শিকড়ে টান পড়তেই
(আব্দুল মান্নান সৈয়দকে)
এত রাতে কে যায় ধুলোর রাস্তা? কে যায় বিবর্ণ ঘাস?
কে যায় আগুন? বলো এত রাতে কে যায় পাহারাঅলা?
বলো, বলো, বলো তুমি হে রাত, হে তুমুল দুর্দিন
কাকে তুমি যেতে দাও?
হে ধুলো, বিবর্ণ ঘাস, কাকে রাখো? কাকে ফেলে দাও
উচ্ছিষ্ট ভাতের মতো? কুকুরের মতো?
মড়া পোড়া কাঠের মতোন তুমি হে পাবক কাহাকে পোড়াও?
হে আগুন নিশিথের নিমগ্ন তাপস তুমি ধ্রুবশিখা?
বলো, বলো, আমাকে জানিয়ে দাও, আমি কান পেতে আছি
ত্রিশূলের মতো সোজা টান টান আমার শরীর আমি
আলো করে রেখেছি লোহায়, বলো,
বলো অগ্নি, বলো ধ্রুবশিখা,
আমি সোমরস দেবো, কমণ্ডুলু থেকে আমি ঢেলে দেবো
আলোর প্লাবন;
পৃথিবীর পুরাতন পদ্মটির মতো হবো বিশুদ্ধ বিনয়ী,
বলো, প্রেম, বলো ভালোবাসা,
কাকে তুমি তমসায় তীব্র করো, তুচ্ছ করো, কাকে রাখো, কাকে ফেলে দাও,
উচ্ছিষ্ট ভাতের মতো। কুকুরের মতো।
আমি অন্ধ হৃদয়ের ক্রন্দন জ্বালিয়ে রাখবো অনিষ্কাম,
আমি তোমাকে খাওয়াবো দীর্ণ আমার শরীর থেকে পাপরস
ঘাম, রক্ত, শ্রমের গ্লানির হেতু;
আমি সর্বত্র স্থির থেকে টান মেরে ছিঁড়ে নেবো আমার সকল জ্ঞান,
বলো অগ্নি, বলো হে পাবক, বলো হোমযজ্ঞাগ্নির উষ্ণ জ্যোতি শিখা
মৃত্যু, হিমস্তব্ধতা নগরের এই সব উচ্চাসীন স্কাইস্ক্রেপার
এই জাতিসংঘ, শ্রমিক লীগের নায়কেরা, সভাপতি, সভাসদ
এই সামাজিক জীব,
এই অধিনায়কেরা কী চায়? কেবলি ক্লান্তি! কেবলি কনিষ্ঠ তরবারী?
কেবলি করুণ প্রেম?
কেবলি নারীর নষ্ট শরীরের ঘ্রাণ?
কিন্তু আমি তরবারীর সঠিক স্বভাব আজো বুঝতে পারিনি,
আমি সমাজের সঠিক শব্দার্থ আজো খুঁজে পাইনি কোনো শ্লোকে;
মানবিক ভালোবাসা, নারীর নির্জন হাত কাকে বলে এখনো জানিনা!
আমি সমুদ্রের কাছে গিয়ে পুনর্বার সমাজের কাছে ফিরে এসেছি!
রমণীর কাছে গিয়ে পুনর্বার প্রশ্নাতীত আঁধারের কাছে ফিরে এসেছি তমসা,
আমি আলোর ভিতরে শুধু ধ্বংস, হাড় হৃৎপিণ্ড, রোদনের স্রোত দেখে
এসেছি তোমার কাছে ফিরে ফিরে হে পাবক, অগ্নিশিখা হে তীব্র তামস!
*
অগ্নি দহন বুনো দহন
(রফিক আজাদকে)
বুনো আগুনের ছেঁড়া দহনেই করেছি মাতম শুধু,
পাপের মোড়কে দু’হাত ঢুকিয়ে পাখিদের আর তরু
বীথিদের সাথে চারিয়ে দিয়েছি নৃশংস ডম্বুরু
মাটিতে মর্মে হায়রে এ কোন দহনের হলো শুরু।
নীরব প্রাণের কণার জন্যে কীইবা রাখবো আর,
বোধিমূল থেকে সরে গেছে জল, রক্তের ব্যবহার
খোলেনা এখন প্রভাত কুসুম সম্মেলনের দ্বার
প্রাণসম্মুখে, বোধিমূল হায় পুড়ে হলো ছারখার!
এ কার নিপট হাতের ইশারা? দেবতায়-দ্রাক্ষায়
সমটান দিয়ে আমাকে নিচ্ছে টেনে কালো প্রেক্ষায়।
যার সাথে হাসি, সেই ফের দ্যাখো হাহাকার কান্নায়
বিষাদ জমিয়ে শোণিত শস্যে আগুন ছড়িয়ে যায়!
তাইতো পারি না নেভাতে আগুন চারিদিক থেকে যারা
নেভাতে আসবে, তাদের চোখেও হতাশার খরধারা
ফাঁদ পেতে আছে মাকড়ের মতো জালে বাঁধা পড়ে তারা
পোকার মতোন অসহায় নিয়ে চোখে হতাশার ধারা
অন্তিমে তবে মাতমই মুক্তি? যন্ত্রের বিবসনা
বধূর কাছেই উদোম স্নায়ুকে দিনরাত একটানা
প্রকাশিত কোরে- প্রকাশিত কোরে নীরব প্রাণের কণা
তুলে দেবো তাকে? দিনরাত শুধু দিনরাত একটানা?
বৃথাই তা’হলে প্রাণকে বলেছি পাখি তরুদের সখী,
বাষ্পের মতো নম্র যে সুর বাজায় করুণ পাখি
বাজায় আমার রক্তে শুধুই বাজায় সে ডাকাডাকি
ছেড়া দহনের মাতামে মিলবে? পাখিদের ডাকাডাকি?
*
প্রতিক্ষার শোকগাথা
তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে
আর আমার হাত ঘড়ি
নীল ডায়ালের তারা জ্বলছে মৃদু আমারই কব্জিতে!
টুরিস্টের মতো লাগছে দেখতে আমাকে
সাংবাদিকের মতো ভীষণ উৎসাহী
এ মুহূর্তে সিগ্রেটের ছাই থেকে
শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি কালো এ্যাসট্রেতে!
রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আজ স্বাতী?
তোমার কথার মতো নরম সবুজ
কেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচে
তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ!
তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়
আর একটি অস্থির নীল প্রজাপতি পর্দার বুনট থেকে উড়ে এসে
ঢুকে গেছে আমার মাথায়!
রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসছোনা আজ স্বাতী?
রেস্তোরাঁয় তুমি কি আসবেনা আর স্বাতী?
*
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন
এখানে প্রাসাদ আছে, এখানে নন্দন
চতুর্দিকে খোলা জানলা, হাওয়া আসে হাওয়া
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন
আঙ্গুলে সেলাই করবি আমার আঙ্গুল
বুক থেকে নামবি না পারদ বা পরিতৃপ্ত ঘৃণা
শরীরে ধনুক বেঁধে সুন্দরের ছিলা রাখবি টান
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন
আমাকে শাসাবি খুব, কষ্ট দিবি, ক্লান্তি দিবি, আর
রাত হলে স্বপ্ন দিবি শুতে দিবি বুকের খোঁপায়
শরীরে সেলাই করবি সেই সাপ, সেই আদি পাপ
হাতের পাতায় তোর বেলফুল, বক্ষময় লতা
কথা দিয়েছিলি কেন, বলেছিলি কেন?
*
ফেরার আগে
(গোলাম সাবদার সিদ্দিকীকে)
এ কথা তো ঠিকই
ফেরার সময় হলে যে যার মন্তব্যে ফিরে যাবো।
কিন্তু তার আগে এই অন্ধকার
আলোর ভিতরে আলো
সমাজের ভালো মানুষের সমস্ত জমকালো খেলা
নারীর নিকটে গিয়ে এক আধরাত্রিবেলা
ভালোবাসা, জীবনযাপন!
জনতায় হাত ফেলে উত্তোলন,
যৌবনের কাছে কারো ফেলে আসা আর এক যৌবন,
আকাশের সুবিস্তৃত শূন্যতায় সহিষ্ণু ভুবন যদি পাই
তার আগে ভাইকে যদি ভাই বলে ডাকি