এখানে সিঁড়িতে আগেকার কেউ যে-কথা বলেছে
প্রায় তারই প্রতিধ্বনি এখন আরেক
কণ্ঠে জাগে। অনেক পুরনো সিন্দুকের ডালা-খোলা
গন্ধময় স্মৃতি ঘোরে আনাচে কানাচে। কার হাসি
সোনালি ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে হেমন্ত-বিকেলে?
এখন যে ভায়োলেট-রঙ
শাড়ি পরে সাজাচ্ছে চায়ের সরঞ্জাম;
তার? নাকি আগেকার কারো?
পুরনো দেয়ালে কিছু দাগ জমা হয়, সাঁঝবাতি
জ্বালায় না কেউ;
অন্দরে বেদনা শুয়ে আছে সাবলীল ঘরে-ফেরা
নাবিকের মতো, বয়ে যায় খাওয়ার সময়, তবু
টেবিলে আসে না কেউ। ভোরে
দরজার কাছে এসেছিলো ট্রাক, একটি কি দুটি কাক
ছাদের কার্ণিশে উঠেছিলো ডেকে। কোথায় যে গেলো
ওরা লটবহর-সমেত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি রেখে?
মানুষের মতো
ইদানীং মানুষের মতো কিছু বাঁদর দেখেছি,
অবিকল বাঁদরের মতো কিছু বিহ্বল মানুষ।
বাহিরকে করে ঘর ওরা আর ঘরকে বাহির;
রাজপথে, ফুটপাতে, বাস টার্মিনালে, ঘাসময়
পার্কে আর সিনেমায় জমকালো বাঁদরের ভিড়
দেখে করতালি দিতে সাধ জাগে। ইচ্ছে হয় ডেকে
সবাইকে বাতাসা খাইয়ে দিই শান্ত গোধূলিতে
বাঁদরের চেয়েও অধিক বাঁদরামি দেখে আজ।
কিছু-কিছু অতিশয় প্রকৃষ্ট বাঁদর অন্তরালে
সূক্ষ্ম কাজ করে চলে অবিরত, ঢালে লম্বা কানে
নানান ঘোরালে কথা, খাল কেটে আনে কুমিরের
বংশধর, কোনো বাঁদর সাজানো মঞ্চ থেকে
মঞ্চান্তরে অপরূপ ভেংচি কাটে, লাঙুলের শোভা
দেখিয়ে বেড়ায় আর কতিপয় ব্যথিত বাঁদর
বিচ্ছেদের পদ্য লেখে এবং তুখোড় বাঁদরেরা
কলম বাগিয়ে ইস্ বানায় থীসিস মজাদার
লেখার কাগজ
লেখার কাগজ ক্রমে ক্রয় ক্ষমতার সীমা থেকে
খুব দূরে সরে যাচ্ছে; অথচ আমার রোজই চাই
কিছু শাদা কাগজ, কেননা আমি, বলা যায়, প্রায়
প্রত্যহ কিছু-না কিছু লিখি। উপরন্তু ভালো কাগজের
প্রতি, মানে সুশোভন কাগজের প্রতি বড় বেশি
আকর্ষণ বোধ করি। কাগজ কিনতে গিয়ে আমি
বেশ কিছু সময় কাটাই, উল্টে-পাল্টে বারবার
দেখি রাইটিং প্যাড, সযত্নে পরখ করে নিই।
আমাকে ছিটেল বলে ব্যঙ্গ করা অত্যন্ত সহজ;
কিন্তু আমি যা বলি স্পষ্টই বলি; সত্যি, ঢাক-ঢাক
গুড়-গুড় আমার স্বভাবে নেই। যদি কোনোদিন
কাগজ বাজার থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়,
নিরুপায় আমি অনন্তকে শ্লথগতি কচ্ছপের
ছায়া ভেবে লিখে যাবো ধূলো আর গাছের পাতায়।
শুভবাদী রোদ চুমো খেয়েছিলো
শুভবাদী রোদ চুমো খাচ্ছে লতাগুল্মে ঢাকা এই
রেস্তোরাঁকে, প্রাণে
পুরনো বৈভব নিয়ে বসে আছি, ছোট
টেবিলের ওপারে তরুণী, একা গায়ে
টোমাটো রঙের পুলওভারের প্রগাঢ় মমতা।
সমুখে স্যালাড, বিফ স্টেক,
সোনালি সুরার পাত্রে ঠোঁট।
কখনও দেখছি তাকে বিদেশী সংকোচে, কখনও বা নিসর্গকে।
একটু একটু নিচ্ছি স্বাদ
বাদামি রুটির,
মুখের ভেতর গলে টাটকা মাখন;
উড়ন্ত বেগনি পোকা তার সোনালি আঙুলের বসে
খেলা করে, কিছুক্ষণ ডগালগ্ন থাকে, যেন
হয়েছে মাতাল তন্বী ত্বকের উত্তাপে।
-এ কিসের ছায়া মাঝে-মধ্যে দুলে ওঠে।
মৃদু প্রবাধন-ধন্য মুখে?
পরা বাক্ পাক খায় বারবার মনের ভেতর। মনে হয়
এরকম বসে-থাকা, ত্র্যানিমার মুখোমুখি, বহু
শতাব্দী আগেও ছিল। ওর লাল বুটে
ঘাসের সবুজ স্মৃতি লুটোপুটি খায়, যাত্রী নিয়ে দূরে বাস চলে যায়।
একদা এখানে এই পুরনো মহলে আসতেন পুশকিন,
বাতাসের গুঞ্জরণময় ছায়াবীথি পেতো কবি দৃষ্টি; তিনি
হেঁটে যেতে-যেতে
হেমন্ত বিকেলে
চকিতে পেতেন খুঁজে কবিতার পংক্তিমালা
চৈতন্যের ষড়জে নিখাদে।
গাছের শিকড়গুলি সর্পিল আবেগে
তাকেই জড়াতে চায় রক্তে যার আফ্রিকার গহন ঝংকার।
বেলা বাড়ে, চুল ওড়ে মৃদু;
অচিহ্নিত বেদনায় ছায়া জমে মনে, রেনকোট নিই
কাঠের চাকতি জমা দিয়ে
প্রৌঢ় সজ্জনের কাছে। কারুকে বিদায়
না বলে ট্যাক্সিতে উঠে, ফিরে যাই মাইল-মাইল
দূরে নক্ষত্রের নীড়-ছোঁওয়া হোটেলের কামরায়।
কালো কফি খেতে খেতে ভাবি
উড়ন্ত বেগনি পোকা, রোদ-লাগা গোলাপি আঙুল,
কাঠের রেলিঙে ঝুঁকে-থাকা ডগার লতার কথা।
ক্রীড়াপরায়ণ পোকাটির প্রতি তার
প্রসন্ন দৃষ্টির মায়া বিলিয়ে কী কথা
ভাবছিল সেই মেয়ে? কারো সঙ্গে অভিমান করে
এসেছে একলা চলে? নাকি যে আসবে বলে কথা
দিয়েছিল, সে মেট্রোর টিকিট কাটেনি ভুলক্রমে?
ঝর্নার পানির মতো সময় গড়িয়ে যাবে, ক্রমাগত ঘোলা
হবে জল দশ দিকে, রাশি রাশি মাছ
কোথায় হারিয়ে যাবে ব্যাপক দূষণে।
বিস্মৃতির ধূসর ডাস্টার নির্বিকার
নিমেষে ফেলবে মুছে অনেক কিছুই। ভুলব না
সেই কবে দূর দেশে শুভবাদী রোদ
চুমো খেয়েছিল
লতাগুল্ম ঢাকা রেস্তোরাঁকে, একটি বেগনি পোকা
খেলা করেছিল সরু গোলাপি আঙুলে।
লাল বুটলগ্ন কচি ঘাসের ডগাকে ভুলব না কোনোদিন।
শেফার্স
কত দীর্ঘকাল আমি শেফার্স করি না ব্যবহার।
ফলত হাতের লেখা, মনে হয়, ক্রমশ খারাপ
হয়ে যাচ্ছে। এমনকি আমার লেখার সুচিহ্নিত
চরিত্র বদলে গেছে, বলা যায়। এরকম ক্রীড়া-
পরায়ণ ধারণা আমার মনে সীলমোহরের
স্পষ্ট ছাপ কেবলি বসাতে চায়। হয়তো এর কোনো
মানে নেই; সংস্কার পাখির মতো ডেকে ওঠে লাল
রক্তের ভিতরে। বলপেনে ভাষাচর্চা কী রকম
ফুলচন্দনের ঘাণপায়ী হতে পারে, জেনে গেছি।
ধরেছি ঘরের ভাষা সুদূর প্রবাসে কাগজের
ব্যাপক শাদায়, পাই নিদ্রিত বনের বিষণ্নতা।
প্রকৃত রন্ধনশিল্পী যিনি তার কাছে কড়াইয়ের
আকার প্রকার স্রেফ অবান্তর। কোনো কোনোদিন
মনে হয়, একটি শেফার্স পেলে বড় ভালো হতো।