চরাচরব্যাপী হাহাকার শুনে,
অধিবাস্তব পালা দেখে আজ
রাত্তিলোভী চাঁদ ওঠে না তো
রোগা কেরানির আপিস কামাই করার মতো।
মল্লিকা বনে দিনরাত্তির
কবর খুঁড়ছে শবসাধকেরা;
ছিঁচকাঁদুনের দল মর্শিয়া
গেয়ে এলেবেলে করে প্রস্থান অস্তাচলে।
আর কিছু আমি পারি না-ই পারি,
অন্তত আজ কথা দিতে পারি-
আমার কবিতা কড়া নেড়ে যাবে
ঘুমন্ত সব নিঝুম বাড়িতে একলা হাতে।
দালান
আমার বাসার চতুর্দিকে দালান উঠছে ক্রমে
মাতব্বদের মতো মাথা উঁচু করে। ইদানীং
সচ্ছলতা, বোঝা যায়, শিস্ দিচ্ছে পাড়ায়-পাড়ায়।
অবশ্য একথা তত প্রাসঙ্গিক নয়; দশজন
আঙুল ডুবিয়ে ঘিয়ে বসবাস করলে টাটায় না
কখনও আমার চোখ। এ রকমভাবে অতি দ্রুত
দালান ওঠার ফলে আগেকার অনেক কিছুই
পড়ে না আমার চোখে আর। প্রতিদিন যে তরুণী
বারান্দায় দাঁড়াতো উদ্দাম চুলে, যেসব বালক
একটি প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলে হতো খুশি, আর
দেখতাম তালগাছে চিল, দাঁড়কাক, কতিপয়
ভিন্ন পাখি সহজে বিশ্রাম নিতো, তারা সকলেই
অদৃশ্য সম্প্রতি; দুঃখ হয়। ল্যাণ্ডস্কেপের সন্ধানে
এখন মনের অভ্যন্তরে আমি দৃষ্টি মেলে দিই।
নস্টালজিয়া
আবার সেখানে তুমি হুবহু আগের মতো সব
পেয়ে যাবে, এরকম ভাবা ঠিক নয়। বহু পথ পাড়ি দিয়ে
অখ্যাত স্টেশনে নেমে খানিক জিরিয়ে
হেঁটে যাবে, তারপর উঠবে নৌকায়, পালে হাওয়া
লাগবে, মেঘনার বুক চিরে,
যাবে তুমি বহুদূরে ভাটিয়ালি টানে।
ধান-রঙ অপরাহ্নে আলুঘাটা পৌঁছে
শহুরে পা রেখে ভেজা মাটিতে এবং
দৃর্ষ্টি মেলে গাছগাছালির ভিড়ে, ছনছাওয়া ঘরে
কী তুমি প্রত্যাশা করো আজ?
কৈশোর ও যৌবনের মাঝখানে থমকে দাঁড়ানো
সেই মেয়ে আসবে কি ছুটে
শাড়ির কোঁচড়ে তার একরাশ বৈঁচি ফল নিয়ে?
কিংবা সে কিশোর, যাতে তুমি
এই তো সেদিন ভরা শ্রাবণের নিঝুম ধারায়
কী ব্যাকুল ছুঁয়ে
পরখ করতে চেয়েছিলে সে প্রকৃত
সজীব প্রতিভূ কিনা বাস্তবের, সেও কি আবার
তোমার সতৃষ্ণ বুকে পড়বে ঝাঁপিয়ে
নিরাশ্রয় পাখির ধরনে?
বাঁশঝাড় পেরুনোর সময় তোমার
পড়বে কি মনে কত উদাস দুপুরে
পাখির ডিমের লোভে ক’জন বালক দিতো হানা জরাগ্রস্ত
কাচারি বাড়ির আশেপাশে থমথমে সান্নাটায়?
পড়বে কি মনে পূর্ণিমায় পুরনো পুকুর পাড়ে ঢ্যাঙা নাঙা
ফকিরের নিসর্গ-মাতানো নাচ? মধ্যরাতে বৈঠকখানায়
মাইজভাণ্ডারি গান?
পড়বে কি মনে সেই দৃশ্যবলি, খুব ছলছলে
হাল-আমলের গ্রামভিত্তিক বঙ্গীয় উপন্যাসে
যে রকম থাকে?
কষ্ট দেয় প্রাচীনতা বড় কষ্ট দেয়, ভাবো তুমি,
দরবারি কানাড়ার মতো। ত্রস্ত খরগোশ ঝোপ
থেকে ঝোপান্তরে ছুটে যাবে, ঝরবে পায়ের কাছে
আম জাম কাঁঠালের পাতা, দাওয়ায় দাঁড়ানো কেউ
উঁকি দেবে, ধরা যাক। পাখি
চকিতে উঠবে ডেকে সন্ধ্যাকে চমকে দিয়ে খুব।
হয়তো সেখানে গিয়ে দেখবে আগের মতো নেই
কোনো কিছু, হয়তো বা কোনো চোখের অনাশ্রয়
তোমাকে ফিরিয়ে দেবে শূন্য নদীতীরে, তবু অনিচ্ছা সত্ত্বেও
আজ হোক কাল হোক তোমাকে যেতেই হবে সুদূর সেখানে।
নিজের ছায়ার দিকে
আমার ভেতরে আছে এক ছায়া সুনসান; তার
ধরন বেখাপ্পা খুব, অন্তরালে থাকে।
সামাজিত তাকে বলা যাবে না, যদিও ভ্রমণের
অভিলাষ আছে তার এখানে-সখানে অবিরাম।
কখনও-সখনও
নিজের ছায়ার দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে
তাকাই রহস্যবাদী মানুষের মতো। সদিচ্ছার
অনটন নেই,
অথচ আমার ছায়া বাড়ালে উদগ্রীব হাত, আমার নিকট
নয়, অন্য কারো দিকে প্রসারিত হয়।
সকল সময়
আমার সমান্তরাল বসে, হেঁটে যায়,
নিদ্রায় আমার সঙ্গে দিব্যি মিশে থাকে হরিহর।
যখন সে দ্যাখে ধুরন্ধর বুদ্ধিজীবী
আর গোমূর্খের দল খাচ্ছে জল একঘাটে
তুখোড় কৃপায় কারো, মর্মমূলে তার
পরিহাস ফণিমনসার রূপ ধরে। নিজস্ব ভূমিকা নিয়ে
খানিক বিব্রত হয়, ফাঁদে-পড়া
পাখির মতোই
ডানা ঝাপটাতে থাকে প্রহরে-প্রহরে। আর ভাবে
মাঝে-সাজে- কখনও প্রকৃত মানুষের চেয়ে তার
ছায়া বড় হয়ে যায়।
কলহাস্য-সংকলিত সজীব বাসরঘরে মরুর বিস্তার,
গেরস্ত ঘরের উর্বশীর প্রতি যযাতি-দৃষ্টির
লোলুপতা দেখে চমকে ওঠে আর
একটি যুগের অস্তরাগে
রঙিন বিহ্বল হয়ে আমার ভেতর থেকে তীব্র
বেরিয়ে পড়তে চায়, যেন
কোনো দূর হ্রদের কিনারে গিয়ে খানিক দাঁড়াবে,
নিমেষে ফেলবে ধুয়ে অস্তিত্বের ক্লান্তিময় ধূলো।
কখনও-কখনও বড় বেশি অস্থিরতা
পেয়ে বসে তাকে; আমি নিজে
যতোই ঘরের খুঁটি শক্ত হাতে ধরি,
আমার নিজস্ব ছায়া হতে চায় ততোই বিবাগী।
পর্যটন
কড়া নেই; ব্যস, এইটুকু যা তফাত। কিছুকাল
ছোট এক ঘরের ভিতরে
আছি, হয়তো
গভীর ভূতলাশ্রয়ী রাজনীতিপরায়ণ কেউ
ধূর্ত ফেউদের খরদৃষ্টির আড়ালে
এরকম করে বসবাস।
নিভৃতে নিজেকে ক্রমাগত
নিজের ভিতরে খুব গুটিয়ে নিয়েছি।
আমি কি কারুর ভয়ে ইদানীং এমন আড়াল
খুঁজি রাত্রিদিন?
আস্তে সুস্থে দু’পা
এগিয়ে গেলেই ছুঁতে পারি মল্লিকার শরীরাভা
এবং নিবিষ্ট বসা যায় গুঞ্জরিত
চাখানায় বুলিয়ে ব্যাপক ভ্রাতৃদৃষ্টি শুভবাদী
কথোপকথনে নাক্ষত্রিক নীড় খোঁজা চলে আর
সত্তাময় রাঙা ধূলো নিয়ে ফেরা নিভাঁজ সহজ।
কোথাও যাই না; মূর্তিমান সান্ত্রী নেই আশেপাশে,
তবু চতুর্দিকে কী নাছোড় কবন্ধ পাহারা
মাঝে-সাঝে ইচ্ছে হলে পর্দাটা সরিয়ে
জানালার বাইরে তাকাই,
চোখ দিয়ে ছুঁই
গোলাপ, টগর, জুঁই, আকাশ-সাজানো
দূর সাইরেবিয়ার, গোধূলিমাতাল হংসযূথ।
সর্বোপরি পায়চারি নিজের ভেতরকার ছাঁদনাতলায়।