একদিন দুপুরে
সজনে গাছের ডালে পাখি ডাকে ডবকা দুপুরে, গায় গান
পাড়ার মাস্তান,
নেশাভাঙ করে আর হিজড়া ধরনে
নাচে, যেন ওরা মায়াবনে
দেবদূত দেখে খুব প্রাণিত এখন।
গলি থেকে তরুণী বেরোয়া একা, ফেরিঅলা ডেকে
যায় দুপুরকে চিরে-চিরে;
অকস্মাৎ কেমন চাঞ্চল্য জাগে মানুষের ভিড়ে,
ট্রাফিক পুলিশ উচ্চকিত, বাঁশি বাজে, কী বিপন্ন বিহ্বলতা
চতুর্দিকে, ট্রাকের তলায় চাপা পড়েছে উদোম মানবতা।
এখন সে কথা থাক
(আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রীতিভাজনেষু)
আমার পিতামহের আমলের অনেক পুরনো
এক সিন্দুকের কথা জানি, যার ডালা
খুললেই চকিতে প্রাচীনতা
বিশীর্ণ আঙুল নেড়ে নেড়ে ডাকে রহস্যের স্বরে।
যেন তার অভ্যন্তরে খুব দীর্ঘ পথ আছে গাছগাছালির
সেরেনাদে খুব স্নিগ্ধ, চোখের পাতায় জমে ছায়া,
আছে কিছু তসরের শাড়ির সৌরভ,
ঘাসে ফেলে-যাওয়া কারো পশমের চটি,
সৌন্দর্যমাতাল রুগ্ন খর্বুটে কবির এপিটাফ,
বাছুরের ঘুণ্টি-বাঁধা মেটে গলা, দাদার তসবিহ্-
এরকম ভাষাচর্চা করে সে সিন্দুক।
এখন সে কথা থাক।
সাতটি সোনালি মাছ আলোকিত কড়িকাঠ থেকে
নেমে পিয়ানোর রিডে নাচে,
আয়না বেয়ে উদ্বেড়ালের নাকের ডগার নিচে
ব্যালেরিনাদের মতো মোহন বিন্যাস তৈরি করে,
তারপর ঘর ছেড়ে উড়ে যায় দূরে
জানালার পর্দা দুলিয়ে
কুঁড়েঘর, টিনশেড ছুঁয়ে গায়ে মেখে
মেঘেদের রোঁয়া।
পাহাড়ি ঈগল সেই দৃশ্যের চকিত উন্মীলনে
ঈষৎ বিস্মিত হয়ে রহস্যের মর্মমূল স্পর্শ করে
নিজেও সঙ্গীতময় হয়।
সোনালি মাছের গান এখানেই লয়ে নিবিড় মিলিয়ে যাক।
প্রাচীন দুর্গের মতো একটি বাড়ির কাছে যাই
মাঝে-মধ্যে,দাঁড়াই সামান্যক্ষণ, এদিক-ওদিক লক্ষ করি,
দূর থেকে জেনে নিতে চাই
বাড়ির ভেতর কতটুকু অন্ধকার কিংবা কতটা আবির
তৈরি হয়। কখনও সে বাড়ি আশাবরী ধরে,
কখনও-বা গায় মধ্যরাতে
দরবারি কানাড়া। একজন থাকে সে বাড়িতে, যাকে
কখনও দেখিনি আমি, যার নরম পায়ের কাছে
শুয়ে থাকে এক জোড়া চিতাবাঘ, কতিপয় নীলাভ ময়ূর
ঘোরে সারাক্ষণ আশেপাশে; মাঝে-মাঝে
তার কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে ঝাড়লণ্ঠনের মতো,
সে-ভাষা বুঝি না।
আজ থাকে, সে-বাড়ির কথা
একান্ত বিশদভাবে বলা যাবে কখনও আবার।
কখনও হাটে নেই
কখনও হাটে নেই, মাঠেও নেই, শুধু
মগ্ন থাকে একা নিজের মতো।
গহন সত্তায় যেন কে মঠবাসী
পেতেছে আস্তানা, হৃদয়ে ক্ষত।
দিবস দাবানল, ক্ষুধিত আগুনের
হল্কা বয়ে যায় একলা ঘরে
ঘনিয়ে এলে রাত খরায় ছারখার
দগ্ধ আত্মায় বৃষ্টি ঝরে।
মানসে ঈগলের অহংকার-মণি,
সুদূর নীলিমার অন্ত নেই।
নীলিমা ছুঁয়ে ছেনে জমিনে ফিরে আসে
জীবনপরায়ণ সন্ত সেই।
করে না চেচাঁমেচি, কণ্ঠস্বর তার
পড়শী শোনে পেতে আড়ালে আড়ি;
কখনও শৃঙ্ক্ষলা উচ্চারণে বাজে,
কথারা কখনও-বা এলোপাতাড়ি।
দৃষ্টি প্রত্যহ রেখে সে দূর পথে
রৌদ্রে, মেঘপুরে কাটায় বেলা;
ভ্রমণাতুর তার হৃদয় অজানায়
ভাসায় কুয়াশায় ভ্রষ্ট ভেলা।
যখন অন্তরে টানাপোড়েন নেই,
তখন মরশুম শূন্যতার।
ডুবলে নৈরাশে, হঠাৎ কাঁটাবনে
দ্বান্দ্বিকতা আনে দ্যুতিবিথার।
কবর সাজাই
সেদিনও সকাল শহরের মুখে সতেজ আবির
কিছু দিয়েছিলো মেখে। ময়লা গলির মোড়ে নিডর বালক
ডাংগুলি খেলতে-খেলতে
আইসক্রিমের প্রতি গিয়েছিলো উড়ে
গাংচিল ভঙ্গিমায়। কেউ-কেউ পাবদা মাছের শুরুয়ায়
ডুবিয়ে আঙুল
ঘড়ির কাঁটার প্রতি রেখেছিলো চোখ,
অফিসের তাড়া ছিলো বলে।
সেদিনও কোথাও
দাম্পত্য কলহ ছিলো, ছিলো কিছু প্রেমের সংলাপ;
নিউজপ্রিন্টের বুকে ছিলো
স্মরণমন্থনকারী ফাল্গুনের একরাশ উদ্ভিন্ন অক্ষর।
একস্মাৎ কী-যে হলো, শহরের পথে
দুপুরেই সন্ধ্যা এলো নেমে, যেন রূপান্তরে গলগোথা ঢাকা
কেরানীর কলমের গতি গেলো থেমে
লেজারের উদাস পাতায়। ঝাঁকা মুটে, রিক্শা-অলা,
ফেরি-অলা আর চটকলের শ্রমিক
চমকে উঠলো শিকারির গুলিবিদ্ধ পাখির ঝাঁকের মতো।
শহরের পথে
নিমেষে ছড়িয়ে পড়ে শত রক্তজবা। ছিলো যারা
সাধারণ এবং অজ্ঞাত,
যৌথ অবচেতনার পরিচর্যা পেয়ে
তারাই প্রকৃত অসামান্য হয়ে ওঠে স্বপ্নচারী পরাক্রমে
কিংবদন্তির মতো ধ্রুব এবং অপিরহার্য। ছিলো না
হেলমেট, টিউনিক ওদের, অথচ
তারাও সৈনিক রৌদ্রজলে ঝড়ক্ষুব্ধ পরিখায়।
হৃদয়ে মায়ের ডাক খুব তীব্র পৌঁছেছিলো বলে
বুকের ভেতর তার ঝড় হতে থাকে, বুঝি তাই
ছুটে আসতেই হয় পথে, হাটে-মাঠে,
শুনতেই হয় সেই গান, সুর যায় যাঞ্চা করে
আত্মবলিদান। ওড়ে তার খুলি, বুকে গর্ত হয়। কী বিস্ময়,
সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের স্মৃতির ভূগোলে
পতাকারই মতো দীপ্ত, বন্দনা-স্পন্দিত,
কেমন নিঃশব্দ প্রেমে, অথচ বাঙ্গময়!
সে নেই কোথাও
রঙিন ছবির পোস্টাকার্ডে কিংবা দেয়ালে পোস্টারে
আছে আমাদের চৈতন্যের ল্যাণ্ডস্কেপে,
গল্পে আছে, যেমন গোলাপ থাকে পাতার ভিতর,
কবিতার পবিত্র পংক্তিতে আছে, যেন
চির বরাভয়,
আছে স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের চিদাকাশে,
তাই বর্ণমালা দিয়ে আজ তার কবর সাজাই।
কড়া নেড়ে যাবে
মারী ও মড়কে পুড়ে-পুড়ে হাড়
কালি হলো আর জটিল সড়কে
হেঁটে হেঁটে পায়ে ক্ষত বেড়ে যায়;
দান্তের মতো নরকে ভ্রমণ অব্যাহত।
খাঁ-খাঁ জ্যোৎস্নায় নগ্নিকা দেখি
শুকোতে দিচ্ছে ছেঁড়া শাড়ি তার।
বিশীর্ণ শিশু ঘন-ঘন করে
মায়ের শূন্য হাতের তালুতে দৃষ্টিপাত।