রূপসনাতন
(সিকদার আমিনুল হককে)
এসেছিস তো কী হয়েছে? কিছুই হয়নি, দ্যাখ
ঐতো আচ্ছন্ন ঘাস; ধানী জমি, ঐতো কোমল নৌকো, ধরিত্রী আকাশ!
এসেছিস তো কী হয়েছে? কিছুই হয়নি দ্যাখ,
ঐতো ডাকছে পাখি, জ্বলছে যৌবন, চাঁদ, ঐতো জোনাকী
যাবি তো কাঁদিস কেন? কিছুই কান্নার নেই শোন
শরীরে নকশী কাঁথা, মাটির কলস রইলো ফুলদানি কয়েকটি কলম!
যাবি তো থামিস কেন? কোথাও থামার নেই, আর
ঐতো নৌকো যায়, মাটির কলস যায়, ফুলদানি যায়!
*
অন্তর্গত মানুষ
(মুহম্মদ নূরুল হুদাকে)
আমি যদি বোলতে পারতাম
আমি এর কিছু নই!
এই পাথরের চোখ,
পরচুলা
নকল পোশাক,
এসব আমার নয়
এসব আমার নয়, প্রভু
আমি যদি বোলতে পারতাম!
*
বদলে যাও, কিছুটা বদলাও
(শফিকুর রহমানকে)
কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী
কিছুটা বদলাতে হবে সুর
সাতটি ছিদ্রের সূর্য, সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর
কিছুটা বদলাতে হবে
মাটির কনুই, ভাঁজ
রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে…
বদলে দাও, তুমি বদলাও
নইলে এক্ষুণি
ঢুকে পড়বে পাঁচজন বদমাশ খুনী,
যখোন যেখানে পাবে
মেরে রেখে যাবে,
তোমার সংসার, বাঁশী, আঘাটার নাও।
বদলে যাও, বদলে যাও, কিছুটা বদলাও!
*
একমাত্র কুসংস্কার
একে একে সব গেছে, কিছু নেই, কিচ্ছুটি নেই।
শুধু ওরা আছে থাক,
ভেজা বাড়ি, ঘরদোর, আনাচ, কানাচ, ইঁদুর খসানো মাটি
ওরা আছে, ওরা থাক!
আমার বোনটি যেই বারান্দায় দাঁড় কাক ডাকলেই
বলে ওঠে, ভাই-
গুনে গুনে সাতটি চাল ফেলে দে তো কাকটার মুখে?
চালের গন্ধ পেয়ে দেখিস কাকটি উড়ে যাবে,
আমাদের বিপদ আসবেনা;
আমি সেই অশুভ কাকের মুখে গুনে গুনে
সাতটি চাল ফেলে দেই,
আমি ফের সকল বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করি!
একবার মাকে মাথার উপরে,
হুশ শব্দটিকে দিয়ে টিয়ে ডাক ডাকতে শুনেছি,
মা তুমি আবার সেই টিয়ে ডাক ডাকো দেখি,
আমরা তো ভুলতে ভুলতে সব পাখিদেরও আজ
ডাক নাম ভুলতে বসেছি!
একে একে সব গেছে, কিছু নেই, কিচ্ছুটি নেই,
তবু কিছু কষ্টেসৃষ্টে ধরে আছে এখনো মানুষ!
এখনো পেঁচার ডাকে কেউ কেউ লক্ষ্মীর আগমন টের পায়!
বিড়ালের হাই তোলা হাত দেখে
গৃহিনীরা আজো অনেকেই অতিথির ভাত তুলে রাখে!
কে সেই অতিথি? কে সেই বিড়াল হাত আঁচায়, অন্ধকারে
কে সেই সুন্দর পেঁচা যার ডাকে লক্ষ্মী চলে আসে?
এসব প্রশ্ন থাক, তার চেয়ে এই যেনো হয়?
ছোট বোন বারান্দায় বারবার
কাক ডেকে উঠলেই বলে ওঠে, ভাই,
গুনে গুনে সাতটি চাল ফেলে দে তো কাকটার মুখে!
মা যেনো আবার বলে দেয়
কোনদিকে, কোথায় এখনো আছে
ভালোবাসা, পাখি, প্রেম, অন্ধকার আলো ও মানুষ!
*
বয়ঃসন্ধি
চিকন কঞ্চির মতো ছিপছিপে রোদের ভিতরে আসি
কে আমাকে নুইয়ে দেয় মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!
পানা পুকুরের পাড়ে জলের আয়না আছে, মুখ ধুই
আমি কাকে নুইয়ে দিই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!
নাসারন্ধ্রে নিমের ফুলের ঘ্রাণ, খয়েরী দুপুরে আমি
আলোর আঁধারে কেন ভেসে যাই মা? আমার ভীষণ ভয় লাগে!
আমার সুন্দর হতে ভালোই লাগে না; আমি ভয় পাই!
আমার শরীরে এই অসহবিসহ আলো, বিচ্ছুরণ তেলেসমাতির খেল
আমার শরীরে এই সোনালি ত্বকের ছটা বুক জোড়া উঁচু শিহরণ!
কোথায় লুকাবো মা? ভয় লাগে, আমার ভীষণ ভয় লাগে!
*
মৌলিক পার্থক্য
(নজরুল ইসলাম শাহকে)
আমার একবার খুব ভেদবমি হয়েছিল,
ভেদবমি কাহাকে বলে?
তখোন বয়স নয়, দশ কি এগারো
ভেদবমির কী বুঝতাম!
তখোন পেচ্ছাব খুব সাদা হতো, কান্নায় তেমন কোনো কষ্ট ছিলনা,
বাবার পকেট থেকে অনায়াসে চুরি কোরে খেতাম সন্দেশ!
আমার একবার দুঃখদুঃখ ভাব জেগেছিল,
দুঃখ কাহাকে বলে?
তখোন বয়স তেরো, চৌদ্দ কি পনেরো-
দুঃখের কী কাঁচকলা তখোন বুঝতাম?
তখোন কেবল এক তরুণের বুকে আমি
অত্যন্ত সীমিত সাদা আগুন দেখেছি!
দুঃখ কি অমন কোনো সীমাবদ্ধ সীমিত আগুন?
আমার একবার খুব সৌন্দর্যের বোধ জন্মেছিল,
সৌন্দর্য কাহাকে বলে?
তখোন বয়স খুব বেশি হলে ষোল কি সতেরো;
সৌন্দর্যের তখোন আমি কিইবা বুঝতাম?
তখোন যুবতী দেখলে ক্ষিধে পেতো এইটুকু জানি,
গোলাপ ফুলের চেয়ে মূল্যবান মনে হতো সকালে সিদ্ধ ডিম!
আমার বয়স আজ দীর্ঘ পঁচিশ! প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়,
এখনো অভ্যাসবশে আমার যুবতী দেখলে ক্ষিধে পায়!
এখনো অভ্যাসবশে গোলাপ ফুলের চাইতে
সিদ্ধ ডিমই প্রিয় মনে হয়!
*
সেই সুখ
(সুফিয়া চৌধুরীকে)
সেই সুখ মাছের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ মাংসের ভিতরে ছিল,
রাতের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যেতো ছেলেবেলা
সেই সুখ চাঁদের ভিতরে ছিল,
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল!
নারী কোন রমণীকে বলে?
যার চোখ মুখ স্তন ফুটেছে সেই রমণী কি নারী?
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল,
যখোন আমরা খুব গলাগলি শুয়ে
অনু অপলাদের স্তন শরীর মুখ ঊরু থেকে
অকস্মাৎ ঝিনুকের মতো যোনি,
অর্থাৎ নারীকে আমরা যখোন খুঁজেছি
হরিণের মতো হুররে দাঁত দিয়ে ছিঁড়েছি তাদের নখ, অন্ধকার
সেই সুখ নারীর ভিতরে ছিল।
যখোন আমরা শীতে গলাবন্ধে পশমী চাদর জড়িয়েছি
কিশোরীর কামরাঙা কেড়ে নিয়ে দাঁত বসিয়েছি।
সেই সুখ পশমী চাদরে ছিল, কামরাঙা কিশোরীতে ছিল!
রঙীন বুদ্বুদ মাছ, তাজা মাংস, সুপেয় মশলার ঘ্রাণ
চিংড়ি মাছের ঝোল যখোন খেতাম শীতল পাটিতে বসে
সেই সুখ শীতল পাটিতে ছিল।