একে একে নদীর ধারার মতো তারা বহুদূরে গত!
বদলপ্রয়াসী এই জীবনের জোয়ারে কেবল অন্তঃশীল একটি দ্বীপের মতো
সবার গোচরহীন আছি অজো সুদূর সন্ধানী!
দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতাদুষ্ট শোণিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি,
সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতোন একা একজন লোক,
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি
শতজীবনের শত কুহেলী ও কুয়াশার গান!
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত।
*
চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ
আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে সরকারী লোক, পুলিশ বিভাগে চাকরী কোরেও
পুলিশী মেজাজ কেন ছিলনা ওনার বলুন চলায় ও বলায়?
চেয়ার থেকে ঘরোয়া ধুলো, হারিকেনের চিমনীগুলো মুছে ফেলার মতোন তিনি
আস্তে কেন চাকর বাকর এই আমাদের প্রভু নফর সম্পর্কটা সরিয়ে দিতেন?
থানার যত পেশাধারী, পুলিশ সেপাই অধীনস্থ কনেস্টবল
সবার তিনি একবয়সী এমনভাবে তাস দাবাতেন সারা বিকেল।
মায়ের সঙ্গে ব্যবহারটা ছিল যেমন ব্যর্থ প্রেমিক
কৃপ ভিক্ষা নিতে এসেছে নারীর কাছে!
আসলে আমার বাবা ছিলেন নিম্নমানের মানুষ
নইলে দেশে যখন তাঁর ভাইয়েরা জমিজমার হিশেব কষছে লাভ অলাভের
ব্যক্তিগত স্বার্থ সবার আদায় কোরে নিচ্ছে সবাই
বাবা তখন উপার্জিত সবুজ ছিপের সুতো পেঁচিয়ে মাকে বোলছেন এ্যাই দ্যাখোতো
জলের রং-এর সাথে এবার এই সুতোটা খাপ খাবে না?
কোথায় কাদের ঐতিহাসিক পুকুর বাড়ি, পুরনো সিঁড়ি
অনেক মাইল হেঁটে যেতেন মাছ ধরতে!
আমি যখন মায়ের মুখে লজ্জাব্রীড়া, ঘুমের ক্রীড়া
ইত্যাদিতে মিশেছিলুম, বাবা তখন কাব্যি কোরতে কম করেননি মাকে নিয়ে
শুনেছি শাদা চামেলী নাকি চাপা এনে পরিয়ে দিতেন রাত্রিবেলা মায়ের খোঁপায়!
মা বোলতেন বাবাকে তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?
ঘুস খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,
কত রকম ফন্দি আটছে কত রকম সুখে থাকছে,
তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?
বাবা তখোন হাতের বোনা চাদর গায়ে বেরিয়ে কোথায়
কবি গানের আসরে যেতেন মাঝরাত্তিরে
লোকের ভীড়ে সামান্য লোক, শিশিরগুলি চোখে মাখাতেন!
এখন তিনি পরাজিত, কেউ দ্যাখেনা একলা মানুষ
চিলেকোঠার মতোন তিনি আকাশ দ্যাখেন, বাতাস দ্যাখেন
জীর্ণ ব্যর্থ চিবুক বিষণ্ণ লাল রক্তে ভাবুক রোদন আসে,
হঠাৎ বাবা কিসের ত্রাসে দুচোখ ভাসান তিনিই জানেন!
একটি ছেলে ঘুরে বেড়ায় কবির মতো কুখ্যাত সব পাড়ায় পাড়ায়
আর ছেলেরা সবাই যে যার স্বার্থ নিয়ে সরে দাঁড়ায়
বাবা একলা শিরঃদাঁড়ায় দাঁড়িয়ে থাকেন, কী যে ভাবেন,
প্রায়ই তিনি রাত্রি জাগেন, বসে থাকেন চেয়ার নিয়ে
চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ, নিম্নমানের মানুষ!
*
ঐ লোকটা কে
ফটোগ্রাফের বদৌলতে আজ পুরনো একটি
দৈনিক পত্রিকায় তোমাকে দেখলাম,
বুড়ো সুড়ো গাছের নীচে
বসে বসে ভিটাকোলা খাচ্ছো,
দু’একটি বিদেশী পত্রিকা
পড়ে আছে তোমার টেবিলে
পড়ে আছে সিগ্রেটের বাকস,
একটি নীল বল পয়েন্টের কলম
কিন্তু ঐ লোকটা কে?
বদমাশ নাকের উপর চশমা
হো হো হাসছে,
প্রেমিকের মতো ব্যবহার কোরছে?
ফটোগ্রাফের বদৌলতে
বহুদিন পর তোমাকে দেখলাম এ্যালবামে,
কিন্তু ঐ লোকটা কে?
হো হো হাসছে
বদমাশ নাকের উপর চশমা?
প্রেমিকের মতো ব্যবহার কোরছে
স্টুপিড ঐ লোকটা কে? ঐ লোকটা কে?
*
শিল্পসহবাস
এই কবিতা তোমার মতো সহজ থাকুক সুশিক্ষিতা,
এর গায়ে থাক রাত্রি জাগার একটু না হয় ক্লান্তি হলুদ,
জিভ দিয়ে জিভ ছোঁয়া চুমোর গন্ধ থাকুক এই কবিতায়।
সাদাসিদে যেনো বা কোনো গিন্নি মেয়ে
করম সকম তালবাহানার ধার ধারেনা এই কবিতা!
কেবল ঘরের রঙ্গীন ধূলি মাখায় কালি সারাটি গায়ে
উল্টোপাল্টা শব্দ ও-রং যার কোনোই মানে হয়না,
তবুও তাকে ভালো লাগে, তবুও তাকে মিষ্টি দেখায়!
এই কবিতা তোমার মতো সমালোচকের ভুলশোষকের
শাসনত্ৰাশন ভেঙে ফেলে, মুখের উপর থুথুড়ি দেয়;
ইচ্ছে হলেই শিল্প দেখায় রক্ত মাখায় এই কবিতা!
*
সবিতাব্রত
হৃদয় একটাই, কিন্তু সবদিকে ওর গতায়াত,
বড় গতিপ্রিয় হয় এই বস্তু, বড় স্পর্শকাতর!
ওকে আর আগুনে নিওনা, জ্বলে যাবে, দুঃসময় দেখিওনা
ভিক্ষুকের মতো দ্বারে ভিখ মেগে খাবে।
ও বড় পক্ষপাতী, জীবনের দিকে ওর পক্ষপাত চিরদিন
মানুষের মনীষার, মঞ্জুষার, মুগ্ধতার মহিমার
মৌনতাবাহক, ওতো সকলেরই সহ অবস্থান দিতে
সমূহ ইচ্ছুক, ওতে চায় শান্তি শুধু শান্তি, শান্তি।
সমাজের শিরা উপশিরাময় ওতো ঘুরে ঘুরে খুঁজেছে তোমাকে!
ওকে আর আগুনে নিওনা জ্বলে যাবে, দুঃসময় দেখিওনা
দেখাও মানুষ, ওকে নিয়ে যাও মানুষের কাছে
ওকে নিয়ে যাও সুসময়ে সবিতাকে আলোয় ফেরাও!
*
প্রতিনির্জনের আলাপ
সূর্যাস্তের মতো যেদিকে থেকে এসে আমি ডুবছি তুমি সেদিকে কখনো এসোনা
রয়েছে ভয় আগেই ডুববার;
পথের চিহ্নরা সামনে এসে ডাকেনা কখনো তাই তুমি পথের কালোয় ঘেসোনা
থাকেনা কেউ কুশল শুধাবার!
অনেক হাত থাকে যারা অন্ধকার থেকেই পরম আলো কুড়ায়, আলোও কেমন
যায় মিশে বুকের পাশে সহজে,
আবার কারো বা হাতের ভাঁজে অন্ধকার ছিন্ন পাখার মতো বাজে ঠিক যেমন
স্রোতের তোড়ে জলে ফেনা গরজে!
তুমি অই আলোয় ভরা হাতের খেয়ার মতো হলে হও পরম ঊষার অভিসার
ভরাও শূন্যঘাট নৌকায়;
না হলে না হয় সে নিষ্প্রদীপ দুঃখের কালোয় হয়ে একা নক্ষত্রের পরিবার
ভাসাও তরী আঁধার সন্ধ্যায়!
জলের নিগূঢ় গান বাতাসে ভাসছে ভাবি কাছেই কোথাও এখনই এক হরিণী
দেখছে মুখ সারঙ্গের ভীড়ে
ও পবিত্র জলের অনুরোধে আমাকে যদি পারো হে অবলীলা হে শুভ হরিণী