কবিতা : পটভূমি
অজাতশত্রু, কতদিন কাল কাটলো :
চিরজীবন কি আবাদ-ই ফসল ফলবে?
ওগো ত্রিশঙ্কু, নামাবলী আজ সম্বল
টংকারে মূঢ় স্তব্ধ বুকের রক্ত৷
কখনো সন্ধ্যা জীবনকে চায় বাঁধতে,
সাদা রাতগুলো স্বপ্নের ছায়া মনে হয়,
মাটির বুকেতে পরিচিত পদশব্দ,
কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি থেকেই অব্যয়৷
ভীরু একদিন চেয়েছিল দূর অতীতে
রক্তের গড়া মানুষকে ভালবাসতে;
তাই বলে আজ পেশাদারী কোন মৃত্যু!
বিপদকে ভয়? সাম্যের পুনরুক্তি৷
সখের শপথ গলিতে কালের গর্ভে—
প্রপঞ্চময় এই দুনিয়ার মুষ্ঠি,
তবু দিন চাই, উপসংহারে নিঃস্ব
নইলে চটুল কালের চপল দৃষ্টি৷
পঙ্গু জীবন; পিচ্ছিল ভীত আত্মা,—
রাত্রির বুকে উদ্যত লাল চক্ষু;
শেষ নিঃশ্বাস পড়ুক মৌন মন্ত্রে,
যদি ধরিত্রী একটুও হয় রক্তিম॥
‘পটভুমি’ কবিতাটির রচনাকাল আনুমানিক ১৯৪২-৪৩৷
কবিতা : পত্র
কাশী গিয়ে হু হু ক’রে কাটলো কয়েক মাস তো,
কেমন আছে মেজাজ ও মন, কেমন আছে স্বাস্থ্য?
বেজায় রকম ঠাণ্ডা সবাই করছে তো বরদাস্ত?
খাচ্ছে সবাই সস্তা জিনিস, খাচ্ছে পাঁঠা আস্ত?
সেলাই কলের কথাটুকু মেজদার দু’কান
স্পর্শ ক’রে গেছে বলেই আমার অনুমান৷
ব্যবস্থাটা হবেই, করি অভয় বর দান;
আশা করি, শুনে হবে উল্লসিত প্রাণ৷
এতটা কাল ঠাকুর ও ঝি লোভ সামলে আসতো,
এবার বুঝি লোভের দায়ে হয় তারা বরখাস্ত৷
চারুটাও হয়ে গেছে বেজায় বেয়াড়া,
মাথার ওপরে ঝোলে যা খুশির খাঁড়া৷
নতেদা’র বেড়ে গেছে অঙ্গুলি হাড়া,
ঘেলুর পরীক্ষাও হয়ে গেছে সারা;
এবার খরচ ক’রে কিছু রেল-ভাড়া
মাতিয়ে তুলতে বলি রামধন পাড়া৷
এবার বোধহয় ছাড়তে হল কাশী,
ছাড়তে হল শৈলর মা, ইন্দু ও ন’মাসি৷
দুঃখ কিসের, কেউ কি সেথায় থাকে বারোমাসই?
কাশী থাকতে চাইবে তারা যারা স্বর্গবাসী,
আমি কিন্তু কলকাতাতেই থাকতে ভালবাসি৷
আমার যুক্তি শুনতে গিয়ে পাচ্ছে কি খুব হাসি?
লেখা বন্ধ হোক তা হলে, এবার আমি আসি॥
১৯৪৫ সালে সুকান্ত মেজবৌদি রেণু দেবীর সঙ্গে কাশী বেড়াতে যান৷ সুকান্ত ফিরে এসে শ্যামবাজারের বাড়ি থেকে এই চিঠিটি তাঁকে লিখেছিলেন৷ চিঠিটি রাখাল ভট্টাচার্য স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে দিয়েছেন৷
কবিতা : পরিচয়
ও পাড়ার শ্যাম রায়
কাছে পেলে কামড়ায়
এমনি সে পালোয়ান,
একদিন দুপুরে
ডেকে বলে গুপুরে
‘এক্ষুনি আলো আন্’৷
কী বিপদ তা হ’লে
মার খাব আমরা?
দিলে পরে উত্তর
রেগে বলে ‘দুত্তর,
যত সব দামড়া’৷
কেঁদে বলি, শ্রীপদে
বাঁচাও এ বিপদে—
অক্ষম আমাদের৷
হেসে বলে শাম-দা
নিয়ে আয় রামদা
ধুবড়ির রামাদের॥
‘পরিচয়’ ছড়াটির রচনাকাল ১৯৩৯-৪০ সাল বলে মনে হয়৷
কবিতা : ব্যর্থতা
আজকে হঠাৎ সাত সমুদ্র তেরো নদী
পার হ’তে সাধ জাগে, মনে হয় তবু যদি
পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ,
চাষার ছেলের হাতে এসে যেত হঠাৎ আজ৷
তা হলে না হয় আকাশবিহার হ’ত সফল,
টুকরো মেঘেরা যেতে-যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল;
জনারণ্যে কি রাজকন্যার নেইকো ঠাঁই?
কাস্তেখানাকে বাগিয়ে আজকে ভাবছি তাই৷
অসি নাই থাক, হাতে তো আমার কাস্তে আছে,
চাষার ছেলের অসিকে কি ভালবাসাতে আছে?
তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন,
যেখানে ঝলসে উঠবে কাস্তে দৃপ্ত-কিরণ৷
হে রাজকন্যা, দৈত্যপুরীতে বন্দী থেকে
নিজেকে মুক্ত করতে আমায় নিয়েছ ডেকে৷
হেমন্তে পাকা ফসল সামনে, তবু দিলে ডাক;
তোমাকে মুক্ত করব, আজকে ধান কাটা থাক৷
রাজপুত্রের মতন যদিও নেই কৃপাণ,
তবু মনে আশা, তাই কাস্তেতে দিচ্ছি শান,
হে রাজকুমারী, আমাদের ঘরে আসতে তোমার
মন চাইবে তো? হবে কষ্টের সমুদ্র পার?
দৈত্যশালায় পাথরের ঘর, পালঙ্ক-খাট,
আমাদের শুধু পর্ণ-কুটির, ফাঁকা ক্ষেত-মাঠ;
সোনার শিকল নেই, আমাদের মুক্ত আকাশ,
রাজার ঝিয়ারী! এখানে নিদ্রাহীন বারো মাস৷
এখানে দিন ও রাত্রি পরিশ্রমেই কাটে
সূর্য এখানে দ্রুত ওঠে, নামে দেরিতে পাটে৷
হে রাজকন্যা, চলো যাই, আজ এলাম পাশে,
পক্ষীরাজের অভাবে পা দেব কোমল ঘাসে৷
হে রাজকন্যা সাড়া দাও, কেন মৌন পাষাণ?
আমার সঙ্গে ক্ষেতে গিয়ে তুমি তুলবে না ধান?
হে রাজকন্যা, ঘুম ভাঙলো না? সোনার কাঠি
কোথা থেকে পাব, আমরা নিঃস্ব, ক্ষেতেই খাটি৷
সোনার কাঠির সোনা নেই, আছে ধানের সোনা,
তাতে কি হবে না? তবে তো বৃথাই অনুশোচনা॥
ব্যর্থতা’ কবিতাটি আষাঢ় ১৩৫৩-র কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়৷ কবিতাটি ‘মীমাংসা’ কবিতার প্রথম খসড়া বলে মনে হয়৷
কবিতা : ভবিষ্যতে
স্বাধীন হবে ভারতবর্ষ থাকবে না বন্ধন,
আমারা সবাই স্বরাজ-যজ্ঞে হব রে ইন্ধন!
বুকের রক্ত দিব ঢালি স্বাধীনতারে,
রক্ত পণে মুক্তি দের ভারত-মাতারে৷
মূর্খ যারা অজ্ঞ যারা যে জন বঞ্চিত
তাদের তরে মুক্তি-সুধা করব সঞ্চিত৷
চাষী মজুর দীন দরিদ্র সবাই মোদের ভাই,
একস্বরে বলব মোরা স্বাধীনতা চাই॥
থাকবে নাকো মতভেদ আর মিথ্যা সম্প্রদায়
ছিন্ন হবে ভেদের গ্রন্থি কঠিন প্রতিজ্ঞায়৷
আমরা সবাই ভারতবাসী শ্রেষ্ঠ পৃথিবীর
আমরা হব মুক্তিদাতা আমরা হব বীর॥
‘ভবিষ্যতে’ ও ‘সুচিকিৎসা’ — এই ছড়াদুটি ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের লেখা ‘সুকান্ত-প্রসঙ্গ’, ‘শারদীয়া বসুমতী’, ১৩৫৪-থেকে সংগৃহীত। পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় নি। এগুলি ১৯৪০-এর আগের লেখা বলে অনুমিত।