Site icon BnBoi.Com

হোমারের স্বপ্নময় হাত – শামসুর রাহমান

হোমারের স্বপ্নময় হাত - শামসুর রাহমান

আইসক্রিম

হঠাৎ পৃথিবীটাকে কেমন আলাদা মনে হয়
বালকের। ভেণ্ডারের কাছ থেকে তৃষ্ণার্ত দুপুরে
কিনেছে আইসক্রিম ছোট মাটির কলস ভেঙে
জমানো পয়সা বের করে। পৌরপথে হেঁটে-হেঁটে
বালক আইসক্রিম করছে লেহন; রূপকথা
থেকে এক রাজা এসেছেন এ শহরে, মনে হলো
তার; কিন্তু কী বিস্ময়, সে ব্যতীত কেউ তাকে ঠিক
লক্ষ করছে না, তাঁর পোশাকের বাহার ভীষণ
ব্যর্থ সাধারণ পোশাকের ভিড়ে। রাজার নিকটে
যাবে কি যাবে না ভেবে বালক আইসক্রিম হাতে
ফুটপাতে উঠে পড়ে, চলে আসে আবার গলির মোড়ে, একা।
রাজার আয়ত চোখ মনে পড়ে তার; রৌদ্র-লাগা
গোলাপি আইসক্রিম ক্রমশ গলতে থাকে তার
মুখের ভেতর, জিভ কেমন বিবশ হয়ে আসে।

এখন মাঝরাস্তায় আমি; শ্বাসরোধকারী নিঃসঙ্গতা
একটা মাকড়সার মতো হাঁটছে
আমার চোখে, গালে, কণ্ঠনালীতে,
বুকে, ঊরুতে আর
অন্ধকারের জোয়ার খলখলিয়ে উঠছে আমার চারপাশে।

অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। মনে হয়,
এখানে কোথাও তুমি আছো, ডাকলেই
সাড়া দেবে লহমায়। তলোয়ার মাছের মতো
তোমার কণ্ঠস্বর
ঝলসে উঠবে অন্ধকারে।
কণ্ঠে সমস্ত নির্ভরতা পুরে তোমাকে ডাকলাম,
শুধু ভেসে এলো আমার নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।

অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলেছি, যদি হঠাৎ
তোমার দেখা পেয়ে যাই।
ভেবেছি, আমার দিকে প্রসারিত হবে
অলৌকিক বৃক্ষশাখার মতো তোমার হাত।

কতকাল প্রতীক্ষাকাতর আমি
তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে, কত পাথর আ কাঁটাময়
পথ পেরিয়েছি তোমাকে একটিবার
দেখবো বলে। অথচ আমার সকল প্রতীক্ষা আর
ব্যাকুলতাকে বারংবার উপহাস করেছে
তোমার নীরব অনুপস্থিতি।

অন্ধকারে আমি দু’হাতে আঁকড়ে রেখেছি
একটি আয়না যাতে দেখতে পাই
তোমার মুখের ছায়া। কিন্তু আয়নায় পড়ে না
কোনো ছায়া, লাগে না নিঃশ্বাসের দাগ।

এখানে কোথাও না কোথাও তুমি আছো,
এই বিশ্বাস কখনও-সখনও
আমাকে বাঁচায়
অক্টোপাশা-বিভ্রান্তি থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়ে
আমি কী করবো যা সমর্থিত নয়
জ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্রে?

জ্ঞান আমার উদ্ধার, তারই অন্বেষণে
উজিয়ে চলি
স্বৈরিণীর মতো অন্ধকার। এজন্যে যদি তোমাকে খোঁজার সাধ
মুছে যায় কোনো রাগী পাখার ঝাপটে,
আমি প্রতিবাদহীন পা চালিয়ে যাবো
জ্ঞানের বলয়ে আমার অজ্ঞতা নিয়ে।

ইদানীং বঙ্গীয় শব্দকোষ

স্বীকার করাই ভালো, কিছুকাল থেকে
আমরা শব্দের ভুল প্রয়োগে ক্রমশ হচ্ছি দড়।
যেখানে আকাট মূর্খ শব্দটি মানায় চমৎকার,
সেখানে পণ্ডিত ব্যবহার করে আহ্লাদে আটখানা
হয়ে যাই। শক্রস্থলে বন্ধু শব্দটিকে
হরহামেশাই
জিভের ডাগায়
নাচাই এবং যারা অতি খর্বকায়
তাদের সপক্ষে দীর্ঘকায় বিশ্লেষণ
সাজিয়ে নরক করি গুলজার আর
মানুষের বদলে সম্প্রতি
ওরাংওটাং
বসিয়ে লাফিয়ে উঠি তিন হাত, খাই ডিগাবাজি
করি সহবত বনচারীদের সঙ্গে দিনরাত।

বস্তুত স্বর্গত হরিচরণের বিখ্যাত নিষ্ঠার প্রতি বুড়ো
আঙুল দেখিয়ে দিব্যি শেয়াল-শকুন অধ্যুষিত
ভাগাড়কে স্বর্গোদ্যান বলি
সটান দাঁড়িয়ে চৌরাস্তায়,
এবং শব্দের ভুল প্রয়োগ-মড়কে নিমেষেই
যুদ্ধবন্দি বিনিময় হয়ে যায় মন দেয়া-নেয়া।

এ অতি সামান্য কথা

এ অতি সামান্য কথা, আপনার নিশ্চয় জানেন-
দাঁত ক্ষয়ে গেলে বাঘ হয়ে যায় কিছুটা দুর্বল,
বনের পশুরা তাকে ফাঁকি দিয়ে নাকের তলায়
তার দিব্যি করে আনাগোনা, তাই সে প্রায়শ
মেটাতে দাঁতের সুখ, সুতীব্র জঠরজ্বালা দেয়
হানা শান্ত গেরস্ত পাড়ায়। অবশেষে দশদিকে
তুখোড় মানুষখেকো বলে খ্যাতি রটে তার। যারা
কবিতা লিখতে গিয়ে কাব্যলক্ষ্মীর ছাউনি থেকে
নির্বাসিত হয়, তারা যদি বাগিয়ে কলম নিত্য
শজারুর মতো রেগে ঝোপঝাড় তছনছ করে,
রাশি-রাশি পুঁথি ঘেঁটে, তথ্যের টিলায় হাঁটু গেড়ে
সমালোচনায় মাতে, কাব্যমীমাংসার ভার নেয়
নিজ হাতে তুলে, তবে ওরা সোনালি পদবী পায়
একাডেমী থেকে, আর কবি থাকে শত হস্ত দূরে।

এই রক্তধারা যায়

যেদিকে তাকাই শুধু ধ্বংস্তূপ দেখি আজকাল।
এ আমার দৃষ্টিভ্রম নাকি
বাস্তবিকই চতুর্দিকে পরাজিত সৈনিকের মতো
পড়ে আছে? এখন এখানে যুবকেরা রাত্রিদিন চক্রাকারে
গাঁজা খায়, মধ্যরাতে কানামাছি খেলে
কখনও-সখনও, এলোকেশী যুবতীরা
নিয়ত বিলাপ করে। কতিপয় বেড়াল ছায়ার মতো ঘোরে
আশেপাশে, খাদ্যন্বেষী ইঁদুরেরা ব্যর্থ হয়ে ঢোকে
গর্তের ভেতর পুনরায়, জ্বরাগ্রস্ত মানুষের
সাধের যযাতি-স্বপ্ন চকিতে মিলায় প্রেতায়িত অস্তরাগে।

এখন এখানে সূর্যাস্তের রঙ ছাড়া
অন্য কোনো রঙ নেই,
এখন এখানে শোণিতের গন্ধ ছাড়া
এখানে সাপের স্পর্শ ছাড়া আপাতত
অন্য কোনো স্পর্শ নেই,
এখন এখানে দৃষ্টিহীনতা ব্যতীত
অন্য কোনো দৃষ্টি নেই।

কাউকে দেখলে কাছে দূরে সরে যাই তাড়াতাড়ি
দৃষ্টিকটুভাবে,
কেননা বন্ধুর কাছে গিয়ে দেখেছি সে বন্ধুতার
মুখোশের আড়ালে শক্রর ভয়াবহ মুখচ্ছদ
নিয়ে বসে আছে
মাছির প্রভুর মতো। কাউকে করি স্পর্শ, পাছে
সে নিমেষে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়;
আমার নিজেরই প্রতি সেই আর পূর্ণিমা-বিশ্বাস ইদানীং।

দিনের অন্তিম রোদ ধ্বংসস্তূপে ব্যাপক বসায়
নখ কামুকের মতো। অদূরে চলছে ভোজ শকুনের আর
শেয়ালের ডাক
মাঝে-মাঝে অভিশপ্ত স্তব্ধতাকে করে
চুরমার; স্মৃতি আবিষ্কার করে আমি
বেনামী অস্তিত্ব খুঁজি পূর্বপুরুষের। ভস্মরাশি থেকে উঠে
শূন্যতায় ভাসে শাদা পিরহান, দাদার খড়ম।
অদৃশ্য অক্ষর লিখে অন্ধকারে আসা-যাওয়া করি;
আমার নিঃসঙ্গতায় মর্মরিত হয়
দূর শতাব্দীর হাওয়া, বয় নূহের কালের ঢেউ।

ধ্বংসস্তূপে ফুল কুড়াবার জন্যে ঝুঁকতেই মনে পড়ে যায়,
বিশীর্ণ ইথিওপিয়া ক্রমশ মরছে অসহায়
দু’চোখ উল্টিয়ে। বর্তমান জীবন মৃত্যুর ভেদ লুপ্ত,
কর্কশ-বাঁশির তালে-তালে গলা ছেড়ে
আমাকে গাইতে হবে গান। সুর যত
ওঠে উচ্চগ্রামে, তত রক্ত ঝরে বুক থেকে; ধ্বংসস্তূপে গান
গাইলে নিশ্চিত বুকচেরা রক্ত ঝরাতেই হয়,
এই রক্তধারা যায় ছায়াপথে, নক্ষত্রের দিকে।

 একদিন দুপুরে

সজনে গাছের ডালে পাখি ডাকে ডবকা দুপুরে, গায় গান
পাড়ার মাস্তান,
নেশাভাঙ করে আর হিজড়া ধরনে
নাচে, যেন ওরা মায়াবনে
দেবদূত দেখে খুব প্রাণিত এখন।
গলি থেকে তরুণী বেরোয়া একা, ফেরিঅলা ডেকে
যায় দুপুরকে চিরে-চিরে;
অকস্মাৎ কেমন চাঞ্চল্য জাগে মানুষের ভিড়ে,
ট্রাফিক পুলিশ উচ্চকিত, বাঁশি বাজে, কী বিপন্ন বিহ্বলতা
চতুর্দিকে, ট্রাকের তলায় চাপা পড়েছে উদোম মানবতা।

এখন সে কথা থাক

(আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রীতিভাজনেষু)

আমার পিতামহের আমলের অনেক পুরনো
এক সিন্দুকের কথা জানি, যার ডালা
খুললেই চকিতে প্রাচীনতা
বিশীর্ণ আঙুল নেড়ে নেড়ে ডাকে রহস্যের স্বরে।
যেন তার অভ্যন্তরে খুব দীর্ঘ পথ আছে গাছগাছালির
সেরেনাদে খুব স্নিগ্ধ, চোখের পাতায় জমে ছায়া,
আছে কিছু তসরের শাড়ির সৌরভ,
ঘাসে ফেলে-যাওয়া কারো পশমের চটি,
সৌন্দর্যমাতাল রুগ্ন খর্বুটে কবির এপিটাফ,
বাছুরের ঘুণ্টি-বাঁধা মেটে গলা, দাদার তসবিহ্‌-
এরকম ভাষাচর্চা করে সে সিন্দুক।
এখন সে কথা থাক।

সাতটি সোনালি মাছ আলোকিত কড়িকাঠ থেকে
নেমে পিয়ানোর রিডে নাচে,
আয়না বেয়ে উদ্‌বেড়ালের নাকের ডগার নিচে
ব্যালেরিনাদের মতো মোহন বিন্যাস তৈরি করে,
তারপর ঘর ছেড়ে উড়ে যায় দূরে
জানালার পর্দা দুলিয়ে
কুঁড়েঘর, টিনশেড ছুঁয়ে গায়ে মেখে
মেঘেদের রোঁয়া।
পাহাড়ি ঈগল সেই দৃশ্যের চকিত উন্মীলনে
ঈষৎ বিস্মিত হয়ে রহস্যের মর্মমূল স্পর্শ করে
নিজেও সঙ্গীতময় হয়।
সোনালি মাছের গান এখানেই লয়ে নিবিড় মিলিয়ে যাক।

প্রাচীন দুর্গের মতো একটি বাড়ির কাছে যাই
মাঝে-মধ্যে,দাঁড়াই সামান্যক্ষণ, এদিক-ওদিক লক্ষ করি,
দূর থেকে জেনে নিতে চাই
বাড়ির ভেতর কতটুকু অন্ধকার কিংবা কতটা আবির
তৈরি হয়। কখনও সে বাড়ি আশাবরী ধরে,
কখনও-বা গায় মধ্যরাতে
দরবারি কানাড়া। একজন থাকে সে বাড়িতে, যাকে
কখনও দেখিনি আমি, যার নরম পায়ের কাছে
শুয়ে থাকে এক জোড়া চিতাবাঘ, কতিপয় নীলাভ ময়ূর
ঘোরে সারাক্ষণ আশেপাশে; মাঝে-মাঝে
তার কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে ঝাড়লণ্ঠনের মতো,
সে-ভাষা বুঝি না।
আজ থাকে, সে-বাড়ির কথা
একান্ত বিশদভাবে বলা যাবে কখনও আবার।

কখনও হাটে নেই

কখনও হাটে নেই, মাঠেও নেই, শুধু
মগ্ন থাকে একা নিজের মতো।
গহন সত্তায় যেন কে মঠবাসী
পেতেছে আস্তানা, হৃদয়ে ক্ষত।

দিবস দাবানল, ক্ষুধিত আগুনের
হল্কা বয়ে যায় একলা ঘরে
ঘনিয়ে এলে রাত খরায় ছারখার
দগ্ধ আত্মায় বৃষ্টি ঝরে।

মানসে ঈগলের অহংকার-মণি,
সুদূর নীলিমার অন্ত নেই।
নীলিমা ছুঁয়ে ছেনে জমিনে ফিরে আসে
জীবনপরায়ণ সন্ত সেই।

করে না চেচাঁমেচি, কণ্ঠস্বর তার
পড়শী শোনে পেতে আড়ালে আড়ি;
কখনও শৃঙ্ক্ষলা উচ্চারণে বাজে,
কথারা কখনও-বা এলোপাতাড়ি।

দৃষ্টি প্রত্যহ রেখে সে দূর পথে
রৌদ্রে, মেঘপুরে কাটায় বেলা;
ভ্রমণাতুর তার হৃদয় অজানায়
ভাসায় কুয়াশায় ভ্রষ্ট ভেলা।

যখন অন্তরে টানাপোড়েন নেই,
তখন মরশুম শূন্যতার।
ডুবলে নৈরাশে, হঠাৎ কাঁটাবনে
দ্বান্দ্বিকতা আনে দ্যুতিবিথার।

 কবর সাজাই

সেদিনও সকাল শহরের মুখে সতেজ আবির
কিছু দিয়েছিলো মেখে। ময়লা গলির মোড়ে নিডর বালক
ডাংগুলি খেলতে-খেলতে
আইসক্রিমের প্রতি গিয়েছিলো উড়ে
গাংচিল ভঙ্গিমায়। কেউ-কেউ পাবদা মাছের শুরুয়ায়
ডুবিয়ে আঙুল
ঘড়ির কাঁটার প্রতি রেখেছিলো চোখ,
অফিসের তাড়া ছিলো বলে।
সেদিনও কোথাও
দাম্পত্য কলহ ছিলো, ছিলো কিছু প্রেমের সংলাপ;
নিউজপ্রিন্টের বুকে ছিলো
স্মরণমন্থনকারী ফাল্গুনের একরাশ উদ্ভিন্ন অক্ষর।

একস্মাৎ কী-যে হলো, শহরের পথে
দুপুরেই সন্ধ্যা এলো নেমে, যেন রূপান্তরে গলগোথা ঢাকা
কেরানীর কলমের গতি গেলো থেমে
লেজারের উদাস পাতায়। ঝাঁকা মুটে, রিক্‌শা-অলা,
ফেরি-অলা আর চটকলের শ্রমিক
চমকে উঠলো শিকারির গুলিবিদ্ধ পাখির ঝাঁকের মতো।
শহরের পথে
নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে শত রক্তজবা। ছিলো যারা
সাধারণ এবং অজ্ঞাত,
যৌথ অবচেতনার পরিচর্যা পেয়ে
তারাই প্রকৃত অসামান্য হয়ে ওঠে স্বপ্নচারী পরাক্রমে
কিংবদন্তির মতো ধ্রুব এবং অপিরহার্য। ছিলো না
হেলমেট, টিউনিক ওদের, অথচ
তারাও সৈনিক রৌদ্রজলে ঝড়ক্ষুব্ধ পরিখায়।
হৃদয়ে মায়ের ডাক খুব তীব্র পৌঁছেছিলো বলে
বুকের ভেতর তার ঝড় হতে থাকে, বুঝি তাই
ছুটে আসতেই হয় পথে, হাটে-মাঠে,
শুনতেই হয় সেই গান, সুর যায় যাঞ্চা করে
আত্মবলিদান। ওড়ে তার খুলি, বুকে গর্ত হয়। কী বিস্ময়,
সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের স্মৃতির ভূগোলে
পতাকারই মতো দীপ্ত, বন্দনা-স্পন্দিত,
কেমন নিঃশব্দ প্রেমে, অথচ বাঙ্গময়!
সে নেই কোথাও
রঙিন ছবির পোস্টাকার্ডে কিংবা দেয়ালে পোস্টারে
আছে আমাদের চৈতন্যের ল্যাণ্ডস্কেপে,
গল্পে আছে, যেমন গোলাপ থাকে পাতার ভিতর,
কবিতার পবিত্র পংক্তিতে আছে, যেন
চির বরাভয়,
আছে স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের চিদাকাশে,
তাই বর্ণমালা দিয়ে আজ তার কবর সাজাই।

কড়া নেড়ে যাবে

মারী ও মড়কে পুড়ে-পুড়ে হাড়
কালি হলো আর জটিল সড়কে
হেঁটে হেঁটে পায়ে ক্ষত বেড়ে যায়;
দান্তের মতো নরকে ভ্রমণ অব্যাহত।

খাঁ-খাঁ জ্যোৎস্নায় নগ্নিকা দেখি
শুকোতে দিচ্ছে ছেঁড়া শাড়ি তার।
বিশীর্ণ শিশু ঘন-ঘন করে
মায়ের শূন্য হাতের তালুতে দৃষ্টিপাত।

চরাচরব্যাপী হাহাকার শুনে,
অধিবাস্তব পালা দেখে আজ
রাত্তিলোভী চাঁদ ওঠে না তো
রোগা কেরানির আপিস কামাই করার মতো।

মল্লিকা বনে দিনরাত্তির
কবর খুঁড়ছে শবসাধকেরা;
ছিঁচকাঁদুনের দল মর্শিয়া
গেয়ে এলেবেলে করে প্রস্থান অস্তাচলে।

আর কিছু আমি পারি না-ই পারি,
অন্তত আজ কথা দিতে পারি-
আমার কবিতা কড়া নেড়ে যাবে
ঘুমন্ত সব নিঝুম বাড়িতে একলা হাতে।

 দালান

আমার বাসার চতুর্দিকে দালান উঠছে ক্রমে
মাতব্বদের মতো মাথা উঁচু করে। ইদানীং
সচ্ছলতা, বোঝা যায়, শিস্‌ দিচ্ছে পাড়ায়-পাড়ায়।
অবশ্য একথা তত প্রাসঙ্গিক নয়; দশজন
আঙুল ডুবিয়ে ঘিয়ে বসবাস করলে টাটায় না
কখনও আমার চোখ। এ রকমভাবে অতি দ্রুত
দালান ওঠার ফলে আগেকার অনেক কিছুই
পড়ে না আমার চোখে আর। প্রতিদিন যে তরুণী
বারান্দায় দাঁড়াতো উদ্দাম চুলে, যেসব বালক
একটি প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলে হতো খুশি, আর
দেখতাম তালগাছে চিল, দাঁড়কাক, কতিপয়
ভিন্ন পাখি সহজে বিশ্রাম নিতো, তারা সকলেই
অদৃশ্য সম্প্রতি; দুঃখ হয়। ল্যাণ্ডস্কেপের সন্ধানে
এখন মনের অভ্যন্তরে আমি দৃষ্টি মেলে দিই।

নস্টালজিয়া

আবার সেখানে তুমি হুবহু আগের মতো সব
পেয়ে যাবে, এরকম ভাবা ঠিক নয়। বহু পথ পাড়ি দিয়ে
অখ্যাত স্টেশনে নেমে খানিক জিরিয়ে
হেঁটে যাবে, তারপর উঠবে নৌকায়, পালে হাওয়া
লাগবে, মেঘনার বুক চিরে,
যাবে তুমি বহুদূরে ভাটিয়ালি টানে।
ধান-রঙ অপরাহ্নে আলুঘাটা পৌঁছে
শহুরে পা রেখে ভেজা মাটিতে এবং
দৃর্ষ্টি মেলে গাছগাছালির ভিড়ে, ছনছাওয়া ঘরে
কী তুমি প্রত্যাশা করো আজ?

কৈশোর ও যৌবনের মাঝখানে থমকে দাঁড়ানো
সেই মেয়ে আসবে কি ছুটে
শাড়ির কোঁচড়ে তার একরাশ বৈঁচি ফল নিয়ে?
কিংবা সে কিশোর, যাতে তুমি
এই তো সেদিন ভরা শ্রাবণের নিঝুম ধারায়
কী ব্যাকুল ছুঁয়ে
পরখ করতে চেয়েছিলে সে প্রকৃত
সজীব প্রতিভূ কিনা বাস্তবের, সেও কি আবার
তোমার সতৃষ্ণ বুকে পড়বে ঝাঁপিয়ে
নিরাশ্রয় পাখির ধরনে?

বাঁশঝাড় পেরুনোর সময় তোমার
পড়বে কি মনে কত উদাস দুপুরে
পাখির ডিমের লোভে ক’জন বালক দিতো হানা জরাগ্রস্ত
কাচারি বাড়ির আশেপাশে থমথমে সান্নাটায়?
পড়বে কি মনে পূর্ণিমায় পুরনো পুকুর পাড়ে ঢ্যাঙা নাঙা
ফকিরের নিসর্গ-মাতানো নাচ? মধ্যরাতে বৈঠকখানায়
মাইজভাণ্ডারি গান?
পড়বে কি মনে সেই দৃশ্যবলি, খুব ছলছলে
হাল-আমলের গ্রামভিত্তিক বঙ্গীয় উপন্যাসে
যে রকম থাকে?
কষ্ট দেয় প্রাচীনতা বড় কষ্ট দেয়, ভাবো তুমি,
দরবারি কানাড়ার মতো। ত্রস্ত খরগোশ ঝোপ
থেকে ঝোপান্তরে ছুটে যাবে, ঝরবে পায়ের কাছে
আম জাম কাঁঠালের পাতা, দাওয়ায় দাঁড়ানো কেউ
উঁকি দেবে, ধরা যাক। পাখি
চকিতে উঠবে ডেকে সন্ধ্যাকে চমকে দিয়ে খুব।
হয়তো সেখানে গিয়ে দেখবে আগের মতো নেই
কোনো কিছু, হয়তো বা কোনো চোখের অনাশ্রয়
তোমাকে ফিরিয়ে দেবে শূন্য নদীতীরে, তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও
আজ হোক কাল হোক তোমাকে যেতেই হবে সুদূর সেখানে।

 নিজের ছায়ার দিকে

আমার ভেতরে আছে এক ছায়া সুনসান; তার
ধরন বেখাপ্পা খুব, অন্তরালে থাকে।
সামাজিত তাকে বলা যাবে না, যদিও ভ্রমণের
অভিলাষ আছে তার এখানে-সখানে অবিরাম।

কখনও-সখনও
নিজের ছায়ার দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে
তাকাই রহস্যবাদী মানুষের মতো। সদিচ্ছার
অনটন নেই,
অথচ আমার ছায়া বাড়ালে উদগ্রীব হাত, আমার নিকট
নয়, অন্য কারো দিকে প্রসারিত হয়।

সকল সময়
আমার সমান্তরাল বসে, হেঁটে যায়,
নিদ্রায় আমার সঙ্গে দিব্যি মিশে থাকে হরিহর।
যখন সে দ্যাখে ধুরন্ধর বুদ্ধিজীবী
আর গোমূর্খের দল খাচ্ছে জল একঘাটে
তুখোড় কৃপায় কারো, মর্মমূলে তার
পরিহাস ফণিমনসার রূপ ধরে। নিজস্ব ভূমিকা নিয়ে
খানিক বিব্রত হয়, ফাঁদে-পড়া
পাখির মতোই
ডানা ঝাপটাতে থাকে প্রহরে-প্রহরে। আর ভাবে
মাঝে-সাজে- কখনও প্রকৃত মানুষের চেয়ে তার
ছায়া বড় হয়ে যায়।

কলহাস্য-সংকলিত সজীব বাসরঘরে মরুর বিস্তার,
গেরস্ত ঘরের উর্বশীর প্রতি যযাতি-দৃষ্টির
লোলুপতা দেখে চমকে ওঠে আর
একটি যুগের অস্তরাগে
রঙিন বিহ্বল হয়ে আমার ভেতর থেকে তীব্র
বেরিয়ে পড়তে চায়, যেন
কোনো দূর হ্রদের কিনারে গিয়ে খানিক দাঁড়াবে,
নিমেষে ফেলবে ধুয়ে অস্তিত্বের ক্লান্তিময় ধূলো।

কখনও-কখনও বড় বেশি অস্থিরতা
পেয়ে বসে তাকে; আমি নিজে
যতোই ঘরের খুঁটি শক্ত হাতে ধরি,
আমার নিজস্ব ছায়া হতে চায় ততোই বিবাগী।

পর্যটন

কড়া নেই; ব্যস, এইটুকু যা তফাত। কিছুকাল
ছোট এক ঘরের ভিতরে
আছি, হয়তো
গভীর ভূতলাশ্রয়ী রাজনীতিপরায়ণ কেউ
ধূর্ত ফেউদের খরদৃষ্টির আড়ালে
এরকম করে বসবাস।
নিভৃতে নিজেকে ক্রমাগত
নিজের ভিতরে খুব গুটিয়ে নিয়েছি।

আমি কি কারুর ভয়ে ইদানীং এমন আড়াল
খুঁজি রাত্রিদিন?
আস্তে সুস্থে দু’পা
এগিয়ে গেলেই ছুঁতে পারি মল্লিকার শরীরাভা
এবং নিবিষ্ট বসা যায় গুঞ্জরিত
চাখানায় বুলিয়ে ব্যাপক ভ্রাতৃদৃষ্টি শুভবাদী
কথোপকথনে নাক্ষত্রিক নীড় খোঁজা চলে আর
সত্তাময় রাঙা ধূলো নিয়ে ফেরা নিভাঁজ সহজ।

কোথাও যাই না; মূর্তিমান সান্ত্রী নেই আশেপাশে,
তবু চতুর্দিকে কী নাছোড় কবন্ধ পাহারা
মাঝে-সাঝে ইচ্ছে হলে পর্দাটা সরিয়ে
জানালার বাইরে তাকাই,
চোখ দিয়ে ছুঁই
গোলাপ, টগর, জুঁই, আকাশ-সাজানো
দূর সাইরেবিয়ার, গোধূলিমাতাল হংসযূথ।
সর্বোপরি পায়চারি নিজের ভেতরকার ছাঁদনাতলায়।

কোথাও যাওয়ার নেই, শুধু অন্তর্গত
পথের বিস্ময়মাখা হাওয়া
বয় ভিন্ন স্তরে, নীলিমার স্পর্শ লাগে; অন্ধকারে বিছানায়
শুয়ে ভাবি বাসারির কথা,
সিস্টার্ন চ্যাপেল আর ইরাসমূজের মানবিক দীপ্তিমালা
দুলে ওঠে, অকস্মাৎ একজন পর্যটক, পায়ে তার বৎসরান্তিক
ধূলো, চুল এলোমেলো, খোলা গেরেবান,
দাঁড়ায় দরজা ঘেঁষে, বলে-চলো যাই।

বসে আছে

বেশ কিছুকাল থেকে বসে আছে পাথুরে বেঞ্চিতে।
সূর্যাস্ত বিছায় স্নেহ চোখে, মুখে, ভুরুতে, আঙুলে;
চুল ওড়ে, প্রশস্ত কপালে বৈরাগ্যের পথরেখা,
শ্মশানের কাঠ পোড়ে হৃদয়ের ভিতরে এবং
চক্ষুদ্বয় পাখির রঙের অন্তরালে ভিন্ন কোনো
বর্ণশোভা দেখে নিতে খুব স্থির। এ ভঙ্গিতে তার
ঈষৎ স্থাপত্য আছে, আছে শুদ্ধ সঙ্গীতময়তা।
স্বাস্থ্যান্বেষী ব্যক্তিবর্গ, বয়েসী, এবং কতিপয়
চমকিলা যুবা তাকে দেখে হাসে, কেউ-কেউ শিস্‌
দেয়, যেন বৃক্ষাশ্রিত পাখিরা উদ্দিষ্ট, এই মতো
ভান করে হেঁটে যায়। কারুর দিকেই নেই তার
দৃষ্টি, শুধু নিজের ভেতরে চোখ সঞ্চরণশীল
অতিশয়; এখন সত্তায় তার ঠোনা দিলেও সে
নড়বে না এতটুকু, মনে হয়; যেন-বা পাথর।

বাক্য খরায়

সেই কবে থেকে লিখছি কবিতা, তবু হামেশাই
ভীষণ আটাকা পড়ি হতাশায় ঊর্ণাজালে।
কখনও-কখনও এমনও তো হয়, একটি কবিতা
মাঝপথে এসে স্মৃতিহীন ধুধু চড়ায় ঠেকে।

মগজের কোষে, শিরায় শিরায় জাগে ক্রমাগত
গোধূলি বেলায় প্রাক্তন কত প্রতিধ্বনি।
দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসে দিশেহারা কোনো
মেষপালকের আব্‌ছা ব্যাকুল কণ্ঠস্বর।

কখনও-কখনও শুরুতেই বাজে তালকানা সুর,
যেন সরগম কখনও আমার হয়নি সাধা
চিত্রকল্প পাথরের ভাঙা মূর্তির মতো
ঘর কুয়াশায় কেবলি ফোঁপায় হাওয়ার স্বরে।

এরকম ঘটে, দেখি চিরচেনা গলিটার মোড়ে
আবর্জনার টিলাকে ছুঁয়েছে নীলিমা-চেরা
রঙধনু আর হাড়ের বাগানে পথ ভুলে ঢোকে
পঙ্গু হরিণ। অন্ধ রাজার ভাঙা বেহালা।

ছেঁড়া কাঁথাটায় আশ্রয় খোঁজে রাত তিনটের
নিম উর্বশী, বেহেড মাতাল মধ্যরাতে
নিজের বমিকে মণিরত্নের ঝলক ঠাউরে
উলঙ্গ পথে পড়ে থাকে একা অনাশ্রয়ে।

নিঃসর্গ আজ প্রলাপ বকছে,; ইঁদুরে ছুঁচোয়
ভরেছে শহর, গ্রাম ডুবে যায় বানের ক্রোধে।
ঘোর উন্মাদ রাজার মতন হাসে অবিরত
অত্যাচারের সেয়ানা, দাঁতাল অস্ত্রগুলো।

এসব দৃশ্যাবলির আড়ালে যেসব দৃশ্য
স্থাপত্য হয়ে করছে বিরাজ ইতস্তত,
তাদের কিছুটা বাক্‌বিভূতির ছোঁওয়া দেবো বলে
ভুরুতে চন্দ্রকলা নিয়ে জাগি দীর্ঘরাত।

কিন্তু আমার ব্যর্থতা শুধু শাদা কাগজের
খাঁ-খাঁ বুক জুড়ে বারবার জোরে বসায় নখ।
অন্ধ পাখির সঙ্গে এখন বসে আছি ঘরে
বাক্য খরায়; নগ্ন, তোতলা দেবতা যেন।

 বার্ধক্যে জসীমউদ্দীন

গলায় জড়ানো তাঁর শাপলা রঙের মাফলার, কষ্ট পান
প্রায়শই বাতে, কফ নিত্যসঙ্গী, কখনো হাঁপান
সিঁড়ি ভেঙে। এ কেমন একাকিত্ব এলো ব্যেপে
অস্তিত্বের উড়ানির চরে? প্রহরে-প্রহরে শুধু দাগ মেপে
নানান ওষুধ খেয়ে ধুধু সময়ের খালে
লগি ঠেলা নক্ষত্রবিহীন এ গোধূলি কালে।

আপাতত কিছুতেই নেই মন, শিশু বৈকালী সাহিত্য সভা,
জয়নুলী চিত্রকলা, ইতল-বিতল, রক্তজবা,
দূর থেকে-আসা কবিয়াল, কিংবা বিশ্বের খবর-
কিছুই টানে না তাঁকে। মাঝে-মধ্যে নিষ্প্রদীপ দাদির কবর
ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে ছায়াবৃত মাঠ, খাল, বিল,
কবেকার বিশুদ্ধ কোকিল।
তাকান কখনও ভেজা চোখে
শিল্পিত শীতলপাটি শোভিত দেয়ালে। ঘরে ঢোকে
অকস্মাৎ চড়ুই দম্পতি, চঞ্চলতা
ছড়ায় ড্রইংরুমে। খয়েরি শালের খুঁট মেঝেতে গড়ায়, নীবরতা
হীরের মতন জ্বলে, একটি অনুপস্থিতি ঝুঁকে
থাকে তাঁর বিমর্ষ শিশিরময় বুকে।

কোথাও নিঝুম হ্রদে লাল পদ্ম ফুটে আছে আজ,
হঠাৎ ভাবেন তিনি। খ্যাতির আওয়াজ
অন্ধকারে খড়মের শব্দ যেন এবং জীবন
যুগপৎ অর্থময়, অর্থহীন, বেদেনীর শাড়ি মতন
ভাসমান গহীন গাঙের জলে। ঠোঁটে
বর্তমান, ভূত, ভবিষ্যৎ-সংকলিত হাসি ফোটে।

‘আমাকে নিও না তুমি’, কবিতা আবৃত্তি করবার
ধরনে বলেন যাকে, তার
হাত জানালার গ্রিলে, হাতে কালো পাখি ডেকে যায়
শব্দহীন অবিরত। আদিগন্ত ঘন কুয়াশায়
শূন্য নাও ভাসে,
চেয়ার অর্পিত শ্লথ হাতে অস্তরাগ নেমে আসে।
করোটিতে ছিলো তাঁর কী ব্যাপক চর-থরথর
কাইজার চিত্রনাট্য, গাথার ছন্দের মতো সোনার গতর
গ্রাম্য যুবতীর, মাছলোভী মাছরাঙা, সারিগান।
স্বপ্ন-কণা-ধান
ঝরেছে করোটি জুড়ে, ডানা-অলা বাইসাইকেলে
চেপে কোন্‌ শাশ্বতের বনে গেলেন পেছনে ফেলে
সব কিছু? তাঁর সে চাকার কিছু নাক্ষত্রিক ধূলো
কেমন রাঙিয়ে দেয় আমার চোখের পাতা আর চুলগুলো।

 বিছানা

গৃহকোণে খাটের ওপর সাবলীল শুয়ে থাকে
আমার বিছানা সারাক্ষণ। যদি কেউ ভালো করে
চোখ রাখে বিছানার ওপর, তাহলে শহজেই
নজরে পড়বে তার বাদামি চাদর, ফুল-তোলা;
চারটি বালিশ বেশ নরম এবং ঝকঝকে।
মশারি খাটানো হয় রাত্রিবেলা, পায়ের নিকট
শীতকালে নিভৃতে গোটানো থাকে লেপ। বেড়ালের
সঙ্গ ছাড়া বিছানার নেই কোনো প্রকাশ্য বাহার।

আমার গৃহিণী রোজ বিছানার পরিচর্যা করে
খুশি হন। কখনও চড়ই বিছানায় খড়কুটো
ফেললে তিনি ছুটে এসে সরিয়ে ফেলেন আবর্জনা,
মৃদু গালমন্দ দেন পাখিদের। শয্যা রচনায়
আমার কৃতিত্ব নেই একরত্তি। শুধু আমি কিছু
প্রতীক এবং চিত্রকল্পে সাজাই বিছানাটিকে।

ভাড়াটে

পুরনো ভাড়াটে চলে গেলে কোনো বাসা কোনোদিন
খালি পড়ে থাকে না এখন।
পুনরায় ‘বাড়িভাড়া দেওয়া হইবে’ ফলকটি
বসতে না বসতেই সরে যায়। অন্ধকার
ঘরে আলো জ্বলে, বারান্দায় হেঁটে যায় কেউ কেউ,
জানালায় পর্দা লাগে, শিশুর আনন্দধ্বনি বাজে
মাঝে-মাঝে; ক্যাসেট প্লেয়ারে
রবীন্দ্রনাথের চিরকালীন গহন ব্যাকুলতা।

এখানে সিঁড়িতে আগেকার কেউ যে-কথা বলেছে
প্রায় তারই প্রতিধ্বনি এখন আরেক
কণ্ঠে জাগে। অনেক পুরনো সিন্দুকের ডালা-খোলা
গন্ধময় স্মৃতি ঘোরে আনাচে কানাচে। কার হাসি
সোনালি ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে হেমন্ত-বিকেলে?
এখন যে ভায়োলেট-রঙ
শাড়ি পরে সাজাচ্ছে চায়ের সরঞ্জাম;
তার? নাকি আগেকার কারো?

পুরনো দেয়ালে কিছু দাগ জমা হয়, সাঁঝবাতি
জ্বালায় না কেউ;
অন্দরে বেদনা শুয়ে আছে সাবলীল ঘরে-ফেরা
নাবিকের মতো, বয়ে যায় খাওয়ার সময়, তবু
টেবিলে আসে না কেউ। ভোরে
দরজার কাছে এসেছিলো ট্রাক, একটি কি দুটি কাক
ছাদের কার্ণিশে উঠেছিলো ডেকে। কোথায় যে গেলো
ওরা লটবহর-সমেত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি রেখে?

মানুষের মতো

ইদানীং মানুষের মতো কিছু বাঁদর দেখেছি,
অবিকল বাঁদরের মতো কিছু বিহ্বল মানুষ।
বাহিরকে করে ঘর ওরা আর ঘরকে বাহির;
রাজপথে, ফুটপাতে, বাস টার্মিনালে, ঘাসময়
পার্কে আর সিনেমায় জমকালো বাঁদরের ভিড়
দেখে করতালি দিতে সাধ জাগে। ইচ্ছে হয় ডেকে
সবাইকে বাতাসা খাইয়ে দিই শান্ত গোধূলিতে
বাঁদরের চেয়েও অধিক বাঁদরামি দেখে আজ।

কিছু-কিছু অতিশয় প্রকৃষ্ট বাঁদর অন্তরালে
সূক্ষ্ম কাজ করে চলে অবিরত, ঢালে লম্বা কানে
নানান ঘোরালে কথা, খাল কেটে আনে কুমিরের
বংশধর, কোনো বাঁদর সাজানো মঞ্চ থেকে
মঞ্চান্তরে অপরূপ ভেংচি কাটে, লাঙুলের শোভা
দেখিয়ে বেড়ায় আর কতিপয় ব্যথিত বাঁদর
বিচ্ছেদের পদ্য লেখে এবং তুখোড় বাঁদরেরা
কলম বাগিয়ে ইস্‌ বানায় থীসিস মজাদার

 লেখার কাগজ

লেখার কাগজ ক্রমে ক্রয় ক্ষমতার সীমা থেকে
খুব দূরে সরে যাচ্ছে; অথচ আমার রোজই চাই
কিছু শাদা কাগজ, কেননা আমি, বলা যায়, প্রায়
প্রত্যহ কিছু-না কিছু লিখি। উপরন্তু ভালো কাগজের
প্রতি, মানে সুশোভন কাগজের প্রতি বড় বেশি
আকর্ষণ বোধ করি। কাগজ কিনতে গিয়ে আমি
বেশ কিছু সময় কাটাই, উল্টে-পাল্টে বারবার
দেখি রাইটিং প্যাড, সযত্নে পরখ করে নিই।

আমাকে ছিটেল বলে ব্যঙ্গ করা অত্যন্ত সহজ;
কিন্তু আমি যা বলি স্পষ্টই বলি; সত্যি, ঢাক-ঢাক
গুড়-গুড় আমার স্বভাবে নেই। যদি কোনোদিন
কাগজ বাজার থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়,
নিরুপায় আমি অনন্তকে শ্লথগতি কচ্ছপের
ছায়া ভেবে লিখে যাবো ধূলো আর গাছের পাতায়।

 শুভবাদী রোদ চুমো খেয়েছিলো

শুভবাদী রোদ চুমো খাচ্ছে লতাগুল্মে ঢাকা এই
রেস্তোরাঁকে, প্রাণে
পুরনো বৈভব নিয়ে বসে আছি, ছোট
টেবিলের ওপারে তরুণী, একা গায়ে
টোমাটো রঙের পুলওভারের প্রগাঢ় মমতা।
সমুখে স্যালাড, বিফ স্টেক,
সোনালি সুরার পাত্রে ঠোঁট।
কখনও দেখছি তাকে বিদেশী সংকোচে, কখনও বা নিসর্গকে।

একটু একটু নিচ্ছি স্বাদ
বাদামি রুটির,
মুখের ভেতর গলে টাটকা মাখন;
উড়ন্ত বেগনি পোকা তার সোনালি আঙুলের বসে
খেলা করে, কিছুক্ষণ ডগালগ্ন থাকে, যেন
হয়েছে মাতাল তন্বী ত্বকের উত্তাপে।
-এ কিসের ছায়া মাঝে-মধ্যে দুলে ওঠে।
মৃদু প্রবাধন-ধন্য মুখে?
পরা বাক্‌ পাক খায় বারবার মনের ভেতর। মনে হয়
এরকম বসে-থাকা, ত্র্যানিমার মুখোমুখি, বহু
শতাব্দী আগেও ছিল। ওর লাল বুটে
ঘাসের সবুজ স্মৃতি লুটোপুটি খায়, যাত্রী নিয়ে দূরে বাস চলে যায়।

একদা এখানে এই পুরনো মহলে আসতেন পুশকিন,
বাতাসের গুঞ্জরণময় ছায়াবীথি পেতো কবি দৃষ্টি; তিনি
হেঁটে যেতে-যেতে
হেমন্ত বিকেলে
চকিতে পেতেন খুঁজে কবিতার পংক্তিমালা
চৈতন্যের ষড়জে নিখাদে।
গাছের শিকড়গুলি সর্পিল আবেগে
তাকেই জড়াতে চায় রক্তে যার আফ্রিকার গহন ঝংকার।
বেলা বাড়ে, চুল ওড়ে মৃদু;
অচিহ্নিত বেদনায় ছায়া জমে মনে, রেনকোট নিই
কাঠের চাকতি জমা দিয়ে
প্রৌঢ় সজ্জনের কাছে। কারুকে বিদায়
না বলে ট্যাক্সিতে উঠে, ফিরে যাই মাইল-মাইল
দূরে নক্ষত্রের নীড়-ছোঁওয়া হোটেলের কামরায়।
কালো কফি খেতে খেতে ভাবি
উড়ন্ত বেগনি পোকা, রোদ-লাগা গোলাপি আঙুল,
কাঠের রেলিঙে ঝুঁকে-থাকা ডগার লতার কথা।
ক্রীড়াপরায়ণ পোকাটির প্রতি তার
প্রসন্ন দৃষ্টির মায়া বিলিয়ে কী কথা
ভাবছিল সেই মেয়ে? কারো সঙ্গে অভিমান করে
এসেছে একলা চলে? নাকি যে আসবে বলে কথা
দিয়েছিল, সে মেট্রোর টিকিট কাটেনি ভুলক্রমে?

ঝর্নার পানির মতো সময় গড়িয়ে যাবে, ক্রমাগত ঘোলা
হবে জল দশ দিকে, রাশি রাশি মাছ
কোথায় হারিয়ে যাবে ব্যাপক দূষণে।
বিস্মৃতির ধূসর ডাস্টার নির্বিকার
নিমেষে ফেলবে মুছে অনেক কিছুই। ভুলব না
সেই কবে দূর দেশে শুভবাদী রোদ
চুমো খেয়েছিল
লতাগুল্ম ঢাকা রেস্তোরাঁকে, একটি বেগনি পোকা
খেলা করেছিল সরু গোলাপি আঙুলে।
লাল বুটলগ্ন কচি ঘাসের ডগাকে ভুলব না কোনোদিন।

 শেফার্স

কত দীর্ঘকাল আমি শেফার্স করি না ব্যবহার।
ফলত হাতের লেখা, মনে হয়, ক্রমশ খারাপ
হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমার লেখার সুচিহ্নিত
চরিত্র বদলে গেছে, বলা যায়। এরকম ক্রীড়া-
পরায়ণ ধারণা আমার মনে সীলমোহরের
স্পষ্ট ছাপ কেবলি বসাতে চায়। হয়তো এর কোনো
মানে নেই; সংস্কার পাখির মতো ডেকে ওঠে লাল
রক্তের ভিতরে। বলপেনে ভাষাচর্চা কী রকম
ফুলচন্দনের ঘাণপায়ী হতে পারে, জেনে গেছি।
ধরেছি ঘরের ভাষা সুদূর প্রবাসে কাগজের
ব্যাপক শাদায়, পাই নিদ্রিত বনের বিষণ্নতা।
প্রকৃত রন্ধনশিল্পী যিনি তার কাছে কড়াইয়ের
আকার প্রকার স্রেফ অবান্তর। কোনো কোনোদিন
মনে হয়, একটি শেফার্স পেলে বড় ভালো হতো।

 সাবান

পাড়ার দোকান থেকে একটি সাবান কিনে এনে
রেখে দিলো নিজের দেরাজে। মোড়কের ভাঁজ খুলে
প্রায়শই ঘ্রাণ নেয়, আবার গচ্ছিত রাখে স্মিত
হেসে যথাস্থানে, সেই ঘ্রাণ তাকে ন্যালক্ষ্যাপা করে
বারংবার, নিয়ে যায় সময়ের অন্য পারে। কার
গায়ে একরম ঘ্রাণ ছিলো? গোসলের পর খোলা,
ঈষৎ ফাঁপানো চুলে যে আসতো নিঃশব্দে দ্বিপ্রহরে,
তার গায়ে? কখনও-সখনও সোনারুর মতো ঢঙে
চোখ রাখে সাবানের প্রতি, টেবিলে স্থাপিত হলে।
কখনও সে বানাবে না, তবু বস্তুটির খুঁটিনাটি
প্রস্তুতিপর্বের কথা ভাবে, আমদানি রপ্তানির
হিসেবে-নিকেশ করে। কেঠো দেরাজের ভেতরেও
সুঘ্রাণ; করে না এস্তেমাল তাকে, পাছে এ সাবান
পানির সংসর্গে জীবনের মতো দ্রুত ক্ষয়ে যায়।

 স্মৃতিতে ধারণযোগ্য কিছু নয়

ন্যাকামোর শিরশ্ছেদ করেছি অনেক আগে আমি,
গলা টিপে মেরেছি কৈশোরে
গোঁড়ামির একচক্ষু দানোটাকে শিউলিতলায়
পাখি আর হাওয়া
আর নীলকমল ও লালকমলের চন্দ্রালোক চমকিত
গল্প সাক্ষী রেখে। ভাঙো, যত
ব্যবহৃত ছাঁচ ভেঙে ফেলো বলে লোক জড়ো করি
চারপাশে, অথচ নিজেই
আরেক ছাঁচের দিকে এগিয়ে চলেছি সবান্ধব।
মধ্যবিত্ত মেজাজে চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে দেখি
আশির দশক মাদী ঘোড়ার মতন পাছা দোলাতে দোলাতে
চলে যাচ্ছে, জরাগ্রস্ত বারান্দায় দাঁড়বন্দি, একা
তোতাপাখি বলে আমাদের
প্রভুর বছরে কত খড়কুটো, রক্তিচিহ্ন মিশে আছে; বিদায় বিদায়।

পুত্রদের তেতে-ওঠা মতবাদঝলসিত কথা শুনে ভয়ে
গলা কাঠ হয়ে আসে, কন্যাদের পতিগৃহে যাত্রা
চোখে তুলে নিয়ে
আমার ভেতর থেকে একজন ব্যথিত পুরুষ
বেরিয়ে সন্ধ্যায় ঘাটে গিয়ে
পানিতে নিজের ছায়া দেখে
ভীষণ চমকে ওঠে। পরিত্রাণ নেই ভেবে মগজের কোষে
কিছু মেঘ ভরে নিয়ে ফিরে আসে স্বগৃহে আবার।
কিছুটা বিভ্রান্ত বটে ইদানীং তবু চোখ কান
খোলা রাখি, সমাজতান্ত্রিক প্রীতি নিয়ে ধান্দাবাজি
ঢের হলো আশপাশে, ধর্মযাজকের সত্তায় প্রবল শান
দেয় খর রাজনীতি। বিপ্লব ফ্যাশন কোনো-কোনো
গুলজার মহলে এবং
ধোপার কুকুর যারা, তাদের নিকট ভীতিটাই
মৌল অতিশয়; ছাগলের ছাল-ছাড়ানো কসাই নিয়মিত
গায় ওহো সাঁই-সাঁই গণতন্ত্রগীতি।
অকস্মাৎ ব্রোঞ্জের চওড়া প্লেট থেকে
বেমক্কা বেরিয়ে পড়ে সুশোভিত ড্রইংরুমের
গালিচায় তিন লাফ দিয়ে
রাঙা চোখ তুলে বিপ্লবের নান্দনিক
ব্যাখ্যা দাবি করে
মহেঞ্জোদারোর ষাঁড় আর
রাবীন্দ্রিক সন্ধ্যার উতল মেঘমালা
ফুঁড়ে চলে যায় স্তব্ধ পূর্ণিমায় পুলিশের গাড়ি।

হায় যৌবনেই বামপন্থা বানপস্থে গেলো বুঝি
গায়ে অস্তরাগ মেখে। নাকি
মাঝে-মাঝে রাগী সজারুর মতো কাঁটা খাড়া করে
ছোটে দিগ্ধিদিক? আমি ভীষণ অস্থির
কম্পাসের মতো আচরণে
জীবনযাপন করি, পূর্ব-পরিচিতা কারো মুখ
ভেবে ভেবে স্ত্রীকে নিয়ে শুতে যাই; আতশী হৃদয়ে
স্বপ্নের কোলাজ ফোটে, আঁধারে তাকাই
কিছু আবিষ্কারের ব্যাকুল প্রতীক্ষায়।
কখনও-কখনও
লোকালয় আর উৎসবের স্তব করতে গিয়ে
কবিত্বের দিব্যতায় গুমসান প্রান্তর এবং
ধ্বংসস্তূপবিষয়ক স্তোত্র লিখে ফেলি।
অথচ আমার চৈতন্যের
খোলা পথে বুগেনভিলিয়া ফুটে থাকে থরে-থরে,
বাজে আনন্দিত রাগমালা।
কোনো-কোনো ঋতুতে এবং অমাবস্যা নেমে এলে
হরিণ লুকিয়ে রাখে মুখ লতাগুল্মে, কাটে তার
কাল, চেষ্টাহীন; শিকারির
পদশব্দে, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে
নিয়তির ছায়া মিশে থাকে; প্রতীক্ষায় ত্রিকাল দোদুল্যমান।

ফাঁসির মঞ্চের আসামির মতো চাঁদ ঝুলে আছে
সেই কবে থেকে,
বেশ্যালয়ে একদা নতুন মুখগুলি
ক্রমশ পুরনো হচ্ছে এবং রবীন্দ্রনাথ একা
বড় একা আলখাল্লা দুলিয়ে নিশীথে
চলেছেন হেঁটে অ-বনেদী গলি দিয়ে নেয়ামত
দর্জির ঈষৎ বাঁকা উঠোন পেরিয়ে।
এদিকে দাঁতাল বর্বরেরা ঢুকে পড়ে মায়াবনে।
চাদ্দিকে খেমটা নাচ, হল্লাগুল্লা, অবিরত
কাজিয়া ফ্যাসাদ বাড়ে, হামেশাই হয় লোকক্ষয়
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, মহাপুরুষের বাণী শত-
শত ক্যানভাসারের কণ্ঠনালী বেয়ে নামে; জয়-
পরাজয় কাদা লেপে দেয় মৃত সৈনিকের হাতে,
স্থির চোখে, ছেঁড়া টিউনিকে। নানাদেশে রাজনীতি-
পরায়ণ ধীমানেরা ধুধু দৃষ্টি ও স্খলিত দাঁতে
কাটাচ্ছেন কাল কারাগারে, কোনোখানে নেই স্থিতি।

টিনোসোরাসেরা মাটি ফুঁড়ে দ্রুত বেরুচ্ছে আবার
পারিপার্শ্বিকের সৌন্দর্যকে তছনছ করে, শুরু হবে
সংহারের পালা, হয়ে যাবে নিমেষে কাবার
বিভিন্ন গর্বিত জাতি, পারবে না বিপুল অগুরু
ঢাকতে লাশের গন্ধ। কূলে-উপকূলে দেশান্তরি
মানুষের ভিড় বাড়ে ক্রমাগত। এত কোলাহল,
তবু কেন এমন নির্জন বাসভূমি? ভ্রষ্ট তরী
কোথায় যে নিয়ে যাবে! চতুর্দিকে খলখলে জল।

স্বপ্নাদ্য সিংহের মতো হেঁটে যাই বিনষ্ট প্রান্তরে
হেঁটে যাই স্বপ্নভস্মময় চোখে উদ্দেশবিহীন।
কুৎসিত মুখোশ আঁটা কতিপয় লোক ঘরে-ঘরে
ছড়ায় আগুন, ঘৃণা-বীজ; জানে নাকো চিরদিন
প্রেমই শুধু কীর্তনের অভীষ্ট বিষয়। যে ব্যথিত
কবি ছিলো এ শহরে, মাথায় ছিলো না শিরস্তাণ
তার; ভুলে যাই রণরোল, জয়ীধ্বনি, অভিযান-
স্মৃতিতে ধারণযোগ্য কিছু নয় কবিতা ব্যতীত।

 হোমারের স্বপ্নময় হাত

এখন আমার আশে-পাশে কেউ নেই। ঘর অন্ধকার নয়, একটা
বাতি জ্বলছে। অনুগ্র আলো যেন জাল; আমি স্বেচ্ছা-
বন্দি হয়ে আছি সেই জালে। কেউ নেই আমার পাশে, মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে নেই কাউ। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না এই
মুহূর্তে। মুহূর্তেগুলো থেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরছে
আমার ওপর। সময় বয়ে চলেছে একটানা, আমার আয়ুর পুঁজি
ক্ষইয়ে দিয়ে। এখন কোনো বইয়ের পাতায় চোখ বুলোতে
পর্যন্ত ইচ্ছে করছে না, অথচ বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ
অত্যন্ত তীব্র। প্রহরে-প্রহরে বই থেকে আমি শোষণ করে নিই
আনন্দ, সমৃদ্ধ হয়ে উঠি দিনের পর দিন।
এখন আমার আশে-পাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না এখন যদি
খাতা খুলে লিখতে শুরু করি, কেউ ঢুকে পড়বে না আমার
ঘরে, কিংবা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখবে না কি আমি
লিখছি। কোনো উঁকি ঝুঁকি মারবে না কেউ। চারপাশে এখন
নিভাঁজ নিঃসঙ্গতা। আমার একাকীত্ব জলচর প্রাণীর মতো
আলো পোহাচ্ছে। একটু আগে আমার বিচ্ছেদ ঘটেছে
স্বপ্নের সঙ্গে, হয়তো এজন্যেই একটা শূন্যতাবোধ
আপাতত দখল করে নিয়েছে আমাকে। স্বপ্ন ভেঙে গেলে
খুব একলা লাগে। কী স্বপ্ন দেখছিলাম আমি? ঘুম
যখন শরীরকে ত্যাগ করে যায়, তখন কোনো কোনো স্বপ্নের
কথা খুব স্পষ্ট মনে থাকে, যেন চোখ বন্ধ করলেই সেই
স্বপ্ন আবার দেখতে পাবো। এমন কিছু স্বপ্ন দেখি যা
স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে যায় অন্তহীন অস্পষ্টতায়।
আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। যারা স্বপ্নকে অর্থহীন
বলে উড়িয়ে দেয়, আমি তাদের কেউ নই। আমি স্বপ্নকে
অর্থময় মনে করি। স্বপ্ন বিশ্লেষণে অপটু বলেই সকল
স্বপ্ন আমাদের কাছে অর্থহীন। কী স্বপ্ন দেখছিলাম
আমি? সব কিছু মনে নেই, আবছা হয়ে গেছে অনেক
কিছুই। বহু পথ হেঁটে আমি প্রবেশ করেছি একটা
পুরনো নিঝুম বাড়িতে। ঠিক প্রবেশ করেছি, বলা
যাবে না, বাড়িটার বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ছি, অনেকক্ষণ
থেকে; কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ আসছে না।
তবে কি কোনো বাসিন্দা নেই এই নিঝুম বাড়িতে?
দরজা খুললো না দেখে সেখান থেকে অন্য দিকে রওয়ানা
হলাম। তারপর নিজেকে দেখতে পেলাম জনশূন্য,
ধুধু প্রান্তরে। জমি ফেটে চৌচির। কোথাও এক ডগা ঘাস
নেই, এক ফোঁটা পানি নেই। শুধু ঝিঁঝি পোকার
ডাকের মতো একটা শব্দ উঠে আসছে মাটি থেকে। হঠাৎ
যেন মাটি ফুঁড়ে বেরুলো একটা কালো মানুষ। মানুষ
না বলে কংকাল বলাই ভালো। লোকটা মাটির ওপর
বসে পড়লো এবং কোত্থেকে যেন একটা শিশু এসে বসলো ওর
কোল জুড়ে। হাড়-জিরজিরে শিশুটির দু’চোখে জীবনের
দ্রুত পলায়নের দৃশ্য। সেই লোকটা আর শিশুটিকে
দেখে মনে হলো যেন মৃত্যু শুয়ে আছে মৃত্যুর কোলে।
আর কী কী দেখেছিলাম। মনে পড়ছে না।
কিছুতেই মনে পড়ছে না।
স্বপ্নটির কী অর্থ দাঁড়ায় আমি জানি না। স্বপ্ন বিশ্লেষণের
ক্ষমতা থেকে আমি বঞ্চিত। এই স্বপ্ন কেন দেখলাম?
অনেকদিন থেকে একটা বাড়ি খুঁজছি বলেই কি সেই
পুরনো, নিঝুম বাড়িটা দেখা দিলো আমার স্বপ্নে, যে বাড়ি
আমি আগে কখনও দেখিনি? সংবাদপত্রে দেখা
ইথিওপিয়ার অনাহারী মানুষের ফটোগ্রাফই আবার আমার
স্বপ্নে হানা দিলো নতুন করে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার
জানা নেই। জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারব না। এই
স্বপ্নের অন্তরালে অন্য কোনো গূঢ়ার্থ কি নিহিত?
এই স্বপ্ন আমাকে একলা করে দিয়েছে। এখন আমার আশে-
পাশে কেউ নেই। স্বপ্ন দেখতে আমার ভালো লাগে।
ঘুমের মরুভূমিতে স্বপ্ন তো মরূদ্যান। হারিয়ে-যাওয়া কিছু
চিত্রের খোঁজে স্বপ্ন দ্যাখে আমার কণ্ঠনালী, নাভিমূল,
বাহু, নখ, মাথার চুল। কখনও-কখনও স্বপ্ন আর বাস্তবের
মধ্যে আমি কোনো ভেদচিহ্ন খুঁজে পাই না। কুলুঙ্গিতে
তুলে রাখা কবেকার সবুজাভ দোয়াত ফেরেশতা হয়ে
আমার সঙ্গে কথা বলে যখন, তখন বুঝতে পারি না আমি স্বপ্নের
আচ্ছন্নতায় মজে আছি নাকি বাস্তবের চবুতরায় দাঁড়িয়ে
কবুতর ওড়াচ্ছি একের পর এক।
এখন আমার মাথার ভেতর সুকণ্ঠ কোনো পাখির মতো গান
গাইছে এই শহর। লোকগীতির এই শহর, ডিসকো
নাচের শহর, দোয়া-দরুদ আর মোনাজাতের শহর, ভিখারির শহর,
বেশ্যা দালালের শহর, রাশি-রাশি মিথ্যা বাগানের
শহর, ক্রুশবিদ্ধ সত্যের শহর, বিক্ষোভ মিছিলের শহর,
স্লোগান-ঝংকৃত শহর, কবির মৌচাকের মতো শহর,
শেষ রাত্রির বাইজীর মতো এই শহর। এই মুহূর্তে আমি
যা স্পর্শ করবো তা উন্মোচিত হবে নতুন তাৎপর্য নিয়ে।
গাছের বাকল হবে তরুণীর ত্বক, পথের ধূলো রূপান্তরিত
হবে রাজা সোলেমানের খনির মর্ণিরতা, ভিখারিণীর
কানি হবে সালোমের লাস্যময়ী পট্রবস্ত্র। এখন আমি নিজেকে
স্বর্শ করলে আমার ভেতর থেকে শত-শত ময়ূর
বেরিয়ে এসে পেখম ছড়িয়ে দেবে উঠোন জুড়ে। যদি এখন
আমি খাতার শাদা পাতা স্পর্শ করি, তাহলে সেখানে
বইবে অলকানন্দা, গড়ে উঠবে আর্ডেনের বন, লতাগুল্মে
ঝলসে উঠবে হোমারের স্বপ্নময় হাত।

Exit mobile version