কবিতা : সুচিকিৎসা
বদ্যিনাথের সর্দি হল কলকাতাতে গিয়ে,
আচ্ছা ক’রে জোলাপ নিল নস্যি নাকে দিয়ে।
ডাক্তার এসে, বল্ল কেশে, “বড়ই কঠিন ব্যামো,
এ সব কি সুচিকিৎসা ? —আরে আরে রামঃ।
আমার হাতে পড়লে পড়ে ‘এক্সরে’ করে দেখি,
রোগটা কেমন, কঠিন কিনা–আসল কিংবা মেকি।
থার্মোমিটার মুখে রেখে সাবধানেতে থাকুক,
আইস–ব্যাগটা মাথায় দিয়ে একটা দিন তো রাখুক।
‘ইনজেক্শন’ নিতে হবে ‘অক্সিজেন’টা পরে
তারপরেতে দেখব এ রোগ থাকে কেমন ক’রে।”
পল্লীগ্রামের বদ্যিনাথ অবাক হল ভারী,
সর্দি হলেই এমনতর? ধন্য ডাক্তারী!!
‘ভবিষ্যতে’ ও ‘সুচিকিৎসা’ — এই ছড়াদুটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’, ‘শারদীয়া বসুমতী’, ১৩৫৪-থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এগুলি ১৯৪০-এর আগের লেখা বলে অনুমিত।
কবিতা : সুহৃদবরেষু
কাব্যকে জানিতে হয়, দৃষ্টিদোষে নতুবা পতিত
শব্দের ঝঙ্কার শুধু যাহা ক্ষীণ জ্ঞানের অতীত।
রাতকানা দেখে শুধু দিবসের আলোক প্রকাশ,
তার কাছে অর্থহীন রাত্রিকার গভীর আকাশ।
মানুষ কাব্যের স্রষ্টা, কাব্য কবি করে না সৃজন,
কাব্যের নতুন জন্ম, যেই পথ যখনই বিজন।
প্রগতির কথা শুনে হাসি মোর করুণ পর্যায়
নেমে এল (স্বেচ্ছাচার বুঝি বা গর্জায়)।
যখন নতুন ধারা এনে দেয় দুরন্ত প্লাবন
স্বেচ্ছাচার মনে করে নেমে আসে তখনি শ্রাবণ;
কাব্যের প্রগতি–রথ? (কারে কহে বুঝিতে অক্ষম,
অশ্বগুলি ইচ্ছামত চরে খায়, খুঁজিতে মোক্ষম!)
সুজীর্ণ প্রগতি–রথ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উইয়ের জ্বালায়
সারথি–বাহন ফেলি ইতস্তত বিপথে পালায়।
নতুন রথের পথে মৃতপ্রায় প্রবীণ ঘোটক,
মাথা নেড়ে বুঝে, ইহা অ–রাজযোটক॥
এই কবিতাটি অরুণাচলকে সুকান্ত পত্রাকারে লিখেছিলেন। রচনার তারিখ ১৩ই কার্তিক ১৩৪৮।
গল্প : কিশোরের স্বপ্ন
রবিবার দুপুরে রিলিফ কিচেনের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে জয়দ্রথ বাড়ি ফিরে ‘বাংলার কিশোর আন্দোলন’ বইটা হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল, পড়তে পড়তে ক্রমশ বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে এল, আর সে ঘুমের সমুদ্রে ড়ুবে গেল।
চারিদিকে বিপুল-ভীষণ অন্ধকার। সে-অন্ধকারে তার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, কিন্তু তা বেশীক্ষণ নয়, একটু পরেই জ্বলে উঠল। সহস্ৰ সহস্ৰ শিখায় এক বিরাট চিতা; আর শোনা গেল লক্ষ লক্ষ কণ্ঠের আর্তনাদ-ভয়ে জয়দ্রথের হাত পা হিম হয়ে যাবার উপক্রম হতেই সে পিছনের দিকে প্ৰাণপণে ছুটতে লাগল-অসহ্যু সে আর্তনাদ; আর সেই চিতার আগুনে তার নিজের হাত পা-ও আর একটু হলে ঝলসে যাচ্ছিল।
আবার অন্ধকার। চারিদিকে মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সেই অন্ধকারে কে যেন তার পিঠে একটি শীর্ণ, শীতল হাত রাখল। জয়দ্রথ চমকে উঠল : ‘কে?’
তার সামনে দাঁড়িয়ে সারা দেহ শতচ্ছিন্ন কালো কাপড়ে ঢাকা একটি মেয়ে-মূর্তি। মেয়েটি একটু কেঁপে উঠল, তারপর ক্ষীণ, কাতর স্বরে গোঙাতে গোঙাতে বলল : আমাকে চিনতে পারছ না? তা পারবে কেন, আমার কি আর সেদিন আছে? তুমি আমার ছেলে হয়েও তাই আমার অবস্থা বুঝতে পারছ না…দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললে; আমি তোমার দেশ!…
বিস্ময়ে জয় আর একটু হলে মূৰ্ছা যেত : ‘তুমি?’
–হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না? ম্লান হাসে বাংলা দেশ।
–তোমার এ অবস্থা কেন?
জয়ের দরদ মাখান কথায় ড়ুকরে কেঁদে উঠল বাংলা।
–খেতে পাই না বাবা, খেতে পাই না…
–কেন, সরকার কি তোমায় কিছু খেতে দেয় না?
বাংলার এত দুঃখেও হাসি পেল : কোন দিন সে দিয়েছে খেতে? আমাকে খেতে দেওয়া তো তার ইচ্ছা নয়, চিরকাল না খাইয়েই রেখেছে আমাকে; আমি যাতে খেতে না পাই, তার বাঁধনের হাত থেকে মুক্তি না পাই, সেজন্যে সে আমার ছেলেদের মধ্যে দলাদলি বাধিয়ে তাকে টিকিয়েই রেখেছে। আজ যখন আমার এত কষ্ট, তখনও আমার উপযুক্ত ছেলেদের আমার মুখে এক ফোটা জল দেবারও ব্যবস্থা না রেখে আটকে রেখেছে-তাই সরকারের কথা জিজ্ঞাসা করে আমায় কষ্ট দিও না…
জয় কিছুক্ষণ চুপ ক’রে সেই কাপড়ে ঢাকা রহস্যময়ী মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে : তোমার ঘোমটা-টা একটু খুলবে? তোমায় আমি দেখব।
বাংলা তার ঘোমটা খুলতেই তীক্ষ্ম আর্তনাদ ক’রে উঠল জয় : উঃ, কী ভয়ঙ্কর চেহারা হয়েছে তোমার। আচ্ছা তোমার দিকে চাইবার মতো কেউ নেই দেশের মধ্যে?
–না, বাবা। সুসন্তান ব’লে, আমার মুখে দুটি অন্ন দেবে ব’লে যাদের ওপর ভরসা করেছিলুম, সেই ছেলেরা আমার দিকে তাকায় না, কেবল মন্ত্রী হওয়া নিয়ে দিনরাত ঝগড়া করে, আমি যে এদিকে মরে যাচ্ছি, সেদিকে নজর নেই, চিতার ওপর বোধহয় ওরা মন্ত্রীর সিংহাসন পাতবে…
–তোমাকে বাঁচাবার কোনো উপায় নেই?
–আছে। তোমরা যদি সরকারের ওপর ভরসা না করে, নিজেরাই একজোট হয়ে আমাকে খাওয়াবার ভার নাও, তা হলেই আমি বাঁচব…
হঠাৎ জয় ব’লে উঠল : তোমার মুখে ওগুলো কিসের দাগ?
–এগুলো? কতকগুলো বিদেশী শত্রুর চর বছর খানেক ধরে লুটপাট ক’রে, রেল-লাইন তুলে, ইস্কুল-কলেজ পুড়িয়ে আমাকে খুন করবার চেষ্টা করছিল, এ তারই দাগ। তারা প্ৰথম প্ৰথম টআমার’ ভাল হবে বলে আমার নিজের ছেলেদেরও দলে টেনেছিল, কিন্তু তারা প্ৰায় সবাই তাদের ভুল বুঝেছে, তাই এখন ক্রমশ আমার ঘা শুকিয়ে আসছে। তোমরা খুব সাবধান!…এদের চিনে রাখ; আর কখনো এদের ফাঁদে পা দিও না। আমাকে খুন করতে…