কিছুদিনের মধ্যেই শতদ্রুর সহপাঠীরা জানতে পারল শতদ্রুর পরিবর্তন হয়েছে। সে নিয়মিত খেলার মাঠে আসে না, কারুর কাছে এ্যাডভেঞ্চারের বই ধার চায় না, এমন কী ‘হাফ-হলি-ডে’তে ‘ম্যাটিনি শো’-এ সিনেমায় পৰ্যন্ত যায় না। একজন ছেলে, শতদ্রু দল ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে, তলে তলে খোঁজ নিয়ে জানলে শতদ্রু কী এক ‘কিশোর-বাহিনী’ গ’ড়ে তুলেছে। তারা প্ৰথমে খুব একচোট হাসল, তারপর শতদ্রুকে পেয়েই অনবরত খ্যাপাতে শুরু করল। কিন্তু শতদ্রু আজকাল গ্ৰাহ করে না, সে চুপি চুপি তার কাজ করে যেতে লাগল। বাস্তবিক, আজকাল তার মন থেকে এ্যাডভেঞ্চারের, ক্লাবের আর সিনেমার নেশা মুছে গেছে। সে আজকাল বড় হবার স্বপ্ন দেখছে। তা ছাড়া সবচেয়ে গোপন কথা, সে একজন কমু্যনিস্টের সঙ্গে মিশে অনেক কিছুই জানতে পারছে।
কয়েকদিনের মধ্যেই সে একটা কিশোর-বাহিনীর ভলান্টিয়ার দল গ’ড়ে, বাড়ির সতর্ক দৃষ্টিকে ফাকি দিয়ে কাজ করতে লাগল। প্ৰতি মুহুর্তে ধরা পড়ার আশঙ্কা তাকে নিরস্ত করতে পারল না, বরং সে গোপনে কাজ করতে করতে অনুভব করল, সে-ও তো একজন দেশকমী। শতদ্রু ভবিষ্যৎ নেতা হবার স্বপ্নে রাঙিয়ে উঠল আর সে খুঁজতে লাগল। কঠিন কাজ, আরো কঠিন কাজ, তার যোগ্যতা সম্বন্ধে সে নিঃসন্দেহ। সে আজকাল আর আগের কালের ‘শতু’ নয়, সে এখন ‘কমরেড শতদ্রু রায়’। রুশ-কিশোরদের আত্মত্যাগ আর বীরত্ব শতদ্রুকে অস্থির ক’রে তোলে; সে মুখে কিছু বলে না বটে। কিন্তু মনে মনে পাগলের মতো খুঁজতে লাগল একটা কঠিন কাজ, একটা আত্মত্যাগের সুবর্ণ সুযোগ। অবশেষে সে আত্মত্যাগ করল, কিন্তু ফল হল মারাত্মক।
শতদ্রুর কাছ থেকে খবর পেয়ে ভলান্টিয়াররা শতদ্রুদের বাড়িতে উপস্থিত হল। শতদ্রুর বাবা অফিস যাবার আগে খবরের কাগজে শেয়ার মার্কেটের খবর দেখছিলেন, একপাল ছেলেকে ঢুকতে দেখে তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
—আমরা ‘কিশোর-বাহিনী’র ভলান্টিয়ার। আপনার ছেলের মুখে শুনলাম আপনি নাকি ষাট মণ চাল বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন, সেগুলো বস্তির জন্য দিতে হবে। আমরা অবিশ্যি আধা দরে আপনার চাল বিক্রি করে ষাট মণের দাম দিয়ে দেব। আর তাতে রাজী না হলে আমরা পুলিশের সাহায্য নিতে ভ হব না।
-আমার ছেলে, এ খবর দিয়েছে, না?
-আজ্ঞে, হ্যাঁ।
-আচ্ছা, নিয়ে যাও।
ছেলেরা হৈ হৈ করতে করতে চাল বের করে আনল। তারা লক্ষ্য করল না, শতদ্রুর বাবার কী জ্বলন্ত চোখ। শতদ্রুর বাবা সেদিন অফিস না গিয়ে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
সেইদিন দুপুরে একটা আর্ত-চিৎকার ভেসে এল বস্তির লোকদের কানে। তারা বুঝল না কিসের আর্তনাদ। বুঝতে পারলে হয়তো সমবেদনায় ব্যথিত হত, কিন্তু তারা সদ্য পাওয়া চাল নিয়েই ব্যস্ত রইল। বহুক্ষণ ধরে অমানুষিক অত্যাচারের পর, শতদ্রুকে তার পড়ার ঘরে তালা বন্ধ করে রাখা হল। কিন্তু শতদ্রু এতে এতটুকু দুঃখিত নয়, এতটুকু অনুশোচনা জাগল না তার মনে। সে ভাবল : এতো তুচ্ছ, এতো সামান্য নিপীড়ন, রুশিয়ার বীরদের অথবা কায়ুর কমরেডদের তুলনায় তার আত্মত্যাগ এমন কিছু নয়। তবু একটা কিছু করার আনন্দে সে শিউরে উঠল, আর এই কান্নায় তার মন পবিত্ৰ শুচিস্নিগ্ধ হল। জানাল দিয়ে সে চেয়ে দেখল যে-বাড়িতে আজ দুদিন উনুনে আগুন পড়েনি সেখান থেকে উঠছে ধোঁয়া; বহুদিন পরে শিবু স্কুল থেকে ফিরছে, আর কণ্ট্রোলের দোকানের লাইনে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত শৃঙ্খলা। কোথাও চাল না-পাওয়ার খবর নেই। সকলের মুখেই হাসি-যেন শতদ্রুর প্রতি অকৃপণ আশীৰ্বাদ। একটু পরে কান্নার বদলে শতদ্রুর কণ্ঠে গুনগুন করে উঠল ‘কিশোর-বাহিনী’র গান।
[‘দরদী কিশোর’ গল্পটি সাপ্তাহিক জনযুদ্ধ পত্রিকায় কিশোর বিভাগে ২৮শে এপ্রিল ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়।]
গল্প : দুর্বোধ্য
সহর ছাড়িয়ে যে-রাস্তাটা রেল-স্টেশনের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার উপরে একটা তেঁতুল গাছের তলায় লোকটিকে প্ৰতিদিন একভাবে দেখা যায়- যেমন দেখা যেতে পাঁচ বছর আগেও। কোনো বিপর্যয়ই লোকটিকে স্থানচ্যুত করতে পারে নি— যতদূর জানা যায়। এই স্থাণু বৃদ্ধ লোকটি অন্ধ, ভিক্ষাবৃত্তি তার একমাত্র জীবিকা। তার সামনে মেলা থাকে একটা কাপড়, যে কাপড়ে কিছু না কিছু মিলতই এতকাল- যদিও এখন কিছু মেলে না। লোকটি অন্ধ, সুতরাং যে তাকে এই জায়গাটা বেছে দিয়েছিল তার কৃতিত্ব প্ৰশংসনীয়, যেহেতু এখানে জন-সমাগম হয় খুব বেশী এবং তা রেল-স্টেশনের জন্যেই। সমস্ত দিনরাত এখানে লোক-চলাচলের বিরাম নেই, আর বিরাম নেই লোকের কথা বলার। এই কথা বলা যেন জনস্রোতের বিপুল কল্লোলধ্বনি, আর সেই ধ্বনি এসে আছড়ে পড়ে অন্ধের কানের পর্দায়। লোকটি উন্মুখ হয়ে থাকে-কিছু মিলুক আর নাই মিলুক, এই কথাশোনাই তার লাভ। নিস্তব্ধতা তার কাছে ক্ষুধার চেয়েও যন্ত্রণাময়।
লোকটি সারাদিন চুপ করে বসে থাকে মূৰ্তিমান ধৈর্যের মতো। চিৎকার করে না, অনুযোগ করে না, উৎপীড়িত করে না কাউকে। প্ৰথম প্ৰথম, সেই বহুদিন আগে, লোকে তার নীরবতায় মুগ্ধ হয়ে অনেক কিছু দিত। সন্ধ্যাবেলায় অর্থাৎ যখন তার কাছে সূর্যের তাপ আর লোকজনের কথাবার্তার অস্তিত্ব থাকত না, তখন সে বিপুল কৌতূহল আর আবেগের সঙ্গে কাপড় হাতড়ে অনুভব করত চাল, পয়সা, তরকারী…। তৃপ্তিতে তার অন্ধ দু’চোখ অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে উঠত। তারপরে সেই অন্ধকারেই একটা নরম হাত এসে তার শীর্ণ হাতটাকে চেপে ধারত- যে-হাত আনতো অনেক আশ্বাস আর অনেক রোমাঞ্চ। বৃদ্ধ তার উপার্জন গুছিয়ে নিয়ে সেই নরম হাতে আত্মসমৰ্পণ করে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। তারপর ভোর হবার আগেই সেই হাতেই ভর করে গাছের তলায় এসে বসত। এমনি করে কেটেছে পাঁচ বছর।