গৌরীর বিমুখ ভাব সুরেনের শিরায় শিরায় বইয়ে দিল তুষারের ঝড়; দ্রুত, অত্যন্ত দ্রুত মনে হল বাসের ঝাঁকুনি-দেওয়া গতি। বহুদিনের রক্ত-জাল-করা পরিশ্রম আর আশা চুড়ান্ত বিন্দুতে এসে কাঁপতে লাগল স্পিডোমিটারের মতো। একটু চাহনি, একটু পলক ফেলা আশ্বাস, এরই জন্যে সে কাঁধে তুলে নিয়েছিল কন্ডাকটারের ব্যাগ। কিন্তু আজ মনে হল বাসের সবাই তার দিকে চেয়ে আছে, সবাই মৃদু মৃদু হাসছে, এমন কি গৌরীর বাবাও। ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা হল সুরেনের টাকাকড়ি-শুদ্ধ কাঁধে ঝোলান ব্যাগটা।
ওরা নেমে যেতেই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ঘন্টি মেরে দুর্বল স্বরে হাঁকল : যা-ওঃ। কিন্তু ‘ঠিক হ্যায়’ সে বলতে পারল না। কেবল বার বার তার মনে হতে লাগল : নেহি, ঠিক নেহি হ্যায়।
সেদিন রাত্রে সুরেন মদ খেল, প্রচুর মদ। তারপর রামচরণকে অনুসরণ করল। যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে পোঁছে দেওয়াই রামচরণের কাজ। সে আজ সুরেনকে পৌঁছে দিল সৌখিন ভদ্রসমাজ থেকে ঘা-খাওয়া ছোটলোকের সমাজে।
[‘ভদ্রলোক’ গল্পটি অরণিতে ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।]
গান : আমরা জেগেছি আমরা লেগেছি কাজে
আমরা জেগেছি আমরা লেগেছি কাজে
আমরা কিশোর বীর ।
আজ বাংলার ঘরে ঘরে আমরা যে সইনিক মুক্তির ।
সেবা আমাদের হাতের অস্ত্র
দুঃখীকে বিলাই অন্ন বস্ত্র
দেশের মুক্তি-দূত যে আমরা
স্ফুলিংগ শক্তির ।
আমরা আগুন জ্বালাব মিলনে
পোড়াব শত্রুদল
আমরা ভেঙেছি চীনে সোভিয়েটে
দাসত্ব-শৃঙ্খল ।
আমার সাথীরা প্রতি দেশে দেশে
আজো উদ্যত একই উদ্দেশে—
এখানে শত্রুনিধনে নিয়েছি প্রতিজ্ঞা গম্ভীর
বাঙলার বুকে কালো মহামারী মেলেছে অন্ধপাখা
আমার মায়ের পঞ্জরে নখ বিঁধেছে রক্তমাখা
তবু আজো দেখি হীন ভেদাভেদ !
আমরা মেলাব যত বিচ্ছেদ;
আমরা সৃষ্টি করব পৃথিবী নতুন শতাব্দীর ।
গান : জনযুদ্ধের গান
জনগণ হও আজ উদ্বুদ্ধ
শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ,
জাপানী ফ্যাসিস্টদের ঘোর দুর্দিন
মিলেছে ভারত আর বীর মহাচীন ।
সাম্যবাদীরা আজ মহাক্রুদ্ধ
শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ ।।
জনগণ শক্তির ক্ষয় নেই,
ভয় নেই আমাদের ভয় নেই ।
নিষ্ক্রিয়তায় তবে কেন মন মগ্ন
কেড়ে নাও হাতিয়ার, শুভলগ্ন ।
করো জাপানের আজ গতি রুদ্ধ;
শুরু করো, প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ ।।
গান : বর্ষ-বাণী
যেমন করে তপন টানে জল
তেমনি করে তোমায় অবিরল
টানছি দিনে দিনে
তুমি লও গো আমায় চিনে
শুধু ঘোচাও তোমার ছল ।।
জানি আমি তোমায় বলা বৃথা
তুমি আমার আমি তোমার মিতা,
রুদ্ধ দুয়ার খুলে
তুমি আসবে নাকো ভুলে
থামবে নাকো আমার চলাচল ।।
গান : যেমন ক’রে তপন টানে জল
যেমন করে তপন টানে জল
তেমনি করে তোমায় অবিরল
টানছি দিনে দিনে
তুমি লও গো আমায় চিনে
শুধু ঘোচাও তোমার ছল ।।
জানি আমি তোমায় বলা বৃথা
তুমি আমার আমি তোমার মিতা,
রুদ্ধ দুয়ার খুলে
তুমি আসবে নাকো ভুলে
থামবে নাকো আমার চলাচল ।।
গান : শৃঙ্খল ভাঙা সুর বাজে পায়ে
শৃঙ্খল ভাঙা সুর বাজে পায়ে
ঝন্ ঝনা ঝন্ ঝন্
সর্বহারার বন্দী-শিবিরে
ধ্বংসের গর্জন ।
দিকে দিকে জাগে প্রস্তুত জনসৈন্য
পালাবে কোথায় ? রাস্তা তো নেই অন্য
হাড়ে রচা এই খোঁয়াড় তোমার জন্য
হে শত্রু দুষমন !
যুগান্ত জোড়া জড়রাত্রির শেষে
দিগন্তে দেখি স্তম্ভিত লাল আলো,
রুক্ষ মাঠেতে সবুজ ঘনায় এসে
নতুন দেশের যাত্রীরা চমকালো ।
চলতি ট্রেনের চাকায় গুঁড়ায়ে দম্ভ
পতাকা উড়াই : মিলিত জয়স্তম্ভ ।
মুক্তির ঝড়ে শত্রুরা হতভম্ব ।
আমরা কঠিন পণ
ছন্দ ও আবৃত্তি
বাংলা ছন্দ সম্পর্কে এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে যে, সে এখন অনেকটা সাবালক হয়েছে। পয়ার-ত্রিপদীর গতানুগতিকতা থেকে খুব অল্প দিনের মধ্যেই বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের প্রগতিশীলতায় সে মুক্তি পেয়েছে। বলা বাহুল্য, চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির আমল থেকে ঈশ্বর গুপ্ত পর্যন্ত এতকাল পয়ার-ত্রিপদীর একচেটিয়া রাজত্বের পর রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবই বাংলা ছন্দে বিপ্লব এনেছে। মধুসূদনের ‘অমিত্রাক্ষর’ মিলের বশ্যতা অস্বীকার করলেও পয়ারের অভিভাবকত্ব ঐ একটি মাত্র শর্তে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বিহারীলাল প্রভৃতির হাতে যে-সম্ভাবনা লোহা ছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে তা ইস্পাতের অস্ত্র হল। রবীন্দ্রনাথের হাতে ছন্দের ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতার পরিচয় দেওয়া এখানে সম্ভব নয়, তবু একটি মাত্র ছন্দ রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কাব্য জীবনে অদ্ভুত ও চমকপ্রদ ভাবে বিকাশ লাভ করে এবং ঐ ছন্দেরই উন্নত পর্যায় শেষের দিকের কবিতায় খুব বেশী রকম পাওয়া যায়। সম্ভবত এই ছন্দই রবীন্দ্রনাথকে গদ্য-ছন্দে লেখবার প্রেরণা দেয় এবং তার ফলেই বাংলা ছন্দ বাঁধা নিয়মের পর্দা ঘুচিয়ে আজকাল স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছে। বোধহয়, একমাত্র এই কারণেই বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বলাকা-ছন্দ ঐতিহাসিক।
সত্যেন দত্তের কাছেও বাংলা ছন্দ চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে। নজরুল ইস্লামও স্মরণীয়। নজরুলের ছন্দে ভাদ্রের আকস্মিক প্লাবনের মতো যে বলিষ্ঠতা দেখা গিয়েছিল তা অপসারিত হলেও তার পলিমাটি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে সোনার ফসল ফলানোয় সাহায্য করবে। এঁরা দু’জন বাদে এমন কোনো কবিই বাংলা ছন্দে কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন না, যাঁরা নিজেদের আধুনিক কবি বলে অস্বীকার করেন। অথচ কেবলমাত্র ছন্দের দিক থেকেই যে আধুনিক কবিতা অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছে এ কথা অমান্য করার স্পর্ধা বা প্রবৃত্তি অন্তত কারো নেই বলেই আমার মনে হয়।