সাবান
পাড়ার দোকান থেকে একটি সাবান কিনে এনে
রেখে দিলো নিজের দেরাজে। মোড়কের ভাঁজ খুলে
প্রায়শই ঘ্রাণ নেয়, আবার গচ্ছিত রাখে স্মিত
হেসে যথাস্থানে, সেই ঘ্রাণ তাকে ন্যালক্ষ্যাপা করে
বারংবার, নিয়ে যায় সময়ের অন্য পারে। কার
গায়ে একরম ঘ্রাণ ছিলো? গোসলের পর খোলা,
ঈষৎ ফাঁপানো চুলে যে আসতো নিঃশব্দে দ্বিপ্রহরে,
তার গায়ে? কখনও-সখনও সোনারুর মতো ঢঙে
চোখ রাখে সাবানের প্রতি, টেবিলে স্থাপিত হলে।
কখনও সে বানাবে না, তবু বস্তুটির খুঁটিনাটি
প্রস্তুতিপর্বের কথা ভাবে, আমদানি রপ্তানির
হিসেবে-নিকেশ করে। কেঠো দেরাজের ভেতরেও
সুঘ্রাণ; করে না এস্তেমাল তাকে, পাছে এ সাবান
পানির সংসর্গে জীবনের মতো দ্রুত ক্ষয়ে যায়।
স্মৃতিতে ধারণযোগ্য কিছু নয়
ন্যাকামোর শিরশ্ছেদ করেছি অনেক আগে আমি,
গলা টিপে মেরেছি কৈশোরে
গোঁড়ামির একচক্ষু দানোটাকে শিউলিতলায়
পাখি আর হাওয়া
আর নীলকমল ও লালকমলের চন্দ্রালোক চমকিত
গল্প সাক্ষী রেখে। ভাঙো, যত
ব্যবহৃত ছাঁচ ভেঙে ফেলো বলে লোক জড়ো করি
চারপাশে, অথচ নিজেই
আরেক ছাঁচের দিকে এগিয়ে চলেছি সবান্ধব।
মধ্যবিত্ত মেজাজে চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে দেখি
আশির দশক মাদী ঘোড়ার মতন পাছা দোলাতে দোলাতে
চলে যাচ্ছে, জরাগ্রস্ত বারান্দায় দাঁড়বন্দি, একা
তোতাপাখি বলে আমাদের
প্রভুর বছরে কত খড়কুটো, রক্তিচিহ্ন মিশে আছে; বিদায় বিদায়।
পুত্রদের তেতে-ওঠা মতবাদঝলসিত কথা শুনে ভয়ে
গলা কাঠ হয়ে আসে, কন্যাদের পতিগৃহে যাত্রা
চোখে তুলে নিয়ে
আমার ভেতর থেকে একজন ব্যথিত পুরুষ
বেরিয়ে সন্ধ্যায় ঘাটে গিয়ে
পানিতে নিজের ছায়া দেখে
ভীষণ চমকে ওঠে। পরিত্রাণ নেই ভেবে মগজের কোষে
কিছু মেঘ ভরে নিয়ে ফিরে আসে স্বগৃহে আবার।
কিছুটা বিভ্রান্ত বটে ইদানীং তবু চোখ কান
খোলা রাখি, সমাজতান্ত্রিক প্রীতি নিয়ে ধান্দাবাজি
ঢের হলো আশপাশে, ধর্মযাজকের সত্তায় প্রবল শান
দেয় খর রাজনীতি। বিপ্লব ফ্যাশন কোনো-কোনো
গুলজার মহলে এবং
ধোপার কুকুর যারা, তাদের নিকট ভীতিটাই
মৌল অতিশয়; ছাগলের ছাল-ছাড়ানো কসাই নিয়মিত
গায় ওহো সাঁই-সাঁই গণতন্ত্রগীতি।
অকস্মাৎ ব্রোঞ্জের চওড়া প্লেট থেকে
বেমক্কা বেরিয়ে পড়ে সুশোভিত ড্রইংরুমের
গালিচায় তিন লাফ দিয়ে
রাঙা চোখ তুলে বিপ্লবের নান্দনিক
ব্যাখ্যা দাবি করে
মহেঞ্জোদারোর ষাঁড় আর
রাবীন্দ্রিক সন্ধ্যার উতল মেঘমালা
ফুঁড়ে চলে যায় স্তব্ধ পূর্ণিমায় পুলিশের গাড়ি।
হায় যৌবনেই বামপন্থা বানপস্থে গেলো বুঝি
গায়ে অস্তরাগ মেখে। নাকি
মাঝে-মাঝে রাগী সজারুর মতো কাঁটা খাড়া করে
ছোটে দিগ্ধিদিক? আমি ভীষণ অস্থির
কম্পাসের মতো আচরণে
জীবনযাপন করি, পূর্ব-পরিচিতা কারো মুখ
ভেবে ভেবে স্ত্রীকে নিয়ে শুতে যাই; আতশী হৃদয়ে
স্বপ্নের কোলাজ ফোটে, আঁধারে তাকাই
কিছু আবিষ্কারের ব্যাকুল প্রতীক্ষায়।
কখনও-কখনও
লোকালয় আর উৎসবের স্তব করতে গিয়ে
কবিত্বের দিব্যতায় গুমসান প্রান্তর এবং
ধ্বংসস্তূপবিষয়ক স্তোত্র লিখে ফেলি।
অথচ আমার চৈতন্যের
খোলা পথে বুগেনভিলিয়া ফুটে থাকে থরে-থরে,
বাজে আনন্দিত রাগমালা।
কোনো-কোনো ঋতুতে এবং অমাবস্যা নেমে এলে
হরিণ লুকিয়ে রাখে মুখ লতাগুল্মে, কাটে তার
কাল, চেষ্টাহীন; শিকারির
পদশব্দে, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে
নিয়তির ছায়া মিশে থাকে; প্রতীক্ষায় ত্রিকাল দোদুল্যমান।
ফাঁসির মঞ্চের আসামির মতো চাঁদ ঝুলে আছে
সেই কবে থেকে,
বেশ্যালয়ে একদা নতুন মুখগুলি
ক্রমশ পুরনো হচ্ছে এবং রবীন্দ্রনাথ একা
বড় একা আলখাল্লা দুলিয়ে নিশীথে
চলেছেন হেঁটে অ-বনেদী গলি দিয়ে নেয়ামত
দর্জির ঈষৎ বাঁকা উঠোন পেরিয়ে।
এদিকে দাঁতাল বর্বরেরা ঢুকে পড়ে মায়াবনে।
চাদ্দিকে খেমটা নাচ, হল্লাগুল্লা, অবিরত
কাজিয়া ফ্যাসাদ বাড়ে, হামেশাই হয় লোকক্ষয়
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে, মহাপুরুষের বাণী শত-
শত ক্যানভাসারের কণ্ঠনালী বেয়ে নামে; জয়-
পরাজয় কাদা লেপে দেয় মৃত সৈনিকের হাতে,
স্থির চোখে, ছেঁড়া টিউনিকে। নানাদেশে রাজনীতি-
পরায়ণ ধীমানেরা ধুধু দৃষ্টি ও স্খলিত দাঁতে
কাটাচ্ছেন কাল কারাগারে, কোনোখানে নেই স্থিতি।
টিনোসোরাসেরা মাটি ফুঁড়ে দ্রুত বেরুচ্ছে আবার
পারিপার্শ্বিকের সৌন্দর্যকে তছনছ করে, শুরু হবে
সংহারের পালা, হয়ে যাবে নিমেষে কাবার
বিভিন্ন গর্বিত জাতি, পারবে না বিপুল অগুরু
ঢাকতে লাশের গন্ধ। কূলে-উপকূলে দেশান্তরি
মানুষের ভিড় বাড়ে ক্রমাগত। এত কোলাহল,
তবু কেন এমন নির্জন বাসভূমি? ভ্রষ্ট তরী
কোথায় যে নিয়ে যাবে! চতুর্দিকে খলখলে জল।
স্বপ্নাদ্য সিংহের মতো হেঁটে যাই বিনষ্ট প্রান্তরে
হেঁটে যাই স্বপ্নভস্মময় চোখে উদ্দেশবিহীন।
কুৎসিত মুখোশ আঁটা কতিপয় লোক ঘরে-ঘরে
ছড়ায় আগুন, ঘৃণা-বীজ; জানে নাকো চিরদিন
প্রেমই শুধু কীর্তনের অভীষ্ট বিষয়। যে ব্যথিত
কবি ছিলো এ শহরে, মাথায় ছিলো না শিরস্তাণ
তার; ভুলে যাই রণরোল, জয়ীধ্বনি, অভিযান-
স্মৃতিতে ধারণযোগ্য কিছু নয় কবিতা ব্যতীত।
হোমারের স্বপ্নময় হাত
এখন আমার আশে-পাশে কেউ নেই। ঘর অন্ধকার নয়, একটা
বাতি জ্বলছে। অনুগ্র আলো যেন জাল; আমি স্বেচ্ছা-
বন্দি হয়ে আছি সেই জালে। কেউ নেই আমার পাশে, মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে নেই কাউ। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না এই
মুহূর্তে। মুহূর্তেগুলো থেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরছে
আমার ওপর। সময় বয়ে চলেছে একটানা, আমার আয়ুর পুঁজি
ক্ষইয়ে দিয়ে। এখন কোনো বইয়ের পাতায় চোখ বুলোতে
পর্যন্ত ইচ্ছে করছে না, অথচ বইয়ের প্রতি আমার আকর্ষণ
অত্যন্ত তীব্র। প্রহরে-প্রহরে বই থেকে আমি শোষণ করে নিই
আনন্দ, সমৃদ্ধ হয়ে উঠি দিনের পর দিন।
এখন আমার আশে-পাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না এখন যদি
খাতা খুলে লিখতে শুরু করি, কেউ ঢুকে পড়বে না আমার
ঘরে, কিংবা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে দেখবে না কি আমি
লিখছি। কোনো উঁকি ঝুঁকি মারবে না কেউ। চারপাশে এখন
নিভাঁজ নিঃসঙ্গতা। আমার একাকীত্ব জলচর প্রাণীর মতো
আলো পোহাচ্ছে। একটু আগে আমার বিচ্ছেদ ঘটেছে
স্বপ্নের সঙ্গে, হয়তো এজন্যেই একটা শূন্যতাবোধ
আপাতত দখল করে নিয়েছে আমাকে। স্বপ্ন ভেঙে গেলে
খুব একলা লাগে। কী স্বপ্ন দেখছিলাম আমি? ঘুম
যখন শরীরকে ত্যাগ করে যায়, তখন কোনো কোনো স্বপ্নের
কথা খুব স্পষ্ট মনে থাকে, যেন চোখ বন্ধ করলেই সেই
স্বপ্ন আবার দেখতে পাবো। এমন কিছু স্বপ্ন দেখি যা
স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে যায় অন্তহীন অস্পষ্টতায়।
আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। যারা স্বপ্নকে অর্থহীন
বলে উড়িয়ে দেয়, আমি তাদের কেউ নই। আমি স্বপ্নকে
অর্থময় মনে করি। স্বপ্ন বিশ্লেষণে অপটু বলেই সকল
স্বপ্ন আমাদের কাছে অর্থহীন। কী স্বপ্ন দেখছিলাম
আমি? সব কিছু মনে নেই, আবছা হয়ে গেছে অনেক
কিছুই। বহু পথ হেঁটে আমি প্রবেশ করেছি একটা
পুরনো নিঝুম বাড়িতে। ঠিক প্রবেশ করেছি, বলা
যাবে না, বাড়িটার বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ছি, অনেকক্ষণ
থেকে; কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ আসছে না।
তবে কি কোনো বাসিন্দা নেই এই নিঝুম বাড়িতে?
দরজা খুললো না দেখে সেখান থেকে অন্য দিকে রওয়ানা
হলাম। তারপর নিজেকে দেখতে পেলাম জনশূন্য,
ধুধু প্রান্তরে। জমি ফেটে চৌচির। কোথাও এক ডগা ঘাস
নেই, এক ফোঁটা পানি নেই। শুধু ঝিঁঝি পোকার
ডাকের মতো একটা শব্দ উঠে আসছে মাটি থেকে। হঠাৎ
যেন মাটি ফুঁড়ে বেরুলো একটা কালো মানুষ। মানুষ
না বলে কংকাল বলাই ভালো। লোকটা মাটির ওপর
বসে পড়লো এবং কোত্থেকে যেন একটা শিশু এসে বসলো ওর
কোল জুড়ে। হাড়-জিরজিরে শিশুটির দু’চোখে জীবনের
দ্রুত পলায়নের দৃশ্য। সেই লোকটা আর শিশুটিকে
দেখে মনে হলো যেন মৃত্যু শুয়ে আছে মৃত্যুর কোলে।
আর কী কী দেখেছিলাম। মনে পড়ছে না।
কিছুতেই মনে পড়ছে না।
স্বপ্নটির কী অর্থ দাঁড়ায় আমি জানি না। স্বপ্ন বিশ্লেষণের
ক্ষমতা থেকে আমি বঞ্চিত। এই স্বপ্ন কেন দেখলাম?
অনেকদিন থেকে একটা বাড়ি খুঁজছি বলেই কি সেই
পুরনো, নিঝুম বাড়িটা দেখা দিলো আমার স্বপ্নে, যে বাড়ি
আমি আগে কখনও দেখিনি? সংবাদপত্রে দেখা
ইথিওপিয়ার অনাহারী মানুষের ফটোগ্রাফই আবার আমার
স্বপ্নে হানা দিলো নতুন করে? এ প্রশ্নের উত্তর আমার
জানা নেই। জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারব না। এই
স্বপ্নের অন্তরালে অন্য কোনো গূঢ়ার্থ কি নিহিত?
এই স্বপ্ন আমাকে একলা করে দিয়েছে। এখন আমার আশে-
পাশে কেউ নেই। স্বপ্ন দেখতে আমার ভালো লাগে।
ঘুমের মরুভূমিতে স্বপ্ন তো মরূদ্যান। হারিয়ে-যাওয়া কিছু
চিত্রের খোঁজে স্বপ্ন দ্যাখে আমার কণ্ঠনালী, নাভিমূল,
বাহু, নখ, মাথার চুল। কখনও-কখনও স্বপ্ন আর বাস্তবের
মধ্যে আমি কোনো ভেদচিহ্ন খুঁজে পাই না। কুলুঙ্গিতে
তুলে রাখা কবেকার সবুজাভ দোয়াত ফেরেশতা হয়ে
আমার সঙ্গে কথা বলে যখন, তখন বুঝতে পারি না আমি স্বপ্নের
আচ্ছন্নতায় মজে আছি নাকি বাস্তবের চবুতরায় দাঁড়িয়ে
কবুতর ওড়াচ্ছি একের পর এক।
এখন আমার মাথার ভেতর সুকণ্ঠ কোনো পাখির মতো গান
গাইছে এই শহর। লোকগীতির এই শহর, ডিসকো
নাচের শহর, দোয়া-দরুদ আর মোনাজাতের শহর, ভিখারির শহর,
বেশ্যা দালালের শহর, রাশি-রাশি মিথ্যা বাগানের
শহর, ক্রুশবিদ্ধ সত্যের শহর, বিক্ষোভ মিছিলের শহর,
স্লোগান-ঝংকৃত শহর, কবির মৌচাকের মতো শহর,
শেষ রাত্রির বাইজীর মতো এই শহর। এই মুহূর্তে আমি
যা স্পর্শ করবো তা উন্মোচিত হবে নতুন তাৎপর্য নিয়ে।
গাছের বাকল হবে তরুণীর ত্বক, পথের ধূলো রূপান্তরিত
হবে রাজা সোলেমানের খনির মর্ণিরতা, ভিখারিণীর
কানি হবে সালোমের লাস্যময়ী পট্রবস্ত্র। এখন আমি নিজেকে
স্বর্শ করলে আমার ভেতর থেকে শত-শত ময়ূর
বেরিয়ে এসে পেখম ছড়িয়ে দেবে উঠোন জুড়ে। যদি এখন
আমি খাতার শাদা পাতা স্পর্শ করি, তাহলে সেখানে
বইবে অলকানন্দা, গড়ে উঠবে আর্ডেনের বন, লতাগুল্মে
ঝলসে উঠবে হোমারের স্বপ্নময় হাত।