জয় আর একবার বাংলার দিকে ভাল ক’রে তাকায়, ঠিক যেন কলকাতার মরো মরো ভিখারীর মতো চেহারা হয়েছে। হঠাৎ পায়ের দিকে তাকিয়েই সে চীৎকার ক’রে ওঠে : এ কী?
দেখে পা দিয়ে অনর্গল রক্ত পড়ছে।
–তোমার এ অবস্থা কে করলে?
হঠাৎ বাংলার ক্লান্ত চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল, বললে :-জাপান।…খিদের হাত থেকে যদিও বা বাঁচতুম, কিন্তু এর হাত থেকে বোধহয় বাঁচতে পারব না…
জয় বুক ফুলিয়ে বলে : আমরা, ছোটরা থাকতে তোমার ভয় কী?
‘–পারবে? পারবে আমাকে বাঁচাতে?’ বাংলা দুর্বল হাতে জয়কে কোলে তুলে নিল।
বাংলার কোলে উঠে জয় আবেগে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
–তুমি কিছু ভেব না। বড়রা কিছু না করে তো আমরা আছি।
বাংলা বলে : তুমি যদি আমাকে বাচাতে চাও, তা হলে তোমায় সাহায্য করবে, তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে, তোমার মজুর কিষাণ ভাইরা। তারা আমায় তোমার মতোই বাঁচাতে চায়, তোমার মতোই ভালবাসে। আমার কিষাণ ছেলেরা আমার মুখে দুটি অন্ন দেবার জন্যে দিনরাত কী পরিশ্রমই না করছে; আর মজুর ছেলেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে আমার কাপড় যোগাবার জন্যে।
জয় বলে : আর আমরা? তোমার ছোট্ট দুষ্টু ছেলেরা?
বাংলা হাসল, ‘তোমরাও পাড়ায় পাড়ায় তোমাদের ছোট্ট হাত দিয়ে আমায় খাওয়াবার চেষ্টা করছ।’
জয় আনন্দে বাংলার বুকে মুখ লুকোয়। হঠাৎ আকাশ-কাঁপা ভীষণ আওয়াজ শোনা গেল। বাংলার কণ্ঠস্বরে কেমন যেন ভয় ফুটে উঠল।
‘–ঐ, ঐ তারা আসছে…সাবধান! শক্রকে ক্ষমা ক’রো না-তা হলে আমি বাঁচব না।’ জয় তার ছোট্ট দু’হাত দিয়ে বাংলাকে জড়িয়ে ধরল। কী যেন বলতে গেল সে, হঠাৎ শুনতে পেল তার দিদি তিস্তা তাকে ডাকছে :
–ওরে জয়, ওঠ, ওঠ, চারটে বেজে গেছে। তোর কিশোরবাহিনীর বন্ধুরা, তোর জন্যে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
জয় চোখ মেলে দেখে ‘বাংলার কিশোর আন্দোলন’ বইটা তখনো সে শক্তি ক’রে ধরে আছে।
[কিশোরের স্বপ্ন’ গল্পটি জনযুদ্ধের কিশোর বিভাগে ৬ই অক্টোবর ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। জনযুদ্ধের প্রকাশিত গল্প দুটি শ্রীসুধী প্রধানের সহায়তায় সংগৃহীত।]
গল্প : ক্ষুধা
দুপুরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল; আর ভঙ্গ হল কালো মিত্তিরের বহু সাধনালব্ধ ঘুম। বাইরে মোক্ষদা মাসির ক্ষুরধার কণ্ঠস্বর এক মুহুর্তে সমস্ত বস্তিকে উচ্চকিত করে তুলল, কাউকে করল বিরক্ত আর কাউকে করল। উৎকৰ্ণ; তবু সবাই বুঝল একটা কিছু ঘটেছে। মাসির গর্জন শুনে নীলু ঘোষের পাঁচ বছরের ছেলে তিনু কান্না জুড়ে দিল, আর তার মা যশোদা তাকে চুপ করাবার জন্যে ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠল এবং সন্তৰ্পণে কান পেতে রইল মাসির স্বর-সন্ধানের প্রতি। সকলের মধ্যেই একাগ্র হয়ে রইল আগ্রহ ও উত্তেজনা, কিন্তু কেউ ব্যস্ত নয়। কোনো প্ৰশ্নই কেউ করল না। করতে হয়ও না। কারণ সবাই জানে মাসি একাই একশো— এবং এই একশো জনের প্রচারবিভাগ আজ পর্যন্ত কারো প্রশ্নের প্রত্যাশা বা অপেক্ষা করে নি। মাসি এক নিঃশ্বাসে এক ঘটি জল নিঃশেষ ক’রে শুরু করল :
—ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মারো কণ্টোরালির মুখে। মরণ হয় না রে তোদের? পয়সা দিয়ে চাল নেব, অত কথা শুনতে হবে কেন শুনি? আমরা কি তোদের খাস।তালুকের পেরাজা? আগুন লেগে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে চালের গুদোম রে। দু’মুঠো চালের জন্যে আমার মানসম্ভোম সব গেল গো! আবার টিকিট ক’রেছেন, টিকিট; বলি ও টিকিটের কী দাম আছে শুনি?-লক্ষ্মী পিসিকে সম্মুখবর্তী দেখে মাসির স্বর সপ্তমে উঠল। :-ও টিকিটে কিছু হবে না গো, কিছু হবে না। সোমাত্ত বয়েস, সুন্দর মুখ না হলে কি চাল পাবার যে আছে? আমি হেন মানুষ ভোর থেকে বসে আছি টিকিট আঁকড়ে তিন প’র বেলা পৰ্যন্ত, আর আমাকে চাল না দিয়ে চাল দিলে কিনা ও বাড়ির মায়া সুন্দরীকে। কেন? তোর সাথে কি মায়ার পিরীত চলছে নাকি? (তারপর একটা অশ্লীল মন্তব্য)।…
বিনয় এতক্ষণ মাসির বাক্যঝড়কে একরকম উপেক্ষা করেই লিখে চলছিল, কিন্তু মায়ার নাম এবং সেই সঙ্গে ওর। প্ৰতি একটা ইত্যর উক্তি শুনে তার কলম তার অজ্ঞাতসারেই শ্লথ এবং মন্থর হয়ে এল। সে একটু আশ্চর্য হল। সে-আশ্চৰ্যবোধ মাসির চাল না পাওয়ার জন্যে নয়; বরং এতে সবচেয়ে আশ্চৰ্য না হওয়ারই কথা, কারণ এ একটা দৈনন্দিন ঘটনা। কিন্তু সে আশ্চৰ্য হল এই ভেবে যে, মায়া কিনা শেষ পর্যন্ত চাল আনতে গেছল।
বিনয় হয়তো ভাবতে পারল চাল না পাওয়া একটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, কিন্তু মাসির কাছে এ একেবারে নতুন ও অপ্ৰত্যাশিত; কারণ এতদিন পর্যন্ত সে নির্বিবাদে ও নিরঙ্কুশ ভাবে চাল পেয়ে এসেছে এবং আজই তার প্রথম ব্যতিক্রম বলেই সে এতটা মৰ্মাহত। অন্যান্য দিন যারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে মাসির কাছে দুঃখ জানিয়েছে, মুখে তাদের কাছে সমবেদন জ্ঞাপন করলেও মনে মনে মাসি এদের অকৃতকাৰ্যতায় হোসেছে; কিন্তু আজ মাসি ব্যর্থতার দুঃখ অনুভব করলেও যারা তারই মতো ব্যর্থ হয়েছে তাদের প্রতি তার সহানুভূতি দূরে থাক উপরন্তু রাগ দেখা দিল। তাই লক্ষ্মী পিসির উদ্দেশ্যে সে বলল :
-তুই চাল পেলি না কেন রে পোড়ারমুখী?
লক্ষ্মী পিসি মাসির চেয়ে বয়সে ছোট এবং তার প্রতাপে জড়োসড়োও বটে, তাই সে জবাব দিল : কী করব, বল?
মাসি দাঁত খিঁচিয়ে উঠল এবং তারপর কণ্ট্রোলের শাপান্ত এবং বাপান্ত করতে করতে দুপুরটা নষ্ট করতে উদ্যত দেখে বিনয় ঘরে তালা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। বিনয় এ. আর. পি. সুতরাং সকলের অবজ্ঞেয় এবং গভৰ্ণমেণ্টের পোষ্য জীব বলে উপহাসিত। প্ৰধানত সেই কারণে, আর তা ছাড়া বিনয়ের রহস্যজনক চলাফেরায় সকলে বিনয়কে এড়িয়ে চলে এবং বিনয় সকলকে এড়িয়ে যায়। কাজেই বিনয়কে বেরোতে দেখে সমবেত নারীমণ্ডলী অর্থাৎ মোক্ষদা, লক্ষ্মী, যশোদা, আশার মা, পুট, রেণু, হারু ঘোষ এবং ননী দত্তের স্ত্রী প্ৰভৃতি চঞ্চল হয়ে ঘোমটা টেনে স’রে গেল। তারপর আবার যথারীতি ক্ষুধিত, বঞ্চিত এবং উৎপীড়িত নারীদের সভা চলতে লাগল।