- বইয়ের নামঃ হোমারের স্বপ্নময় হাত
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আইসক্রিম
হঠাৎ পৃথিবীটাকে কেমন আলাদা মনে হয়
বালকের। ভেণ্ডারের কাছ থেকে তৃষ্ণার্ত দুপুরে
কিনেছে আইসক্রিম ছোট মাটির কলস ভেঙে
জমানো পয়সা বের করে। পৌরপথে হেঁটে-হেঁটে
বালক আইসক্রিম করছে লেহন; রূপকথা
থেকে এক রাজা এসেছেন এ শহরে, মনে হলো
তার; কিন্তু কী বিস্ময়, সে ব্যতীত কেউ তাকে ঠিক
লক্ষ করছে না, তাঁর পোশাকের বাহার ভীষণ
ব্যর্থ সাধারণ পোশাকের ভিড়ে। রাজার নিকটে
যাবে কি যাবে না ভেবে বালক আইসক্রিম হাতে
ফুটপাতে উঠে পড়ে, চলে আসে আবার গলির মোড়ে, একা।
রাজার আয়ত চোখ মনে পড়ে তার; রৌদ্র-লাগা
গোলাপি আইসক্রিম ক্রমশ গলতে থাকে তার
মুখের ভেতর, জিভ কেমন বিবশ হয়ে আসে।
আমার অজ্ঞতা নিয়ে
এখন মাঝরাস্তায় আমি; শ্বাসরোধকারী নিঃসঙ্গতা
একটা মাকড়সার মতো হাঁটছে
আমার চোখে, গালে, কণ্ঠনালীতে,
বুকে, ঊরুতে আর
অন্ধকারের জোয়ার খলখলিয়ে উঠছে আমার চারপাশে।
অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। মনে হয়,
এখানে কোথাও তুমি আছো, ডাকলেই
সাড়া দেবে লহমায়। তলোয়ার মাছের মতো
তোমার কণ্ঠস্বর
ঝলসে উঠবে অন্ধকারে।
কণ্ঠে সমস্ত নির্ভরতা পুরে তোমাকে ডাকলাম,
শুধু ভেসে এলো আমার নিজের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি।
অন্ধকারে পথ হাতড়ে চলেছি, যদি হঠাৎ
তোমার দেখা পেয়ে যাই।
ভেবেছি, আমার দিকে প্রসারিত হবে
অলৌকিক বৃক্ষশাখার মতো তোমার হাত।
কতকাল প্রতীক্ষাকাতর আমি
তোমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্যে, কত পাথর আ কাঁটাময়
পথ পেরিয়েছি তোমাকে একটিবার
দেখবো বলে। অথচ আমার সকল প্রতীক্ষা আর
ব্যাকুলতাকে বারংবার উপহাস করেছে
তোমার নীরব অনুপস্থিতি।
অন্ধকারে আমি দু’হাতে আঁকড়ে রেখেছি
একটি আয়না যাতে দেখতে পাই
তোমার মুখের ছায়া। কিন্তু আয়নায় পড়ে না
কোনো ছায়া, লাগে না নিঃশ্বাসের দাগ।
এখানে কোথাও না কোথাও তুমি আছো,
এই বিশ্বাস কখনও-সখনও
আমাকে বাঁচায়
অক্টোপাশা-বিভ্রান্তি থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়ে
আমি কী করবো যা সমর্থিত নয়
জ্ঞানের জ্যোতিশ্চক্রে?
জ্ঞান আমার উদ্ধার, তারই অন্বেষণে
উজিয়ে চলি
স্বৈরিণীর মতো অন্ধকার। এজন্যে যদি তোমাকে খোঁজার সাধ
মুছে যায় কোনো রাগী পাখার ঝাপটে,
আমি প্রতিবাদহীন পা চালিয়ে যাবো
জ্ঞানের বলয়ে আমার অজ্ঞতা নিয়ে।
ইদানীং বঙ্গীয় শব্দকোষ
স্বীকার করাই ভালো, কিছুকাল থেকে
আমরা শব্দের ভুল প্রয়োগে ক্রমশ হচ্ছি দড়।
যেখানে আকাট মূর্খ শব্দটি মানায় চমৎকার,
সেখানে পণ্ডিত ব্যবহার করে আহ্লাদে আটখানা
হয়ে যাই। শক্রস্থলে বন্ধু শব্দটিকে
হরহামেশাই
জিভের ডাগায়
নাচাই এবং যারা অতি খর্বকায়
তাদের সপক্ষে দীর্ঘকায় বিশ্লেষণ
সাজিয়ে নরক করি গুলজার আর
মানুষের বদলে সম্প্রতি
ওরাংওটাং
বসিয়ে লাফিয়ে উঠি তিন হাত, খাই ডিগাবাজি
করি সহবত বনচারীদের সঙ্গে দিনরাত।
বস্তুত স্বর্গত হরিচরণের বিখ্যাত নিষ্ঠার প্রতি বুড়ো
আঙুল দেখিয়ে দিব্যি শেয়াল-শকুন অধ্যুষিত
ভাগাড়কে স্বর্গোদ্যান বলি
সটান দাঁড়িয়ে চৌরাস্তায়,
এবং শব্দের ভুল প্রয়োগ-মড়কে নিমেষেই
যুদ্ধবন্দি বিনিময় হয়ে যায় মন দেয়া-নেয়া।
এ অতি সামান্য কথা
এ অতি সামান্য কথা, আপনার নিশ্চয় জানেন-
দাঁত ক্ষয়ে গেলে বাঘ হয়ে যায় কিছুটা দুর্বল,
বনের পশুরা তাকে ফাঁকি দিয়ে নাকের তলায়
তার দিব্যি করে আনাগোনা, তাই সে প্রায়শ
মেটাতে দাঁতের সুখ, সুতীব্র জঠরজ্বালা দেয়
হানা শান্ত গেরস্ত পাড়ায়। অবশেষে দশদিকে
তুখোড় মানুষখেকো বলে খ্যাতি রটে তার। যারা
কবিতা লিখতে গিয়ে কাব্যলক্ষ্মীর ছাউনি থেকে
নির্বাসিত হয়, তারা যদি বাগিয়ে কলম নিত্য
শজারুর মতো রেগে ঝোপঝাড় তছনছ করে,
রাশি-রাশি পুঁথি ঘেঁটে, তথ্যের টিলায় হাঁটু গেড়ে
সমালোচনায় মাতে, কাব্যমীমাংসার ভার নেয়
নিজ হাতে তুলে, তবে ওরা সোনালি পদবী পায়
একাডেমী থেকে, আর কবি থাকে শত হস্ত দূরে।
এই রক্তধারা যায়
যেদিকে তাকাই শুধু ধ্বংস্তূপ দেখি আজকাল।
এ আমার দৃষ্টিভ্রম নাকি
বাস্তবিকই চতুর্দিকে পরাজিত সৈনিকের মতো
পড়ে আছে? এখন এখানে যুবকেরা রাত্রিদিন চক্রাকারে
গাঁজা খায়, মধ্যরাতে কানামাছি খেলে
কখনও-সখনও, এলোকেশী যুবতীরা
নিয়ত বিলাপ করে। কতিপয় বেড়াল ছায়ার মতো ঘোরে
আশেপাশে, খাদ্যন্বেষী ইঁদুরেরা ব্যর্থ হয়ে ঢোকে
গর্তের ভেতর পুনরায়, জ্বরাগ্রস্ত মানুষের
সাধের যযাতি-স্বপ্ন চকিতে মিলায় প্রেতায়িত অস্তরাগে।
এখন এখানে সূর্যাস্তের রঙ ছাড়া
অন্য কোনো রঙ নেই,
এখন এখানে শোণিতের গন্ধ ছাড়া
এখানে সাপের স্পর্শ ছাড়া আপাতত
অন্য কোনো স্পর্শ নেই,
এখন এখানে দৃষ্টিহীনতা ব্যতীত
অন্য কোনো দৃষ্টি নেই।
কাউকে দেখলে কাছে দূরে সরে যাই তাড়াতাড়ি
দৃষ্টিকটুভাবে,
কেননা বন্ধুর কাছে গিয়ে দেখেছি সে বন্ধুতার
মুখোশের আড়ালে শক্রর ভয়াবহ মুখচ্ছদ
নিয়ে বসে আছে
মাছির প্রভুর মতো। কাউকে করি স্পর্শ, পাছে
সে নিমেষে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়;
আমার নিজেরই প্রতি সেই আর পূর্ণিমা-বিশ্বাস ইদানীং।
দিনের অন্তিম রোদ ধ্বংসস্তূপে ব্যাপক বসায়
নখ কামুকের মতো। অদূরে চলছে ভোজ শকুনের আর
শেয়ালের ডাক
মাঝে-মাঝে অভিশপ্ত স্তব্ধতাকে করে
চুরমার; স্মৃতি আবিষ্কার করে আমি
বেনামী অস্তিত্ব খুঁজি পূর্বপুরুষের। ভস্মরাশি থেকে উঠে
শূন্যতায় ভাসে শাদা পিরহান, দাদার খড়ম।
অদৃশ্য অক্ষর লিখে অন্ধকারে আসা-যাওয়া করি;
আমার নিঃসঙ্গতায় মর্মরিত হয়
দূর শতাব্দীর হাওয়া, বয় নূহের কালের ঢেউ।
ধ্বংসস্তূপে ফুল কুড়াবার জন্যে ঝুঁকতেই মনে পড়ে যায়,
বিশীর্ণ ইথিওপিয়া ক্রমশ মরছে অসহায়
দু’চোখ উল্টিয়ে। বর্তমান জীবন মৃত্যুর ভেদ লুপ্ত,
কর্কশ-বাঁশির তালে-তালে গলা ছেড়ে
আমাকে গাইতে হবে গান। সুর যত
ওঠে উচ্চগ্রামে, তত রক্ত ঝরে বুক থেকে; ধ্বংসস্তূপে গান
গাইলে নিশ্চিত বুকচেরা রক্ত ঝরাতেই হয়,
এই রক্তধারা যায় ছায়াপথে, নক্ষত্রের দিকে।