাম। জায়গাটা আমার ঠিক চেনা বলে মনে না হলেও খুব অপরিচিত এলাকা বলেও মনে হল না। আমি নন্দিনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, আমরা বর্ডার এলাকার কাছেই আছি। মনে হচ্ছে এটা বামুটিয়া বাজারের কাছেরই কোনো গ্রাম।
নন্দিনী বা সীমা কোনো জবাব দিল না। শুধু সীমা একবার শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে হাঁটতে লাগল।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে পৌঁছলে দিলা আমাদের থামতে বলল। আমরা মেহেদীর বেড়া দেওয়া একটা আঙিনার কাঠের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। গেটটা ঠেলে দিলা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এখানে এদের নিয়ে তোরা দাঁড়া আমি ভেতরে গিয়ে দেখে আসি সুবেদার বেটা কি ব্যবস্থা করেছে।
দিলা ভেতরে ঢুকে গেট ঠেলে দেওয়াতে আমি বাড়ির সামনের ঘর বা বারান্দা কিছুই দেখতে না পেয়ে মেহেদীর বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করতে লাগলাম। এটা বোধ হয় এ গাঁয়ের কোনো মান্যলোকের পরিত্যক্ত বাড়ি।
পরিবারটি হয়তো পাকবাহিনীর ভয়ে ভারতে পালিয়েছে কিংবা মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের ভয়ে দেশের ভেতরেরই কোনো আত্মীয়-স্বজনের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। কাঠের গেটের ওপর আঙুল দিয়ে লেখা ‘ওঁ হরি’ এবং সিঁদুরের কয়েকটি রক্তবর্ণ ফোঁটা। নন্দিনীও একবার চোখ তুলে গেটের লেখা ও সিঁদুরের ফোঁটাগুলো দেখে মুখ নামিয়ে নিল।
একটু পরেই দিলা ফিরে এসে আমাদের নিয়ে গেটের ভেতরে ঢোকার ইঙ্গিত করলে আমাদের পিঠে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে এতক্ষণ যে তিনজন দাঁড়িয়েছিল তারা ব্যারেলের গুঁতোয় সামনে এগোবার নির্দেশ দিল। দিলা গেটের কাঠের পাল্লা দুটো মেলে ধরেছে। তার মুখ এখনও গভীর। খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফে বোঝা যায় না লোকটার বয়স কত। আন্দাজ চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। আজ ভোরের আবছা অন্ধকারে এরা যখন আমাদের ঘেরাও করে তখন সুবেদার ছাড়া কারো মুখের দিকেই আমার তাকিয়ে দেখার ফুসরৎ ছিল না। এখন লোকটাকে ভালো করে দেখলাম। মধ্যবয়স্ক গ্রামচাষীর মুখের মতোই সাদামাটা। এ গাঁয়ে লোকটার একটা মেয়েও আছে, সুবেদারের সাথে এর কথা কাটাকাটির সময় তা বুঝেছিলাম। লোকটার মধ্যে সামান্য ব্যক্তিত্বের গন্ধ পেয়েই কিনা জানি না, সীমা ও নন্দিনীর ব্যাপারে মারাত্মক কিছু ভাবতে মন চাইছিল না। তবুও ভয়ে ভয়ে গেট পার হলাম। ভেতরে সযত্নে লাগানো গেন্ধাফুলের ঝুপড়ি মতন গাছে হলুদ ফুল ফুটে আছে। পুদিনা পাতার ঝোপে আঙিনাটা প্রায় ঢাকা। ঘরের বারান্দায় ওঠার সরু পথটা ইট বিছানো। আমরা আঙিনায় প্রবেশ করে দেখলাম একটা বড় ঢেউটিনের চারচালা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। দেড় হাত উঁচু পাকা বারান্দা। বারান্দায় উপুড় করা একটা শূন্য মাটির কলসের ওপর বসে সুবেদার সিগ্রেট টানছে। তার গোঁফের ফাঁকে প্রথম দেখার সেই ক্রুর হাসি। আমাদের উঠোনে প্রবেশ করতে দেখে সে হাতের ইঙ্গিতে ঘরের ভিতরে নিয়ে যেতে বলল। আমরা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠামাত্র সুবেদার উঠে সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তোমার সাথে কথা আছে। তুমি এখানেই দাঁড়াও।
আমি দাঁড়ালাম। আমার পিঠ থেকে রাইফেলের নলটা সরে গেল। নন্দিনী ও সীমা তখনও আমার দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে। পাকানো তাঁতের শাড়ির শক্ত বাঁধনে আমার হাতের শিরাগুলো দড়ির মত ফুলে উঠেছে। যে ছেলেটা আমার পিঠে এতক্ষণ রাইফেল ঠেকিয়ে ঠেলে এখানে নিয়ে এসেছে এখন সে রাইফেলের বাট মাটিতে ঠেকিয়ে আমার সামনে অর্থাৎ সুবেদারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। সুবেদার পেছন দিকে না তাকিয়েই ছেলেটাকে আমার হাতের বাঁধন খুলে দিতে বলল, খুলে শাড়ি দুইটা দুই মাগীকে পরতে দিয়ে পাশের কামরায় তালা বন্ধ করে রাখ।