কোথাও যাওয়ার নেই, শুধু অন্তর্গত
পথের বিস্ময়মাখা হাওয়া
বয় ভিন্ন স্তরে, নীলিমার স্পর্শ লাগে; অন্ধকারে বিছানায়
শুয়ে ভাবি বাসারির কথা,
সিস্টার্ন চ্যাপেল আর ইরাসমূজের মানবিক দীপ্তিমালা
দুলে ওঠে, অকস্মাৎ একজন পর্যটক, পায়ে তার বৎসরান্তিক
ধূলো, চুল এলোমেলো, খোলা গেরেবান,
দাঁড়ায় দরজা ঘেঁষে, বলে-চলো যাই।
বসে আছে
বেশ কিছুকাল থেকে বসে আছে পাথুরে বেঞ্চিতে।
সূর্যাস্ত বিছায় স্নেহ চোখে, মুখে, ভুরুতে, আঙুলে;
চুল ওড়ে, প্রশস্ত কপালে বৈরাগ্যের পথরেখা,
শ্মশানের কাঠ পোড়ে হৃদয়ের ভিতরে এবং
চক্ষুদ্বয় পাখির রঙের অন্তরালে ভিন্ন কোনো
বর্ণশোভা দেখে নিতে খুব স্থির। এ ভঙ্গিতে তার
ঈষৎ স্থাপত্য আছে, আছে শুদ্ধ সঙ্গীতময়তা।
স্বাস্থ্যান্বেষী ব্যক্তিবর্গ, বয়েসী, এবং কতিপয়
চমকিলা যুবা তাকে দেখে হাসে, কেউ-কেউ শিস্
দেয়, যেন বৃক্ষাশ্রিত পাখিরা উদ্দিষ্ট, এই মতো
ভান করে হেঁটে যায়। কারুর দিকেই নেই তার
দৃষ্টি, শুধু নিজের ভেতরে চোখ সঞ্চরণশীল
অতিশয়; এখন সত্তায় তার ঠোনা দিলেও সে
নড়বে না এতটুকু, মনে হয়; যেন-বা পাথর।
বাক্য খরায়
সেই কবে থেকে লিখছি কবিতা, তবু হামেশাই
ভীষণ আটাকা পড়ি হতাশায় ঊর্ণাজালে।
কখনও-কখনও এমনও তো হয়, একটি কবিতা
মাঝপথে এসে স্মৃতিহীন ধুধু চড়ায় ঠেকে।
মগজের কোষে, শিরায় শিরায় জাগে ক্রমাগত
গোধূলি বেলায় প্রাক্তন কত প্রতিধ্বনি।
দূরের পাহাড় থেকে ভেসে আসে দিশেহারা কোনো
মেষপালকের আব্ছা ব্যাকুল কণ্ঠস্বর।
কখনও-কখনও শুরুতেই বাজে তালকানা সুর,
যেন সরগম কখনও আমার হয়নি সাধা
চিত্রকল্প পাথরের ভাঙা মূর্তির মতো
ঘর কুয়াশায় কেবলি ফোঁপায় হাওয়ার স্বরে।
এরকম ঘটে, দেখি চিরচেনা গলিটার মোড়ে
আবর্জনার টিলাকে ছুঁয়েছে নীলিমা-চেরা
রঙধনু আর হাড়ের বাগানে পথ ভুলে ঢোকে
পঙ্গু হরিণ। অন্ধ রাজার ভাঙা বেহালা।
ছেঁড়া কাঁথাটায় আশ্রয় খোঁজে রাত তিনটের
নিম উর্বশী, বেহেড মাতাল মধ্যরাতে
নিজের বমিকে মণিরত্নের ঝলক ঠাউরে
উলঙ্গ পথে পড়ে থাকে একা অনাশ্রয়ে।
নিঃসর্গ আজ প্রলাপ বকছে,; ইঁদুরে ছুঁচোয়
ভরেছে শহর, গ্রাম ডুবে যায় বানের ক্রোধে।
ঘোর উন্মাদ রাজার মতন হাসে অবিরত
অত্যাচারের সেয়ানা, দাঁতাল অস্ত্রগুলো।
এসব দৃশ্যাবলির আড়ালে যেসব দৃশ্য
স্থাপত্য হয়ে করছে বিরাজ ইতস্তত,
তাদের কিছুটা বাক্বিভূতির ছোঁওয়া দেবো বলে
ভুরুতে চন্দ্রকলা নিয়ে জাগি দীর্ঘরাত।
কিন্তু আমার ব্যর্থতা শুধু শাদা কাগজের
খাঁ-খাঁ বুক জুড়ে বারবার জোরে বসায় নখ।
অন্ধ পাখির সঙ্গে এখন বসে আছি ঘরে
বাক্য খরায়; নগ্ন, তোতলা দেবতা যেন।
বার্ধক্যে জসীমউদ্দীন
গলায় জড়ানো তাঁর শাপলা রঙের মাফলার, কষ্ট পান
প্রায়শই বাতে, কফ নিত্যসঙ্গী, কখনো হাঁপান
সিঁড়ি ভেঙে। এ কেমন একাকিত্ব এলো ব্যেপে
অস্তিত্বের উড়ানির চরে? প্রহরে-প্রহরে শুধু দাগ মেপে
নানান ওষুধ খেয়ে ধুধু সময়ের খালে
লগি ঠেলা নক্ষত্রবিহীন এ গোধূলি কালে।
আপাতত কিছুতেই নেই মন, শিশু বৈকালী সাহিত্য সভা,
জয়নুলী চিত্রকলা, ইতল-বিতল, রক্তজবা,
দূর থেকে-আসা কবিয়াল, কিংবা বিশ্বের খবর-
কিছুই টানে না তাঁকে। মাঝে-মধ্যে নিষ্প্রদীপ দাদির কবর
ভেসে ওঠে, ভেসে ওঠে ছায়াবৃত মাঠ, খাল, বিল,
কবেকার বিশুদ্ধ কোকিল।
তাকান কখনও ভেজা চোখে
শিল্পিত শীতলপাটি শোভিত দেয়ালে। ঘরে ঢোকে
অকস্মাৎ চড়ুই দম্পতি, চঞ্চলতা
ছড়ায় ড্রইংরুমে। খয়েরি শালের খুঁট মেঝেতে গড়ায়, নীবরতা
হীরের মতন জ্বলে, একটি অনুপস্থিতি ঝুঁকে
থাকে তাঁর বিমর্ষ শিশিরময় বুকে।
কোথাও নিঝুম হ্রদে লাল পদ্ম ফুটে আছে আজ,
হঠাৎ ভাবেন তিনি। খ্যাতির আওয়াজ
অন্ধকারে খড়মের শব্দ যেন এবং জীবন
যুগপৎ অর্থময়, অর্থহীন, বেদেনীর শাড়ি মতন
ভাসমান গহীন গাঙের জলে। ঠোঁটে
বর্তমান, ভূত, ভবিষ্যৎ-সংকলিত হাসি ফোটে।
‘আমাকে নিও না তুমি’, কবিতা আবৃত্তি করবার
ধরনে বলেন যাকে, তার
হাত জানালার গ্রিলে, হাতে কালো পাখি ডেকে যায়
শব্দহীন অবিরত। আদিগন্ত ঘন কুয়াশায়
শূন্য নাও ভাসে,
চেয়ার অর্পিত শ্লথ হাতে অস্তরাগ নেমে আসে।
করোটিতে ছিলো তাঁর কী ব্যাপক চর-থরথর
কাইজার চিত্রনাট্য, গাথার ছন্দের মতো সোনার গতর
গ্রাম্য যুবতীর, মাছলোভী মাছরাঙা, সারিগান।
স্বপ্ন-কণা-ধান
ঝরেছে করোটি জুড়ে, ডানা-অলা বাইসাইকেলে
চেপে কোন্ শাশ্বতের বনে গেলেন পেছনে ফেলে
সব কিছু? তাঁর সে চাকার কিছু নাক্ষত্রিক ধূলো
কেমন রাঙিয়ে দেয় আমার চোখের পাতা আর চুলগুলো।
বিছানা
গৃহকোণে খাটের ওপর সাবলীল শুয়ে থাকে
আমার বিছানা সারাক্ষণ। যদি কেউ ভালো করে
চোখ রাখে বিছানার ওপর, তাহলে শহজেই
নজরে পড়বে তার বাদামি চাদর, ফুল-তোলা;
চারটি বালিশ বেশ নরম এবং ঝকঝকে।
মশারি খাটানো হয় রাত্রিবেলা, পায়ের নিকট
শীতকালে নিভৃতে গোটানো থাকে লেপ। বেড়ালের
সঙ্গ ছাড়া বিছানার নেই কোনো প্রকাশ্য বাহার।
আমার গৃহিণী রোজ বিছানার পরিচর্যা করে
খুশি হন। কখনও চড়ই বিছানায় খড়কুটো
ফেললে তিনি ছুটে এসে সরিয়ে ফেলেন আবর্জনা,
মৃদু গালমন্দ দেন পাখিদের। শয্যা রচনায়
আমার কৃতিত্ব নেই একরত্তি। শুধু আমি কিছু
প্রতীক এবং চিত্রকল্পে সাজাই বিছানাটিকে।
ভাড়াটে
পুরনো ভাড়াটে চলে গেলে কোনো বাসা কোনোদিন
খালি পড়ে থাকে না এখন।
পুনরায় ‘বাড়িভাড়া দেওয়া হইবে’ ফলকটি
বসতে না বসতেই সরে যায়। অন্ধকার
ঘরে আলো জ্বলে, বারান্দায় হেঁটে যায় কেউ কেউ,
জানালায় পর্দা লাগে, শিশুর আনন্দধ্বনি বাজে
মাঝে-মাঝে; ক্যাসেট প্লেয়ারে
রবীন্দ্রনাথের চিরকালীন গহন ব্যাকুলতা।