Site icon BnBoi.Com

হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল – শামসুর রাহমান

হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল - শামসুর রাহমান

অকাল বসন্ত

বেশ কিছুদিন ধরে আছি রোগশয্যায়
যদি বলি, অস্থিমজ্জায় অজস্র ইঁদুর দাঁত বসিয়ে
ক্রমাগত খসিয়ে নিচ্ছে সারবস্তু, মিথ্যা বলা হবে না।

ঘড়ির কড়া শাসন মেনে ওষুধ খাওয়া,
মাঝে মধ্যে ডাক্তারের কাছে যাওয়া চেক-আপের জন্যে।
অন্য কোথাও ধীরে সুস্থে অথবা হন্যে হয়ে
যাতায়াত করা বারণ, কারণ, নাজুক ফুসফুসের
পক্ষে গেরিলা বীজাণুর চোরাগোপ্তা হামলা
সামলানো কঠিন। দু’বেলা ভেন্টোলিন
ইনহেলার দিয়ে শ্বাসটুকু বজায় রাখা এভাবেই
থাকা না থাকার নাগরদোলায় ভুলছন্দে হায়রে ওঠানামা,
গায়ের জামায় নিজের নাকেই লাগে রোগের চিম্‌সে গন্ধ।

টেবিলে তার পাঠানো ক্যামেলিয়া সগৌরবে
বিরাজ করে, ছড়ায় সৌরভ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখি,
এ কী খাটের চৌদিকে গজিয়ে ওঠা নলখাগড়া
থকথকে কাদা, কয়েকটি তাগড়া কাদাখোঁচা, হাড়গিলা
ভাঙা ডাল, মরা পচা পাতার মধ্যে গলাফোলা
একটা কোলা ব্যাঙ আচানক ঠ্যাঙ তুলে লাফিয়ে
গা ঢাকা দেয় খাটের তলায়,
সেই বদ্ধ জলায় অমাবস্যার করাল ছাপ।

খাটের চারপাশের পঙ্কিল কাদা কর্কশ বনবাদাড়
গড়াতে গড়াতে আমার কবিতার খাতায়
চলে আসে,
সুন্দরীতমা নগ্ন হেরার সাঁতারের
ছিটকে-পড়া জলকণা সমুদয়
আর পরশ পাথর খুঁজি। যা অপ্রাপণীয়
অথচ সন্ধ্যানের যোগ্য তা-ই আমার পুঁজি।
কাদা লেপা কবিতার খাতায় ছন্নছাড়া শূন্যতার বিলাপ,
সেখানে নিষ্ফলা ঋতুর পুষ্পহীনতা,
হঠাৎ কোন্‌ ধূসর রাজ্য থেকে উড়ে এসে একটা কোকিল
ব্যাকুল সুরে কবিতার খাতায় ডেকে আনলো অকাল বসন্ত।

অনুবাদক

গোলাপ নিঃশব্দে এসে বলে যায় সৌন্দর্যের কথা
আপনার সুগন্ধের কথা,
মন দিয়ে শুনি;
পাখি তার উড়ালের কথা,
গানের সুরের কথা বলে যায় পাখা নেড়ে শুনি;
শিশির নিজের কথা কোমল গচ্ছিত রেখে যায়
আমার শ্রুতিতে। গৌরী তুমি
আমাকে নিয়ত বলো ভালোবাসা, জ্যোৎস্না,
রোদ্দুর, বৃষ্টির কথা।
মনোরকম বাচনভঙ্গিতে বলো তুমি
আমাদের বিজয়ের কথা, নির্যাতিত
মানুষের কথা, প্রগতির রথের অপ্রতিরোধ্য
দুর্বার চলার কথা; মানবিক অনুভূতিমালা
উচ্চারিত ক্ষণে ক্ষণে তোমার বিনম্র কণ্ঠস্বরে, শুনে যাই

সবচেয়ে বেশি আমি তোমার কথাই গৌরী রোজ
সানন্দে গ্রহণ করি নিজের খাতায়। কথাগুলো
রূপান্তরে প্রকাশিত আমার স্বাক্ষরে,
যদিও প্রকৃতপক্ষে আমি অনুবাদক ব্যতীত কিছু নই!

অমাবস্যাময়ী এক নারী

এখন বয়সের সেই সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছি,
যেখানে উষ্ণতার চেয়ে শৈত্যপ্রবাহ
প্রবল, যেখানে শরীরে যখন তখন আতশবাজি
ফোয়ারার মতো উচ্ছ্বসিত নয়, যদিও
সময়ের তিমিরাচ্ছন্ন গলিতে মুখ থুবড়ে পড়ার পরেও
প্রায়শ হৃদয় শবেবরাতের মোমবাতির উৎসব।

এখন আমি সেই নারীকে কামনা করি প্রতিক্ষণ,
যার যৌবন শারদ মধ্যাহ্ন থেকে হেমন্ত-গোধূলিতে
ঝুঁকে পড়তে কলেজের ছাত্রীর মতো উন্মুখ।
আমার কত সকাল আর দুপুর
স্পন্দিত তার কথার ষড়জে নিখাদে, কত সন্ধ্যা
হয়েছে দীপান্বিতা তার উপস্থিতিতে। তার কথাগুলো
আমি সতত পান করি, যেমন তৃষ্ণার্ত হরিণ
গোধূলির রঙ-লাগা ঝিলের জল।

মাঝে মধ্যে কে আমাকে নিক্ষেপ করে সিয়াহ গহ্বরে,
যেখানে মানুষ আর পশুর হাড়গোড়
বেকুর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে বিকৃত অন্ধত্বে? কে আমার
ওপর বিছিয়ে দেয় নিষ্ঠুর অনুপস্থিতির
ধূসর চাদর? কে আমাকে লকলকে শীতল জিহ্বায়
চাটতে থাকে প্রহরের পর প্রহর? কী করে সেই
গহ্বর থেকে পরিত্রাণ পাবো ভেবে পাই না। আমার
চৌদিকে ঝুলে থাকে নীরবতার মৌমাছি পুঞ্জ।
যার টলটলে অনন্তের ছোঁয়া-লাগা চোখ,
কখনো আনন্দে, কখনো বা বিষাদে
আল্পুত যার সৌন্দর্য, মাঝে-মধ্যে তার তার সঙ্গে দিনের পর দিন
দেখা-না হওয়ার করাত
আমাকে টুকরো টুকরো করে, আমার হৃৎপিণ্ডের
রক্তক্ষরণে অশ্রুপাত করে দোয়েল আর নক্ষত্রেরা।
কোত্থেকে অমাবস্যাময়ী এক নারী
তীক্ষ্ণ উলঙ্গতাকে নাচিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে;
ওর হিংস্র দু’টি বেড়াল-চোখ
আর দীর্ঘ ধারালো দশটি নোখ আমার
শরীর আঁচড়াতে থাকে। অসহ্য ব্যথায়
কাতরাতে কাতরাতে বলি, ‘কে তুমি?’ অন্ধকারকে
অধিক তমসাবৃত করে সে বলে, ‘আমাকে বেশ
ভালোই চেনার কথা তোমার। যারা জানে
ভালোবাসা কারে কয় তারা আমার
নাম রেখেছে বিরহ।

এই রমণীর কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে
সেই উল্লসিত সোনালি
নারীর উদ্দেশে হাত বাড়াই, যাকে
মিলন বলে শনাক্ত করতে শিখেছি কী স্বপ্নে, কী জাগরণে।
এখন তার না-থাকার কালো, লোনা পানির ঝাপ্টা
ঢুকে পড়ছে আমার হৃদয়ের ক্ষতে।

অশ্রুকণাগুলো

হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল; বসেছিলে
ভোরছোঁয়া, ঘোরলাগা সোফায় নিভৃতে। সামান্যই
কথা হলো, চক্ষুমিলনের
সুঘ্রাণ ছড়ানো সারা ঘরে;
তোমার পায়ের কাছে নম্র খেলা করে
শীতের হলুদ আভা, তখন আমার
ভারি ইচ্ছে হলো শুয়ে পড়ি
সেখানে কার্পেটে। অকস্মাৎ কী যে হলো-
তোমার দু’চোখ থেকে বইল জলধারা;
অশ্রুকণাগুলো শব্দহীনতায় বলে, ‘তোমাকেই ভালোবাসি।

আদিবার জন্মদিনে

শৈশবে কত খরগোশ আর বেড়ালের ছানা
ছিল তো তোমার সাধের খেলা সাথী।
এখন কখনো গাঢ় সন্ধ্যায় ভালোবাসে তুমি
তাদের স্মরণে জ্বালো কি মোমের বাতি?

সেই যে সেদিন দুপুর, বেলায় হলদে পাখিটা
খাঁচার ভেতরে ঠাণ্ডা রইল মরে,
তার কথা আজ বান্ধবীদের সঙ্গে মেশার
সময় কখনো হঠাৎ মনে কি পড়ে?

দু’বছর আগে যেমনটি ছিলে দেখতে হে মেয়ে,
তুমি তো এখন নয়কো তেমন মোটে।
তোমার শরীরে সোনালি দুপুরে, রূপালি নিশীথে
ক্ষণে ক্ষণে মেয়ে মায়াময় শোভা লোটে।

ষোল বছরের দুয়ারে পা রেখে চম্‌কে তাকাও
কোলে শুয়ে থাকা কুকুর ছানার দিকে;
পাখিদের ধ্বনি শুনতে না পেলে তোমার সকাল
অথবা দুপুর মনে হয় বড় ফিকে।

তুমিই তোমাকে ডাকছ অদূরে দাঁড়িয়ে আভাসে
অপরূপ তীরে,-যৌবন যার নাম।

সেই স্বর্ণিল তটে হেসে খেলে বেড়াবে কী সুখে,
হাওয়ায় উড়বে ঘন কালো কেশদাম।

ঘুমের মধ্যে তোমার অধরে যখন হাসির
কুসুম নীরবে পেলব পাপড়ি মেলে,
তখন তোমার মায়ের স্নেহের টলটলে হ্রদে
জ্যোৎস্না জড়ানো কত ঢেউ যায় খেলে।

কোনো ধুলিঝড়ে তোমার সুখের রঙিন প্রবাহে
যেন কোনোদিন না পড়ে কখনো যতি,
বলি তুমি মেয়ে হও যে আয়ুষ্মতী।

আমাকে বলে দেবে

এই শীতদুপুরে কোন্‌ দিকে মুখ রেখে তুমি দাঁড়ানো?
তুমি কি বসে আছো তোয়ালে বিছিয়ে
তোমার জীবনসঙ্গীর সান্নিধ্যে সমুদ্রতীরের চওড়া
রঙিন ছাতার তলায়?

চারদিকে রোদ ছড়ানো, জল আর বালি
চিকচিক করছে অভ্রের মতো; তোমার
টুকরো টুকরো কথা ভেসে বেড়াচ্ছে
হাওয়ায়, দৃষ্টি মেলে দিয়েছে সমুদ্রের বিশালতায়।

আকাশ আর সমুদ্রের মিলন দেখে
তোমার কি মনে পড়ছে আমাদের চুম্বনের কথা?
মনে কি পড়ছে আমাদের দু’জনের একান্ত
মুখোমুখি বসে থাকার মুহূর্তগুলো? মনে কি
পড়ছে উড়ে-যাওয়া সেই পাখির কথা, যে আমাদের
কোনো কোনো কথা ডানায় মেখে নিয়েছিল?

তোমার অনুপস্থিতির বেদনা সহনীয়
করে তুলতে চাইছি, অথচ অন্তর্গত এক অভাববোধ
কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরেছে আমার শ্বাসনালী;
শূন্যতার হারপুন আমাকে
শিকারে সফল ক্রমাগত। নিজেকে দেখতে পাচ্ছি অশেষ
এক কৃষ্ণ গহ্বরে অপ্রতিকার্যরূপে আটক।

কেন তুমি এভাবে চলে যাও পেছনে এক
দীর্ঘচঞ্চু ভয়ঙ্কর পাখিকে রেখে,
যে আমার হৃৎপিণ্ড ঠোকরাতে থাকে বিরামহীন
এবং আমাকেই পান করতে বলে রক্তধারা? কেবলি
তোমার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি, কী এক কুহক
আমাকে নিয়ে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন ফণিমনসার বনে।
কে এই দুঃস্বপ্ন-তাড়িত আমাকে মুক্তি দেবে
তুমি ছাড়া? এখন কি এই দুপুরের রোদ, সন্ধ্যার
পাখি, রাত্রির নক্ষত্র, শিশির অথবা জোনাকি,
বলে দেবে আমাকে এই মুহূর্তে তুমি কোথায়?

আশেক লেনের বাড়ি

বাইরে ঝোড়ো হাওয়া আর তুমুল বৃষ্টি;
এক সময় হাওয়ার বেগ এল ঝিমিয়ে, বৃষ্টির ঘুঙুরও
ক্লান্তিতে ঢিমে হয়ে বাজে, আকাশে
তারার ফুটে ওঠার কামনার স্তব্ধতা। আমার
মাথার ভেতর অনিদ্রার কুচকুচে কাক ডাকছে
অবিরত; লালন-গীতিকা নিয়ে চেয়ারে বসতেই
দূরের পথ থেকে ভেসে আসে কোনো বাউলের গলার
আওয়াজ নয়, মনে হলো এই ধ্বনি আমার খুব চেনা।
লালন-গীতিকা পড়ে রইলো টেবিলে আর
আমার চিনতে ক্ষণকাল দেরি হলো না কয়েক বছর আগে
ছেড়ে-আসা আমাদের কদিমী কালের
আশেক লেনের বাড়ির কণ্ঠস্বর।
সেই কণ্ঠস্বর আমাকে কেমন শ্যাওলা-জড়ানো
সুরে বলে, ‘তোমার বাসর রাতের আভার তাজগীতে
নববধূর মতো উদ্‌ভাসিত হয়েছিল
আমার পুরোনো হতশ্রী মুখ,
তোমার মনে পড়ে না? অনেকগুলো শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত, বর্ষা
তুমি কাটিয়েছ আমার নিবিড় সান্নিধ্যে।
আমার ছায়ায় বসে ছুটে বেড়িয়েছ তেপান্তরে, দেখেছ
পদ্মপাতায় শিশির, নারকেল গাছের মাথা দোলানো।
বর্ষার দিনে জল থই থই আমার উঠানে তোমার
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভাসিয়েছে কাগজের নৌকা, তোমার পিতা
ভেসে গেছেন অনন্তে আমারই এক বড় ঘরে অদৃশ্য ভেলায়।
স্কিটসৌফীনিয়া-অধিকৃত তোমার ছোট ছেলে
কত ঝাঁ ঝাঁ দাপাদাপিই করেছে আমার ঠাণ্ডা মেঝেতে;
কত দাঁড়কাক যে কী ভীষণ ঠোকরাতো ওর করোটিকে!

‘তোমার কবিতা লেখার খরাকালীন মুহূর্তগুলো
কতবার ভরিয়ে দিয়েছি সৃজনী ধারায়-
মানে, তোমরা যাকে প্রেরণা বলে থাকো,
সেরকম ভূমিকাই মাঝে-মধ্যে পালন করেছি নীরবে।
শুনছি, এখন তোমার সত্তায় খ্যাতির রৌদ্র-জ্যোৎস্না

লুটিয়ে পড়ছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল এই আমারই অঙ্গনে,
কবি হিশেবে তোমার নাকি খুব নাম ডাক
হয়েছে আজকাল। কিন্তু কই বন্ধু, হে সখা আমার, তুমি তো
আজ অব্দি আমাকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখলে না। অথচ
আমার চোখের নিচে কত কবিতাই তো লিখেছ কত বিষয়ে।

‘যখন ওরা শাবল কোদাল দিয়ে উপড়ে নিচ্ছিল
আমার হৃৎপিণ্ড, আমার হাড়গোড় গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল বুলডোজারে,
তখন আমার বিপন্ন অস্তিত্ব যে আর্তনাদ করেছিল
তা, রয়ে গেল তোমার শ্রুতির অগোচরে। আমি এখন
হাইরাইজ দালান, তবু মাঝে-মাঝে
বুক ঠেলে বেরোয় পুরোনো কান্না। হা কপাল, তুমি
একবারও দেখতে এলে না আমাকে। এই পাথুরে
শহরে বাস করতে করতে তোমার হৃদয়ও কি
কংক্রীট হয়ে গ্যাছে? নইলে এতোদিন, আমার মনোবেদনা
ফুটতো অন্তত তোমার দু’চারটি পঙ্‌ক্তিতে!
লালন-গীতিকার ওপর হঠাৎ একটা মাউথ অর্গান
মেতে ওঠে বাউলনৃত্যে, আর চমকিত আমি
ডায়েরি খুলে নিশুত রাতে কবিতা লিখতে শুরু করি
আমার যৌবনের প্রত্যূষ থেকে প্রৌঢ়ত্বের ঊষাকালে
সাক্ষী, আশ্রয়দাতা এবং সখা
আশেক লেনের সেই ক্ষয়াটে, থুত্থুরে বাড়ির উদ্দেশে।

এই আমার সাধনা

আজকাল ঘরেই বেশি থাকি; নিঃসঙ্গতার
শুড় যখন আমার গা বুলোয় মনোনীতার
স্পর্শের মতো,
দারুণ উপভোগ করি, দু’চোখ বুজে আসে।

কখনো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই,
বুক শেল্‌ফ থেকে তুলে নিই না-পড়া
কোনো বই, পাতা ওল্টাই, চোখ বুলোই, চাখি
একটি কি দু’টি পাতা; কখনো রেলিং-এ বসা প্রজাপতিকে
দেখি, চোখ জুড়োয় কখনো
শিল্পপল্লীর খয়েরি দালানের কার্ণিশে
ঠাঁই নেওয়া পায়রা যুগলের প্রণয় দৃশ্যটিকে
ধরে রাখি স্মৃতিতে। মনে পড়ে, টেলিফোনের
তারে ভেসে আসা কারো মধুর কণ্ঠস্বর, চকিতে
নতুন পড়া কোনো কবিতা
আমার ইন্দ্রিয়সমূহকে সম্মোহিত করে এবং
এর চেয়ে তৃপ্তিকর আর কী-ইবা হতে পারে?
এই ছায়াচ্ছন্ন নিঃসঙ্গতা আমার প্রয়োজন,
অথচ বাইরের রৌদ্রের চুম্বন, হঠাৎ
বৃষ্টির ছাঁট, বই মেলার সায়াহ্ন ছোঁয়া শব্দের
স্পন্দন আর কবিদের আড্ডা ছাড়াও
আমার চলে না। আকাশের নিঃসীম
শূন্যতার পাশাপাশি নক্ষত্রের মহফিল এবং
অপ্সরার ভুরুর মতো চাঁদ
আমার বড় দরকার। কেবল কোকিল দোয়েল
হলেই আমার সাধ মেটে না; শালিক, চড়ুই,
ফিঙে, ডাহুক, এমনকি কাদাখোঁচা আর দাঁড়কাকও চাই।
গোলাপ যে দেয় তার কাছ থেকে কখনো
সখনো গাঁদা কিংবা বনফুলও পেতে ইচ্ছে করে

এই সাত কাহন শুনে
তোমরা আমাকে কী আখ্যা দেবে, জানি না;
এই যে খাতার পাতায় জখমি সৈনিকের মতো
অসহায় ছড়ানো টুকরো টুকরো
কিছুউ স্তবক, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ রূপবান
না হওয়া অব্দি শান্তি নেই আমার।
ভগ্নাংশ নিয়ে আমার তৃপ্তি নেই,
পূর্ণতাই কাম্য এই অভাজনের।

অসুখ বিসুখ নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া-আসা চলবে
মাঝে-মাঝে, দীর্ঘ জীবন পেলে শোকের সঙ্গে
মুখ দেখাদেখি হবে অনেকবার। পথ
যত পাথরকীর্ণ আর কন্টকসংকুলই কোহ
আনন্দ সরোবরে বারবার সাঁতার কেটে বেঁচে থাকার
আজাঙ্ক্ষা জীইয়ে রাখব, এই আমার সাধনা।

একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখে

কনকনে শীত সন্ধ্যায় একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী
দেখতে গিয়েছিলাম। নামজাদা অনতিতরুণ
আলোকচিত্রীর অনেকগুলোর ফটোগ্রাফ
দেখবার সুযোগ কে হারাতে চায়
এবং সেই ফটোগ্রাফার যদি হন
বিশেষত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কেউ।

আলোকচিত্রমালায় সৃজনশীলতার স্পর্শ
আমার নান্দনিক বোধকে উদ্দীপিত করে, মুগ্ধতায়
বুঁদ হয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ
একটি ছবি আমাকে কাদাখোঁচার ধরনে
অসম্ভব ঠোকর মারে। সেই ফটোগ্রাফ নির্লজ্জ, ন্যাঙটো
গৌরবে তুলে ধরেছে এমন এক সংবাদপত্রকে,
যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, জাতিসত্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা
এবং প্রগতির নাছোড় দুশমন। একাত্তরের
শহীদ মুক্তমতি বুধগণ আর অন্যান্য বুদ্ধিজীবী, যাঁদের
লাঞ্ছিত করে সেই পত্রিকা বারংবার,
আমার উদ্দেশে বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে
বললেন যেন প্রদর্শনী কক্ষের বুক চিরে, ‘প্রতিবাদ করো।

শিল্পীকে আমি ছবিটি সরিয়ে ফেলতে সবিনয়ে
অনুরোধ জানালে তিনি আমাকে
মানবতার কিছু সবক দিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে
নিজের জেদের ঝুটি আঁকড়ে রইলেন। উন্নাসিক, কলাকৈবল্যবাদী
অধ্যাপকের ঢঙে দর্শকদের জানিয়ে দিলেন
রাজনীতি ধুলোয় গড়ায় আর মানবতার অধিষ্ঠান
আকাশছোঁয়া পর্বতচূড়ায়। পেরুবিষয়ক
একটি ছবি তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন ক’জন তরুণ-তরুণীর কাছে।

আমার মুখের ভেতর তখন থুতুর লাভা, থুতু সেই
আপত্তিকর পত্রিকার ফটোগ্রাফের দিকে না কি নিজের সত্তায়
ছুঁড়ে দেবো স্থির বলতে না পেরে একটি শিং-অলা
ক্ষুব্ধ হরিণের মতো প্রদর্শনী-কক্ষ থেকে নীরবে বেরিয়ে গেলাম।

একটি দোয়েলের জন্যে

শীত বিকেলের পড়ন্ত রোদে
টিভি ত্র্যান্টেনায় এসে বসলো
একটি দোয়েল। ভাবছি,
গানে-পাওয়া এই পাখি তার পারি
ছন্দোবদ্ধ সেই শব্দস্তবক।
হে পাখি, আর কতক্ষণ তোমার শিস
হাওয়াকে সঙ্গ দেবে? মুগ্ধ করবে
আমার মতো মর্ত্যজীবীকে?

কে আছে এমন যে তাড়িয়ে দেবে
এক ঝটকায় এরূপ মাধুর্যকে?
ছোট্র এ সুন্দরকে অকস্মাৎ গুলিতে
বিদ্ধ করবে কোন্‌ পাষণ্ড?

তবু আশঙ্কা-মেঘে
ঢেকে যায় মন, একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকি
সঙ্গীতময় ত্র্যান্টেনার দিকে এবং
তোমার মুখ
সুদূর ছায়াপথ বেয়ে
নক্ষত্রের ভিড় উজিয়ে
আমার কাছে এল নিঃশব্দে, যেন
চাঁদের পালকি থেকে নামলে তুমি।
আমি সিএ দোয়েলকে
মিনতি জানালাম
তোমার উদ্দেশে একটি প্রেমের গান
গাইবার জন্যে। অথচ পাখি কখন উড়াল দিল
জানতে পারিনি। অপ্রস্তুত আমি
আমার থরথর হৃদয়কে
একটি দোয়েল কিংবা কোনো গুণীর তান হয়ে উঠার জন্যে
নিজের সত্তায় অজস্র তারা ফোটাতে থাকি।

কবি সম্পর্কিত মেডিক্‌ল্‌ বুলেটিন

আট বছর পর কবিকে আবার ডাকছে
স্ট্রেচার, নার্সের হাঁস সফেদ ত্র্যাপ্রোন, মেজার গ্লাস, শীর্ণ বেড, স্টেথিস্কোপ
চিকিৎসকের ঝুঁকে থাকা,
অনুসন্ধানী চোখ;
কবিকে হাসপাতলের বেড ডাকছে পাঁশুটে আঙুল নেড়ে।

বুলেটিন-১
যে পাড়ায় কবির বসবাস, সেখানকার
সবগুলো গাছ পাতা হারিয়ে এখন কংকাল,
টবের প্রতিটি ফুল প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই
পোকার খোরাক-হয়ে যাচ্ছে বেশ ক’দিন থেকে,
প্রতিক্রিয়ার
ইদানীং কবির বিবমিষা, ভেদবমি।

বুলেটিন-২
শহরময় দাঁড়কাকের দাপট সহ্যশক্তিকে
হামানদিস্তায় ভীষণ গুঁড়িয়ে দিয়েছে;
কোকিল-তাড়ানো দাঁড়কাকের দঙ্গল ক্রমাগত
ঠোকরাবে নান্দনিকতা আর মানবিকতাকে;
কোকিলের গানবিহীন ধূসর বসন্তের দিকে তাকিয়ে
কবি খুকখুক কাশছে, কাঁপছে ঘুসঘুসে জ্বরে।

বুলেটিন-৩
সিংহভাগ ভোটারহীন ভোটকেন্দ্রে ভূতুড়ে ভোটভর্তি
বাক্সগুলোকে হৈ হৈ ফুলচন্দন দিয়ে
ঢোল-শোহরতে অবৈধ সাংসদদের রুপালি পালকিতে চড়িয়ে
বসানো হয়েছে কুরসিতে। লাঠিচার্জ,
টিয়ারগ্যাস, রবার বুলেট, খালিশ গুলি, নরহত্যা-
অতঃপর কবির ঘনঘন রক্তবমন।

বুলেটিন-৪
সিন্দাবাদের বুড়োর মতো মানুষের কাঁধে চেপে-বসা
মেকি সরকারের অঙ্গুলি হেলনে, আজব কাণ্ড,
সেনাবাহিনী মোতায়েন ঘাসফুল, ফড়িং
প্রজাপতি আর পাখির নীড় সমুদয়
ক্রুদ্ধ বুটের তলায় পিষে ফেলার জন্যে। স্পেশালিস্ট
চিকিৎসকদের ডায়াগনসিস-কবি সম্প্রতি মানসিক রোগী।

বুলেটিন-৫
আখেরে ক’দিন ইন্টারোগেশনের পর কবিকে বিশেষ
ব্যবস্থাধীনে হেমায়েতপুর পাঠানো হলো! তামাম শুদ্‌

কবির অনুগামী

‘আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে; এই সব
সভা সমিতির কোলাহল,
এ পুনরাবৃত্তি
আমাকে ক্লান্তির ঘাটে ভিড়িয়ে দিয়েছে অবেলায়’,
বলে তিনি দ্যাখেন বিস্ময়ে
এখন চাঁদের মুখে অন্তঃসারশূন্য কথামালা,
খসড়া প্রস্তাব আর সাড়ম্বর গঠনতন্ত্রের
ছাপ লেগে আছে, যেন বসন্তের দাগ। হঠকারী
শ্লোগানসমূহ নক্ষত্রের পাড়ায় জাগায় ত্রাস
ঘন ঘন, চতুর্দিকে মেধার মড়ক।

তিনি প্রায় দাঁড়াতে অক্ষম, হাঁটু যন্ত্রণায় চাপে
বেঁকে যেতে চায়, জুতো জোড়া
ভীষণ অস্বস্তিকর ঠেকে, ছোঁড়া মোজা
বড় ঢিলে, কবিদের মঞ্চে অ-কবিতা
করে দাপাদাপি, অসহায় নতমুখ কবি নষ্ট
শোরগোল থেকে আস্তে করেন প্রস্থান।
করতালি-রহিত, ব্যথিত
কবির পেছনে যায় জোনাকি, মল্লিকা, প্রজাপতি,
মেঘ, শিরিষের পাতা, বিনীত দোয়েল
নক্ষত্রের গহন মিছিল।

কাজী নজরুল ইসলামকে নিবেদিত

আপনি এবং আমি, নজরুল ইসলাম, আমরা দু’জন
পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে চলেছি কেবলি। আপনার এখন তো
কিছুই কেনার নেই; আপনার ভাণ্ডার সে কবে থেকে পূর্ণ,
আমি আজো শূন্য হাতে ফিরি কখনো দুঃখিত ঘাটে,
কখনো বা আঘাটায়। আপনার কোনো তাড়া নেই প্রকৃতই;
কেবল যে কালো বুনো ঘোড়াটা সে রাতে অতিশয় ম্রিয়মাণ
হাসপাতালের বেডে ফেলেছিল কেমন নিঃশ্বাস বারংবার,
তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে হয়তো বা, নাকি অন্য দৃশ্য কোনো?

আপনি এবং আমি, নজরুল ইসলাম, আমরা দু’জন
পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে চলেছি, মরুভূমি, মরূদ্যান
পেরিয়ে পেরিয়ে বনভূমি এসেছি বিপণী কেন্দ্রে আপাতত।
তাহলে শুনুন কবি, দোহাই পথের, কিছু কথা, যা এখনো
অকথিত, জানতে ইচ্ছে করে খুব-যখন সে কালো ঘোড়া তার
কেশর দুলিয়ে আপনাকে পিঠে নিয়ে ছুটে গেল মেঘলোকে
তখন কি কারো মুখ দেখবার আশায় আপনি আপনার
অমন বিখ্যাত চক্ষুদ্বয় মেলে দিয়েছিলেন ব্যাকুল চতুর্দিকে?
আপনার সাধ কবিতার বাগান বাড়ির মতো অন্তরালে
বড় বেশি ছায়া-ঢাকা রয়ে গেছে, আপনিও আর্ত মহাদ্বীপ!

নজরুল ইসলাম, উদার রাজার মতো চলেছেন হেঁটে
আর আমি আপনার পাশে সংকুচিত সর্বক্ষণ, অথচ কী
ব্যাকুল হাঁটছি একা-একা। কিছুই কেনার নেই আপনার,
অতিশয় নিঃস্ব আমি, আমার রসদ চাই সকাল-সন্ধ্যায়।
আমাকে কিনতে হবে এখনো অনেক কিছু-এই তো দোকানে
সোনালি আপেল আর সুনীল গীটার, মুখচ্ছবি-চিত্রকল্প
টোমাটোর অন্তরালে উপমা এবং আঙুরের অন্তঃপুরে
প্রতীক কিনতে হবে। আপনার কিছুই কেনার নেই আর।

কী সুদীর্ঘ অমাবস্যা ছিল

কী সুদীর্ঘ অমাবস্যা ছিল চতুর্দিকে,
বাদুড়ের ওড়াউড়ি, শেয়ালের কর্কশ চিৎকার
ছিল ভ্রষ্ট কালের জঠরে।
নেকড়ের হিংস্রতার মতো
ঝাঁঝালো বাতাস
খাবলে নিচ্ছিল নরমাংস ক্ষণে ক্ষণে,
কী এক অসুখ ভর করেছিল সবার ওপর-
কেউ কারো মুখ দেখে
ভরসা পেত না কিছুতেই, অনাস্থার অব্যর্থ বৃশ্চিক
চোখে মুখে বুকে সেঁটে ছিল সর্বক্ষণ।

তবুও ঘোড়েল কিছু লোক অন্ধকার
ছুঁড়ে ছুঁড়ে এক্কা দোক্কা খেলে
জমিয়েছে প্রভূত পসার নষ্টামিকে
পুঁজি করে, ওদের কুটিল চোখে ছিল
অফুরন্ত নোংরা ফেরেববাজি,
মুখের গহ্বরে লুফে লুফে
ধর্মের অসিদ্ধ ফাঁপা বুলি
ছড়িয়েছে তীব্র কূট আর্সেনিক মানব সমাজে।
এদের সগোত্র যারা তারা দেশে দেশে
সোৎসাহে নিষিদ্ধ করে গ্রন্থ আর পোড়ায় আক্রোশে
প্রসিদ্ধ শিল্পীর চিত্রমালা।
শত অনর্থের ধুম্রজালে নৈরাশ্যের গহ্বরেও
অনেকে আলোর জন্যে করে এবাদত,
ফসল ফলাতে চায় প্রেমে আর মননের ব্যাপক খরায়।
নান্দনিক ভাষা খুঁজে পায়। ইতিহাস
তাদের নিকট-
পাঠায় অজস্র প্রজাপতি; এই সব মানুষকে ঘিরে
রূপালি ঝর্ণার উচ্ছলতা,
দিগ্ধলয়ময় রঙধনুর স্ফূরণ,
অক্ষরবৃত্তের আভা, ইতিহাস প্রেরিত বর্ণিল
অগণিত প্রজাপতি, পাখির উড়াল।

 কে আমাকে অমন ডাকে

শয্যাশায়ী ছিলাম ক’দিন। বিকেলে
শয্যার পাশে আমাকে কিছু একটা
হাতড়াতে দেখে
ঘরের দেয়াল ভাবল ভ্রম হয়েছে
আমার। আসলে আমি যে
তখন কল্পরাজ্যে কিছু চিত্রকল্প এবং প্রতীক
কুড়োতে মগ্ন তা দেয়াল, লেখার টেবিল,
বুক শেল্‌ফ্‌-কেউই ঠিক
ঠাওর করতে পারে নি।

মৃদু হেসে পাশ ফিরে শুতেই
কোথাকার এক ক্ষ্যাপা বাউল ঘরে ঢুকে
দোতারা বাজিয়ে জুড়ে দেয় নাচ। এ কোন্‌ সাঁই
আমার কবিতার খাতার মরুভূমিতে
সুরের ঝর্ণাধারা মুদ্রিত করতে চায়?
তাকে বারণ করা সাধ্যাতীত ভাবছি,
এমন সময় একজন তরুণ কবি
এবারের বইমেলায় তার কোনো কবিতার বই
প্রকাশিত না হওয়ার দীর্ঘশ্বাসে
আমাকে ডুবিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। আমি
তার দীর্ঘশ্বাসের স্বরলিপি টুকে রাখার জন্যে
বলপেন হাতে তুলে নিতেই
সে নিমেষে গেল শৈত্যপ্রবাহে আর
তখনো আমার ঘরে ক্ষ্যাপা বাউল
কখনো ভুল ঝাঁকিয়ে, কখনো পাক খেয়ে
নিয়ে আসে ধু ধু গেরুয়া প্রান্তর, গহন ছায়া।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর কে আমাকে অমন ডাকে
বারবার ফাল্গুনের দুপুরে?
কোনো কোকিল অথবা দোয়েল নয়,
যেন এক বুকচেরা আর্তনাদ আপন
শহরের চৌদিক থেকে উঠে আসছে ক্রমাগত;
ব্যাকুল বেরিয়ে পড়ি গলির মোড়ে,
খোলা রাস্তায়। বুলেটবেঁধা বাংলা ভাষার
রক্তস্নানে বিহ্বল আমি
ওর বুক থেকে সীসাগুলো তুলে নিয়ে সেখানে
গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশ রেখে দিই নত মাথায়।

কোকিল কাহিনী

একটি কোকিল খুব আড়ালেই থাকে সর্বক্ষণ; কেউ তাকে
সহজে দ্যাখে না কোনোখানে, ঘর দোর
কিছু নেই, গুছিয়ে-টুছিয়ে
বসবাস বস্তুত স্বভাবে নেই তার। একজন
কমজোর নজরের কবি শত চেষ্টা চরিত্তির
করেও স্পস্টত ওকে আজ অব্দি দেখতে পায়নি।

কোকিলটি সুর তোলে গ্রীষ্মে ও বসন্তে অবিরত,
এমনকি কনকনে শীতেও কখনো।
হঠাৎ কী হলো তার এক ঝাঁক সুরছুট পাখির সংসর্গে
গিয়ে গান ছেড়ে কিছু কর্কশ আওয়াজে
মেতে ওঠে ঘন ঘন; গান ওকে ছেড়ে
যায়-যায়। কিছু কাল পর
কোকিল সংবিৎ ফিরে পেয়ে
গলায় ফোটাতে চায় গানের গোলাপ।

অথচ ঝরে না সুর, কণ্ঠ ছিঁড়ে যেতে
চায় বিসদৃশ
স্বরের ধমকে; শেষ রাতে কোকিলের বুক থেকে
হঠাৎ বেরোয় তাজা রক্তের ঝলক
এবং আখেরে সেই মুমূর্ষ পাখির
কণ্ঠের অকূল ব্যাকুলতা বেয়ে ঝরে
শুধু গান, নতুন, অতুলনীয় আর
মুগ্ধতায় মগ্ন হয় প্রত্যুষের আভা, পথ, শিশির, গোলাপ।

ক্লিনিক থেকে ফেরার পথে

দূর থেকে বাড়িটাকে মনে হয় অনেক
কান্নার বাষ্পরাশি আর হাসির রৌদ্র দিয়ে তৈরি।
কখনো কখনো মনে হয়, একজন প্রত্যাশা-বৃক্ষ
তার প্রসন্ন ছায়া বিছিয়ে
দাঁড়িয়ে আছেন-সেখানে আমার মাকে
তাঁর তিরাশি বছরের রৌদ্রছায়া সমেত
রেখেছি। তাঁর হৃৎপিণ্ডে
বড় রকমের একটি ধাক্কা লেগেছে।

দু’দিন পর যখন
বেডের পাশে তাঁর হাত ধরে
বসেছিলাম, তিনি তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যেও
ঘরের ভাড়া কত জানতে চাইলেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে। মা আমার,
নিজের শারীরিক যন্ত্রণা এবং
পুত্রের আর্থিক সঙ্গতিকে এমন মুহূর্তেও
তুলাদণ্ডে স্থাপন করলেন দেখে
আমার বুকের ভিতর কেমন হু হু করে ওঠে।

‘কখন আমি বাড়ি যাব’ বাক্যটি
কেন যে তিনি আবৃত্তি করছেন বারবার,
কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করি।
এই রাতে এখন আমাকে যেতে হবে তাঁকে ছেড়ে,
তাঁর সঙ্গে রাতে থাকবে আমার কোনো বোন
অথবা অন্য কোনো নারী
রোগশয্যার পাশে মেয়েদের করতে হয় রাত্রিযাপন!
এখন আমার খুলির ভেতর, শিরায়
বুলবুলি মতো নাচানাচি শুরু করেছে
একটি পঙ্‌ক্তি; ঐ তো আমার লেখা আমাকে ডাকছে।

ছুটতে থাকি

হঠাৎ জেগে উঠে দেখি মধ্যরাত। আন্ধার ঘরে
এক গা ঘেমে কেমন হাঁসফাঁস করি,
মনে হ’লো একটা অক্সিজেন মাস্ক হলে বাঁচি। বিছানায়
অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও নির্ঘুম।

কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম
কে যেন কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে; সেই
ক্রন্দনধ্বনিকে অনুসরণ করে পৌঁছে যাই
পড়ার ঘরে। জানলার শিক নয়, বুক শেলফ নয়,
পর্দা নয়, আমার পুরনো লেখার টেবিলের
বুক চিরে বেরুচ্ছে কান্না। এর আগে
কোনোদিন এরকম কিছু ঘটেনি। কে এই
তরুণী যে নিশুত রাতে ঝরিয়ে দিচ্ছে মনোবেদনা?
কাঠের টেবিল বেদনার্ত স্বরে বলল
একটি বনের কথা, তার বৃক্ষ স্বজনদের বৃত্তান্ত,
সে বললে এক যুবক-গাছ আর
তার প্রণয় কাহিনী। হাওয়ার দোলায় ওরা
পরস্পর মুখচুম্বন করত সক্কালবেলা, জ্যোৎস্নারাতে,
এত কাছাকাছি ছিল দু’জন।

একদিন বিহানবেলা কিছু লোক ওদের কেটে
সাফ করল বনের একাংশ আর সে কী কান্নার
রোল পড়েছিল সেদিন। বিরহিনী গাছ-তরুণী
আখেরে ছুতোরের কারিগরির সুবাদে
পেলো টেবিলের ডৌল, যার ওপর
এখনো চাপানো রয়েছে কিছু বই, রাইটিং প্যাড, টেবিলল্যাম্প
টেলিফোন সেট আর গাঢ়-নীল ডায়েরি,
যাতে আমি অনেক খুঁজে খুঁজে
জড়ো করেছি বিস্তর নক্ষত্রকণা এবং
প্রবালের টুকরো। আমি চেয়ারে বসে
ব্যথিত হৃদয়ে শুনলাম গাছ-তরুণীর
প্রিয়-বিচ্ছেদের কাহিনী।

লেখার টেবিলের কান্না থামতেই, সেখান থেকে
হাঁস আর বীণা হাতে উঠে এলেন
এক অনিন্দ্য প্রতিমাপ্রতিম নারী
সফেদ হাঁসের ডানার একটি পালক খসিয়ে আমার হাতে
তুলে দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে এ আমার উপহার
এখন থেকে এটাই হোক তোমার লেখনী।

হাঁসের পালক ভাসতে থাকে হাওয়ায় আর
আমি তার পেছনে পেছনে ছুটতে থাকি ছুটতে থাকি।

জনৈক মানসিক রোগীর খাতার কয়েকটি পাতা


বাড়িটার এই ঘরে অনিদ্রার গন্ধ খুব তীব্র আর চার
দেওয়ালের না-কামানো দাড়ি যেন বা জঙ্গল
দরজা জানালা মুখ খিঁচিয়ে রয়েছে
টেবিলটা বিড়বিড় করে
সারাক্ষণ, মাঝে-মাঝে শুনি
একটানা ভোরবেলা কিংবা সাঁঝে কাপড় ছিঁড়ছে।
কেউ, দেয় হানা এক পাল
আগুনে নেকড়ে, মাংস ছিঁড়ে খায়, বালিময় ঢেউ
আমাকে আছড়ে চিরে চিরে
দ্যাখে প্লীহা, যকৃৎ যুগল ফুসফুস, বৃক্ক, ঘিলু।


গাছগুলি হেঁটে গিয়ে গলি ছেড়ে চায়ের দোকানে
থামে, কিছু কথা ডানেবামে বলাবলি করে
পরস্পর; চায়ের পিপাসা নেই, উড়ে
যায় দূরে নীলিমায় নক্ষত্রসভায়। এই আমি
গাছের কোটরে বসে বহুদিন আয়ত্ত করেছি
পাখিদের ভাষা, আজকাল
এমন হয়েছে হাল মানুষের ভাষা প্রায় ভুলে
কলা পাতা, গিরগিটি, ধুলো লাল কালো পিঁপড়ে আর
মেঘেদের
সকল শব্দীর্থ শিখে নিয়েছি গোপনে।
এ মর্ত্যের গাছ
কালপুরুষের সঙ্গে নাচ জুড়ে দেয় মধ্যরাতে,
যখন প্রবীণ প্যাঁচা চালায় বুরুশ নিসর্গের ঘন চুলে।


লার্গাকটিলের টিলা থেকে
গড়িয়ে গড়িয়ে দেখি মলিন পাঞ্জাবি পরে চাঁদ
নিজের কবিতা পড়ে মহাশূন্যে, শ্রোতাহীনতায়
হতাশায় নেমে আসে এই ঘরে টেবিলের নিচে।
স্মৃতিভ্রংশের ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে মনে পড়ে-
পায়নি ব্রাশের স্পর্শ সাত দিন আমার দাঁতের পাটি, মুখ
ধুইনি বস্তুত কিছুদিন, তেলহীন রুক্ষ চুলে
চিরুনির মিহি দাঁত করেনি যে খেলা কতকাল।
কালে ভদ্রে আবছা স্বপ্নে স্খলিত বীর্যের চিহ্নগুলি।
ত্বকে লেগে থাকে আর কোনো খাবার রোচে না মুখে কিছুতেই।

এখন আমাকে দেখে সবাই কেমন
বিপন্ন সন্ত্রস্ত বোধ করে। বন্ধ ঘরে সারাক্ষণ সঙ্গীহীন
বসে থাকা কিংবা পায়চারি করা, দেয়ালের দিকে
দু’চোখ নিবদ্ধ রাখা যেন ওরা বরাদ্দ করেছে

এই না-মানুষ না-জন্তুর জন্যে; শুধু করুণায়
বাঁধেনি শেকলে পাঠায়নি পাগলা গারদে। আমি
পরিত্যক্ত, অস্পৃশ্য এ মনুষ্যসমাজে; ভাই-বোন
পিতার উদ্বেগ আর মায়ের নির্জন অশ্রুধারা ছাড়া কোনো
আশ্রয়ের ধু ধু রেখা নেই। দয়িতার দেখা নেই
কতদিন শুয়োর চিবিয়ে খাচ্ছে নার্সারির উদ্ভিন্ন গোলাপ।


লাওয়ারিশ লাশের মতো পড়ে থাকে আমার খাতা
কখনো টেবিলে, কখনো খাটে-পাতা বিছানায়;
হায়, এর চেহারায় কাদের দাঁত-নখের
কামড় আঁচড় লেগেছে? অথচ আমি ছাড়া এর অন্য কোনো
ধারক বাহক নেই; আমিই কি অজ্ঞাত হিংস্রতায়
তার মুখমণ্ডল ছিঁড়েখুঁড়ে
ফেলতে চেয়েছি বিনিদ্র রক্তজবা-প্রহরে? মাঝে মধ্যে যখন ওকে
মরুতুল্য বুকে জড়িয়ে ধরি তখন সে ডুকরে ওঠে হঠাৎ,
ওর চোখের জলে রাতদুপুর ভিজতে থাকে,
এই ঘর হয়ে যায় থই থই পুকুর।

আমার মাথার ভেতর খাতাটার পাতাগুলি
ঝোলে রক্তপায়ী বাদুড়ের মতো এবং অ্যাম্বুলেন্স, রাত্রির বুকফাটা বিরান
আর্তনাদ, ছিন্ন মস্তক, মর্গের উৎকট গন্ধের মধ্যেই
শেষ পর্যন্ত দুঃস্বপ্নসদৃশ খাতাই আমার সহৃদয় অভিভাবক।

জীবনানন্দকে নিয়ে

এই যে কবিতাটি আজ লিখছি শীতসকালে
এটি যদি আমার সদ্যতারুণ্যে
চুলের মুঠি ধরে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতো
প্রেরণা নাম্নী চঞ্চলা তবেই হতো সমীচীন।

আজ যখন আমার বয়স গোধুলি ঘাটে বসে
ঈষৎ যন্ত্রণায় সেই না-লেখা কবিতাকেই
ডেকে আনছি গর্ভধারণে উন্মুখ খাতায়।

কবিতাটি লিখতে গিয়ে শুরুতেই
ব্যবহার করে ফেলি শিশির;
শব্দটি তক্ষুণি কেটে দিলাম জীবনানন্দের
ধূসর পাণ্ডুলিপির কবিতা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

অন্য একটি ছত্রে ছটছটে ঘাসফড়িং এসে বসতেই
ওকে চটজলদি উড়িয়ে দিতে হলো
জীবনানন্দীয় ঘ্রাণ পেয়ে এবং
ঘাইহরিণী আমার মনে পা রাখতেই থামতে হলো
ওকে ঠাঁই দেওয়া গেল না
কোনো পঙক্তিতে। একটি লাইনের শেষে
আছড়ে পড়ল ধানসিঁড়ির নরম জল
আর অমনি সেই ছলছলানি ঢাকা পড়ল বলপেনের কালোয়।

এই ভোরবেলা, যখন রোদ বারান্দায় বিশ্রাম নিচ্ছে
হরিণের মতো, প্রাতঃস্মরণীয় জীবনানন্দ
বড় বেশি জ্বালাতন করছেন আমাকে। মনের মতো
কোনো একটি পঙ্‌ক্তিও
লিখে উঠতে পারছি না তাঁর উৎপাতহীনতায়।
এই মুহূর্তে, যখন সবাই
প্রত্যেকের কাজ করছে কম বেশি দক্ষতায়,
আমার খাতার পাতায় শুধু অমাবস্যা।

এই হতাশার হাতুড়ির ঘায়ে কী করি?
লুপ্ত আমার কূলকিনারা?
এখন জীবনানন্দকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে
আট্‌কে না রেখে তাঁরই শব্দগুলোকে আনকোরা পরিপ্রেক্ষিতে
স্থাপন করে কুড়িয়ে নেবো অক্ষরগুলো, খাতার
অমাবস্যাকে বদলে দেবো পূর্ণিমায়।
দেখি তিনি কী করে
আমার নিজস্ব পঙ্‌ক্তিমালার মাঝখানে এসে দাঁড়ান?

তিরাশি বছর

জানা মুশকিল ছিল, এতটুকু ছিল না আভাস;
কালো রাত্রি আগুন রঙের চোখ ভীষণ পাকিয়ে
ওৎ পেতে ছিল,
নিচু-হয়ে-আসা আকাশের
কোঁচকানো ভুরু থেকে কিছু
কালো ঝরে ছিল।
অকস্মাৎ লাফ;
লালসিক্ত মুখের গহ্বরে পোরা হ’লে
একটি কাহিনী ভাঙা কলসের পানির ধরনে
গড়িয়ে গড়িয়ে চিহ্নহীন হতে পারে।

বুভুক্ষু নিশীথ আচানক ভীষণ হিংসুটে সেজে
তিরিশটি বছরকে নিজের গুহায়
এক ঝটকায় গ্রাস করবার ব্যর্থতায় আরো
কুচকুচে; চিদ্রাহীন অনেক চোখের
আর্দ্রতার নিচে
শীতের পাতার মতো কম্পন্ন বছর।

তিরাশিটি সম্পন্ন বছর
নারীর গর্ভের শিশুটির মতো নিশীথের গুহা
ঠেলে প্রাণপণে
নিষ্করুণ ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে
প্রত্যুষের স্ফীত স্তন থেকে শুকনো পিপাসার্ত ঠোঁটে
সুধারস টেনে টেনে হয়ে ওঠে জীবন আবার।

তুষার-কবরে

এই কবিতা কি লিখতে পারবো শেষ পর্যন্ত?
‘তুমি নেই’ শব্দ দু’টি লাফিয়ে-ওঠা
মাছের মতো আমাকে স্পর্শ করার সঙ্গেই
আমার কলম ছাড়লো দীর্ঘশ্বাস,
আমার কবিতা লেখার খাতা জুড়ে
পোড়োবাড়ির হাহাকার;
নিমেষে ঝাপসা হয়ে এল বর্ণমালা, স্বরবর্ণ থেকে
ব্যঞ্জনবর্ণের পার্থক্য বোঝা
যাচ্ছিল না কিছুতে। না-লেখা পঙ্‌ক্তি দু’টির চোখে
জমে ওঠে শিশির।

শীতার্ত আঙুলের আলিঙ্গনে আমার কলম স্থবির;
জানলায় তোমার মুখ
রাখলে কী করে এই ভরসন্ধ্যায়? তোমার চোখ,
স্বর্ণাত গাল আর রঙিন ঠোঁট এমন জীবন্ত যে,
এই দৃশ্যটিকে দৃষ্টিভ্রমের ফল বলে ভাবতে পারা গেল না।
জানলা আর দেয়াল ভেদ করে নিশ্চিত
তুমি এসে দাঁড়াবে পাশে, বসবে শূন্য চেয়ারে,
খেলবে শাড়ির আঁচল নিয়ে, টেবিল থেকে
হাতে তুলে নেবে নতুন কোনো কবিতার বই অথবা
কোনো লিটল ম্যাগাজিন। হয়তো
গাঢ় তাকাবে আমার দিকে, পাঠ করতে চাইবে
আমার মুখের রেখাবলীর টেক্সট।
এসব কিছুই ঘটবে না; কেননা জানলায় তোমার
মুখ ছিল না, সেখানে এই মুহূর্তে
অনুপস্থিতির কুয়াশাময় ঊর্ণাজাল
ঝুলছে এবং আমার সত্তায়
তুষারাবৃত মেরুপ্রদেশের তীক্ষ্ণ নির্জনতায়।
এক পর্যটকের ছায়া আর ক্ষুধার্ত নেকড়ের চিৎকার।

কাঙ্ক্ষিত কবিতাটি শেষ পর্যন্ত তুমিহীনতার
তুষার-কবরে জমে থাকবে চিরকাল।

তোমাকে মনে পড়া না-পড়া

শহরের বুকে চেপে বসেছে একটা ভেজা কালো কম্বল
এবং আমি আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গে
পেশেন্স খেলছিলাম অনেকক্ষণ থেকে। ভাবছিলাম,
ঘরের ভেতর অন্তত কোনো বেড়াল থাকলে ভালো ছিল।

তুমি চলে যাবে অনেক দূরে, এই ভাবনার
রোমশ ইঁদুর যখন ধারালো দাঁতে
বেশ দক্ষতায় কাটছিল আমার হৃদয়তন্ত্রী, হঠাৎ
টেলিফোন গায়ক পাখি হয়ে উঠল;
তোমার কণ্ঠস্বর স্পর্শ করল আমাকে, চুম্বনের
স্বাদ পেলাম যেন। তুমি বললে, ‘কী করে থাকব
তোমাকে না দেখে? আমাকে বলে দাও কবি। আমার
কথা মনে কি পড়বে তোমার? কোন্‌ প্রহরে
আমাকে মনে পড়বে?

কিছুক্ষণ নীরবতাকে বইতে দিয়ে বললাম, যদি বলতে
কোন্‌ মুহূর্তে মনে পড়বে না তোমাকে,
তাহলে উত্তর দিতে পারতাম খুব সহজে।
যখন চুলে চালাব চিরুনি মনে পড়বে তোমার কথা;
যখন রবীন্দ্র রচনাবলীর পাতা ওল্টাবো,
তোমাকে মনে পড়বে আমার;
যখন কবিতা লিখতে বসব, তোমার ভাবনা
আমাকে আলিঙ্গন করবে; যখন
গোধূলিবেলা আকাশে পাখির পঙ্‌ক্তি
চোখে পড়বে, তোমার মনে পড়বে; যখন
নির্ঘুম শয্যায় এপাশ ওপাশ করব, কুয়াশাময়
পথের নিস্তব্ধতাকে অনুভব করব, তোমাকে ভাবব।

‘যদি গহন রাতে কালো আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে
হঠাৎ মৃত্যু এসে আমার দিকে
দাবা খেলার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, তোমার
এই অপটু, অনভিজ্ঞ কবি সেই মহূর্তে তোমাকেই স্মরণ করবে।

তোমাদের মুখ

তোমরা কি এখনও দেখতে পাচ্ছ না
তোমাদের মুখ? পাঁচ বছরে কী কদাকার আর বীভৎস
হয়ে উঠেছে তোমাদের মুখ,
তা কি চোখে পড়ছে না এখনও?
এত অন্ধ তোমরা যে
নিজেদের কদর্যতা, হিংস্রতা, স্বেচ্ছাচারিতা,
নগ্ন বর্বরতা-সব কিছুই এখনও
পরম মোহনীয় ঠেকছে!

মানুষের ভোটাধিকার তোমরা
কেড়ে নিয়েছ, তামাশা বানিয়েছ
গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে।
তোমাদের নির্লজ্জ জালিয়াতি
সংসদকে রূপান্তরিত করেছে
সার্কাসের তাঁবুতে, যেখানে
নকল, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লদের
ভাঁড়ামো, জনতার হুঙ্কারে
মসনদ টলোমলো, অথচ প্রতারণা এবং
ধোঁকাবাজিতে দখল-করা সিংহাসন
আঁকড়ে থাকার কী লকলকে লালসা
তোমাদের মুখে ঝুলে রয়েছে।

তোমরা তোমাদের শিকারি কুকুরদের
ছেড়ে দিয়েছ নিরস্ত্র মানুষের
কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলার জন্যে।
তোমরা হত্যা করেছ কৃষকদের
ছাত্র আর রাজনৈতিক কর্মীদের,
তোমরা জেলখানায় পুরেছ প্রতিবাদী মানুষকে।
তোমরা তখন লাঠির আঘাতে ভূলুণ্ঠিত করেছ মতিয়া চৌধুরীকে, তখন
বাংলাদেশ প্রমিথিউসের চোখের মতো
ঝরিয়েছে আগুন।

তোমরা লাল শাপলার ফুল, দোয়েল,
কোকিল আর কৃষ্ণচূড়াকে পদদলিত করেছ,
কবিতরদের টুকরো টুকরো করে
ফেলে দিয়েছ আবর্জনার স্তূপে,
কবির হৃদয়কে করেছে রক্তাক্ত, তোমাদের
তাণ্ডবে শান্তি গা ঢাকা দিয়েছে
ভূতলবাসী রাজনীতিকের মতো,
সুন্দর গ্যাছে নির্বাসনে।

অসুস্থতার কারাগারে বন্দি আমি,
অষ্টপ্রহর রুগ্ন ফুসফুস নিয়ে বিড়ম্বিত।
নিষেধের তর্জনী আমার দিকে উদ্যত,
চিকিৎসকের কড়া বিধান
আমার পায়ে পরিয়েছে বেড়ি
তবু আমি ছুটে যেতে চাই রাজপথে,
যে আমার পদধ্বনি চেনে, সামিল
হতে চাই মিছিলে, জনতার মঞ্চে, যেখানে
মানুষ দৃপ্ত প্রত্যয়ে নজরুলের আগুন-ঝরানো
কবিতার মতো অঙ্গীকারাবদ্ধ আর সঙ্গীতময়।

জনসাধারণ আজ দাবানল এবং
বানের পানির মতো অপ্রতিরোধ্য,
অন্যায় আর অনাচারের নিকট স্তম্ভগুলি
গুঁড়িয়ে ফেলার জন্যে, স্বৈরাচারীদের
বিতাড়নের জন্যে,
ষড়যন্ত্রের ফাঁস ছিন্ন করার উদ্দীপনায়
নতুন পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে
পেশী সঞ্চারিত করছে, মুঠো ভরে তুলে নিচ্ছে সূর্য কণায়।

 দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি

রাত্রির মখমল-আদর গায়ে জড়িয়ে
বসেছিলাম আমার ঘরে। পুরনো চেয়ারের আরাম
রাতের রেশমি অনুরাগের সঙ্গে উড়িত
এক যুগলবন্দিতে। আমার সামনে নগ্নিকার মতো
উন্মোচিত কবিতার খাতার। অনেকদিন পর রাত্তিরে
কবিতা লেখার জন্যে প্রস্তুত করেছি নিজেকে।
কবিতার একটি পঙ্‌ক্তিও লিখে উঠতে পারিনি
এক ঘণ্টার চেষ্টার পরেও। মাথার
পাতলা-হয়ে আসা চুল নিজেকে খুব অসহায়
মনে হচ্ছিল, হঠাৎ পথের কী একটা আওয়াজে
চমকে উঠি। কখন ক্লান্তির আঙুলগুলো আমার
চেতনাকে আস্তে ঠেলে দিল তন্দ্রার চৌহদ্দিতে,
টের পাইনি। কার উপস্থিতির আভায় ঘর
উদ্ভাসিত হলো এবং আমি চোখ কচলে দেখি
আমার টেবিলে হাত রেখে একটু ঝুঁকে
দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি। আলখাল্লা-পরা
অসামান্য ব্যক্তিটি যে রবীন্দ্রনাথ, চিনতে
দেরি হলো না। তিনি আমার কবিতার
খাতার দিকে তাকিয়ে রইলের কিছুক্ষণ।

আমি বিহ্বলতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্তায় সশ্রদ্ধ মুদ্রা। রবীন্দ্রনাথ
আমার কাঁধে চাপ দিয়ে বসতে বললেন আমাকে।
‘লেখো তুমি, কবির ধ্যানে বিঘ্ন ঘটাতে চাইনে,
তোমার উদ্যমে সাক্ষী হ’তে চাই’-শব্দগুলো তাঁর কণ্ঠে
ঝঙ্কৃত হলো সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের মতো।
‘তিনটি অক্ষরের একটি শব্দের অভাবে আমি
শুরু করতে পারছি না আমার নতুন সনেট’, কোনোমতে
জানাতে পারলাম তাঁকে। কবিগুরু আকাশের সুদূরতায়
দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইলেন আগের ভঙ্গিতেই।

‘নিজেকে অপেক্ষা করতে শেখাও, এই আমি
আশি বছরের রবীন্দ্রনাথ একটি শব্দের জন্যে অপেক্ষা
করেছি প্রহরের পর প্রহর, দুপুরে কখনো
নরম শয্যায় শয়ন করিনি, পাছে ঘুমিয়ে পড়ে।
তোমরা তো জানো কত শ্রম আমাকে
করতে হয়েছে। সাধনায় যতি পড়েনি বলেই কবিতা
এসেছে আমার কাছে যেমন পাতা আসে গাছে,
মাছের ঝাঁক ভেসে ওঠে জলাশয়ে’- রবীন্দ্রনাথের
উচ্চারণে উৎসাহ-জাগানিয়া সুরের ঢেউ। আমি
তিন অক্ষরের একটি শব্দের জন্যে আবার সতৃষ্ণ হয়ে উঠি
‘তুমি অনেক প্রেমের কবিতা লিখেছ’, কবিগুরু মৃদু হেসে
বললেন, ‘তাই তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই আমার
কাদম্বয়ী বৌঠান যখন বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতার
কাছে আমার কবিতাকে তেমন আমল দিতেন না,
তখন, লুকাব না, ঈর্ষার আলপিন বিঁধতো
মর্মমূলে। বৌঠান কি সত্যি আমার জন্যে
আত্মহত্যা করেছিলেন, তুমি ভাব? আমি নিজে
সেই রহস্যে মুখ থেকে কখনো আবরণ সরাতে পারিনি।
শ্রাবণ রাত্রিকে জ্যোতির জোয়ারে ভাসিয়ে তিনি
নিরীক্ষণ করলেন আমার ঘর; অমরতা, তাঁর চিরসঙ্গী, তাঁকে
এগোনোর তাগিদ দেয়। নক্ষত্রের বর্ষণ বনবাণীর প্রতি উদাসীন
তিনি যাত্রা করলেন নিরুদ্দেশে, দিকচিহ্নহীন অনন্তে।

ভ্রমরের গুঞ্জরণের মতো কী একটা সুর বাজতে থাকে
আমার ভিতর, তিনটি অক্ষরের একটি শব্দ
জানলা দিয়ে উড়ে এসে বসলো আমার
কবিতায় খাতায়, শূন্য স্থানে বিদ্যুল্লতা, কেমন ফুলঝুরি।

দুপুর এবং তোমার নিঃসঙ্গতা

দুপুরে বসেছিলে ড্রইং রুমে সোফায়;
বারবার তাকাচ্ছিলে টেলিফোনের দিকে, যদি
দোয়েলের মতো ঝাপ্‌সা অন্ধকারে
ডেকে ওঠে। তোমার বিরাগ আর অভিমান
ঘরকে অধিক পর করে দূর আকাশে
মেঘে মেঘে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দোয়েল
নীরব ছিল বলে তুমি উষ্মা প্রকাশ করলে
টেলিফোনের প্রতি।
তোমার হাতের দশটি নখ আরো সুঁচোলো
এবং আগ্রাসী হয়ে উঠল মুহূর্তে,
এখন কেউউ সামনে দাঁড়ালেই
হবে রক্তাক্ত, বুঝবে না কি তার কসুর?
কেন তাকে পশুর মতো আহত হ’তে হলো?
তুমি ফুঁসতে ফুঁসতে
এক সময় কেঁদে ফেলবে, দু’হাতে
ঢেকে ফেলবে মুখ।
বাড়ির পরিচারক আর পরিচারিকা
তোমাকে দেখে বিস্মিত হবে, আবিষ্কার করতে ব্যর্থ
হবে তোমার অন্তর্গত যন্ত্রণা, বেদনা।
তোমার অভিমান শুয়ে থাকবে বেড়ালের পাশে,
বৃষ্টিধারা তোমার নিঃসঙ্গতাকে
আরো বেশি শীতল, নিশ্চুপ এবং নিঃসঙ্গ করে তুলবে।

অবসাদ যখন গ্রাস করবে তোমাকে,
তখন তোমার স্তনাগ্রচূড়া
ছুঁয়ে ছুঁয়ে একজন কবির ভালোবাসা
সোনালি মৌমাছির মতো
গুঞ্জরণ তুলবে,
নিদ্রার আলিঙ্গনে মেঘ
হয়ে-যাওয়া তুমি, ক্ষোভ আর অভিমানের
তোষামোদে আচ্ছন্ন তুমি জানবে না।

 দু’দিক থেকে

প্রথম দিন যে জায়গাটায় মুখোমুখি
বসেছিলাম তুমি আর আমি,
আজ এতদিন পরে আবার সেখানেই
আমরা দু’জন এসে বসলাম দু’টি চেয়ারে
প্রায় একই ভঙ্গিতে। সেদিন ছিল
গোধূলিবেলা আর আজ রাত্তির।

সেদিন আমরা দু’জনই
নিজেদের আড়াল করে রেখেছিলাম
সযত্নে, অজান্তেই হয়তো মুখে
টেনে নেয়া হয়েছিল মুখোশ। ভব্যতার বড় দায়।
সেদিন আমরা কথা বলেছি
ঠারে-ঠারে, অথচ আজ
আমাদের মুখ ও মন জুড়ে, কোনো মুখোশ নেই। জানালা
খুলে রেখেছি, আসুক যত হাওয়া,
রোদ, জ্যোৎস্না, কুয়াশা,
বৃষ্টির ছাঁট, ঝিঁঝির ডাক, জোনাকি।

আমরা দু’জন দু’দিন থেকে এসেছি-
তোমার শাড়ির পাড়ে গোধূলিরঙ, চুলে
আটকে রয়েছে রাত্রির কালো, স্তনাগ্রে সোনালি মৌমাছির গুঞ্জরণ
আমার ট্রাউজার্স দোয়েলের একটি পালক, ধূসর
পুলওভারে হলদে পুষ্পরেণু। মুহূর্তগুলোকে
আকণ্ঠ পান করছিলাম সুরাপায়ীর মতো।

প্রথম দিন আমাদের কারো মনেই হু হু করেনি
বিচ্ছেদের ভাবনা; সেই অস্পষ্ট গোধূলিতে
জানতে পারিনি কাকে বলে প্রকৃত বিরহকাতরতা। অথচ
আজ রাতে আমরা কেবলি
বিষণ্ন হয়ে পড়ছি
আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ভেবে। তুমি তোমার
অন্তরে একটি হরিণীর আর্তনাদ শুনতে পেলে
আর আমি একজন প্রায়ন্ধ বাউলের
করুণ দোতারার সুর হয়ে উঠলাম ক্ষণে ক্ষণে। আমরা
দু’দিক থেকে এসেছি, দু’দিকেই চলে যেতে হবে।

 নিজেকে নতুন করে

নিজেকে নতুন করে গড়ে
তোমার নিকট যাবো বলে কিছুদিন
থেকে আর থাকি না হাজির
তোমার নিবাসে কিংবা অন্য কোনোখানে
তোমাকে দেখার জন্যে। এই আমি, যার
অবয়বে লেগেছে পুরানো
কিছু দাগ, কিছু ভাঙচুর

নিজেদের প্রবল জানান
দিয়েছে আমার অস্তিত্বের ভূমণ্ডলে।

আমি কি পারবো এইসব
ক্ষয়াচিহ্ন মুছে ফেলে দিতে?
আজ আমি সম্পূর্ণ নতুন হয়ে যাবো
একান্তে তোমার কাছে, যে আমাকে ফেলে
যেতে চায় পথপ্রান্তে উপেক্ষায়; যাবো
তারই সঙ্গে কিংবা তার আগে-
যেদিকে সৃজনশীল ঋতুর ঐশ্বর্য রয়ে গ্যাছে।

নিজেকে বদলে নিয়ে পারবো কি আমি
বাগানের সব ফুল গাছ
শিকড় সমেত তছনছ তুলে নিতে? পারবো কি
প্রজাপতিদের পাখা ছিঁড়ে ঢিবি বানাতে চৌদিকে?
পারবো কি কোনোদিন আগুন ধরাতে কারো ঘরে?
পায়রা হত্যায় মেতে ওঠা সম্ভব কি কখনো আমার?

চাই না করুণা সমবেদনার
সকল নিষ্ফল উচ্চারণ
কখনো আমার কাম্য নয়।
বরং নিজেকে ভেঙেচুরে বারবার
কাটব নতুন পথরেখা। চন্দ্রোদয়ে
রাত্রির শিশির ছুঁয়ে জমে থাকে অশ্রুকণা হয়ে
তোমার নিকট গিয়ে বলব কে বেশি বরণীয়
এখন তোমার কাছে? পুরাতন আমি নাকি এ নতুন জন?

পথের আহ্বান

‘এখানে জিরিয়ে নেই কিছুক্ষণ’ বলে এক শ্রান্ত রাহাগীর
গাছের সুবজ ছায়া নিজের শরীরে
মেখে নেয়; পাখি উড়ে গেল
পাতার আড়াল থেকে, অথচ লোকটা
নির্দয় নিষাদ নয় কোনো। হাতে তার
মারণাস্ত্র নেই, চেহারাও কর্কশতা হীনতার
ছাপ নয়; বরং দু’চোখে তার খেলা করে জ্যোতি,
মানবিক বোধ যার নাম।
আপাতত পথক্লেশে অবসন্ন সেই রাহাগীর
কোমল বিশ্রামপ্রার্থী, আঁজলায় ভরে নিতে চায়
শান্তিজলে অবিরল। ঝরা পাতাদের
কেমন রহস্যময়পথক্লেশে অবসন্ন সেই রাহাগীর
কোমল বিশ্রামপ্রার্থী, আঁজলায় ভরে নিতে চায়
শান্তিজলে অবিরল। ঝরা পাতাদের
কেমন রহস্যময় গান শুনে চোখ বুঁজে আসে।
তার, স্বপ্নাচ্ছন্নতায় সমস্ত শরীর
যেন কোনো ইন্দ্রজালে বন্দি হয়; মাথার গুহায়
ধ্বনি প্রতিধ্বনি জাগে বারবার, অতিকায়
একটি বেড়াল তাকে তাড়া করে, সারা মুখে বেড়ালের থাবা
সেঁটে থাকে ভয়ঙ্কর ভাবে,
রক্ত ঝরে, বোবা যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যায়
সত্তা; স্বপ্ন, মূলত দুঃস্বপ্ন,
তাকে কালো পাচনের বিরাট হাঁড়িতে
হঠাৎ নিক্ষেপ করে, প্রস্পেরোর অনুগত এরিয়েল এসে
উদ্ভ্রান্ত মানুষটিকে ভীষণ দেখায় ভয়। মিরান্দা কোথায়?
অকস্মাৎ মহুয়া, নদেরচাঁদ কংসাই নদীর ধারে হাত
ধরাধরি ক’রে হাঁটে, হুমরা বেদের বিষছুরি
আঁধারে ঝলসে ওঠে, রাহাগীর স্বপ্নের ভিতরে বুকচেরা
আর্তনাদ ক’রে কম্পিত শরীরে চোখ মেলে
নিভৃতে শুনতে পায় ‘এই দেশে উইড়া আইছে দেহি আমার আপন
তোতা পাখি। পথের আহ্বান তবু জোয়ারের জল!

পর্যটন

কবিতা লেখার খাতা, হ্যাঁ আমার খাতাটা চলেছে
গঙ্খীরাজে চেপে, চাঁদ আর
কালপুরুষকে, ছুঁয়ে ঢুকে যাবে
ব্ল্যাকহোলে; না, না, তা হ’তে দেবে না উল্কা,
লেজ দিয়ে পঙ্খীরাজটিকে ঠেলে ঠেলে
পাঠাবে মানস সরোবরে,
যেখানে অনেক রাজহংস, রাজহংসী ভাসমান।
আমার খাতাটা সোজাসুজি জলে নেমে
রাজহংসীদের গলা ধরে কিছুক্ষণ
কাটবে সাঁতার, স্তদ্ধ হবে।
কবিতা লেখার খাতা বুকে কিছু মেঘ ভরে নিয়ে
পর্বতচূড়ায় বসে হয়ে যাবে তরুণ ঈগল,
লড়বে সাপের সঙ্গে, যতক্ষণ শক্র
পরাস্ত না হয় পুরোপুরি।
খাতাটা প্রাচীন এক অট্রালিকা দেখতে পেয়েই
নির্ভয়ে প্রবেশ করে সন্ধ্যেবেলা ভগ্নস্তূপ, গর্তটর্ত, বিধ্বস্ত খিলান,
বাদুড়, গোসাপ গিরগিটি, বুনো ঝোপ
জয়োল্লাসে জুড়ে দেয় মায়াবী কোরাস-
‘কত যুগ যুগান্তর পরে এলে, বহুকাল পর অবশেষে
শোনা যাবে গান, বেজে উঠবে
ধ্বনির নূপুর।‘
আমার লেখার খাতা বলে সবিনয়ে-
‘আমিতো জানি না গান, বুকের ভেতর শুধু কিছু
কবিতা বেড়াই বয়ে।
হাজির জবাব, ‘ওই হলো, প্রকৃত কবিতা আর
গানে নেই কোনোই তফাৎ। অনন্তর স্তব্ধতায়
আশ্বস্ত আমার খাতা তন্ময় আবৃত্তি করে এবং অদূরে
কয়টি অমনোযোগী কঙ্কাল ধূসর, জীর্ণ তূলোট দলিল
দস্তাবেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে। অকস্মাৎ
কে, এক পূর্ণিমা-রঙ নারী এসে দাঁড়ায় সেখানে
বুঝি কবিতার টানে, খাতাটিকে গাঢ় চুমো খেয়ে
বুকে ওর আগুন রঙের এক ফুল গুঁজে দেয়।

আমার লেখার খাতা সৌরলোক, ছায়াপথ, ভাঙা
বাড়ি বুনো ঝোপ, মেঘ, পূর্ণিমা রঙের মানবীর
ঠোঁট আর ফুলের সৌরভ নিয়ে উড়ে
ফিরে আসে আমার টেবিলে। ওর বুকে
আনন্দের নদী বয় না কি
বিষাদের বালি ঝরে, বুঝতে পারি না। শুধু শুনি
কোনো কোনো মধ্যরাতে কেমন অস্পষ্ট কিছু ধ্বনি
কেবলি বেরোতে চায় ওর বুক চিরে স্বপ্নের ভেতর যেন।

বিশ্বেস না হ’লে বলি, হে আমার প্রিয়
পাঠক পাঠিকা প্লিজ কান পেতে শুনুন খানিক।

ফজুল টিকিট

আমরা কুয়াশাঘেরা জনসাধারণ
গোলকধাঁধায় ঘুরি, বুঝি কি না বুঝি, ঘুরছি তো
ঘুরছি শুধুই ডানে কিংবা বামে, কখনো বা খুব
সোজাসুজি। মাথায় কখন
মাথা ঠুকে যায় আর এ ওর শরীরে ধাক্কা লেগে
কোথায় কে যায় গড়াগড়ি;
সহজে পড়ে না চোখে। এরই মধ্যে সদর স্ট্রিট কি
গলি ঘুঁজি, যেখানেই হোক, কালো হিংস্র হাতগুলো
আমাদের সামান্য যা পুঁজি
লুট করে দেয় ছুট এমনকি সন্ত্রস্ত, আংশিক বজ্রাহত
জনকের সমুখেই দুহিতার সম্ভ্রম বিশদ
হয়ে যায় ছিনতাই অস্ত্রের ছায়ায়।

আমরা কুয়াশাঘেরা জনসাধারণ অবিরাম
গোলকধাঁধায় ঘুরি মরি। এ কী রঙ্গ এই বঙ্গে
চোখে পড়ে দিন দুপুরেই! সতেরোটি ঘোড়া আর
আজব সওয়াব আজ ন’শ’ বছরের
প্রেত সেজে রাজপথে মেতেছে যাত্রার ঢঙে ঢের
মিথ্যাচার আর বানোয়াট ইতিহাস প্রচারের
বিমূঢ় নেশায়
জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে।
প্রতিক্রিয়াশীলতার চোরা টানে অন্তঃসারহীন
মরা অতীতের পররাজ্যলোভী হামলাকারীর
প্রেতকেই ডেকে আনে ওরা বর্তমানে,
বিছিয়ে বিস্তর কাঁটা পথে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করে।
কাদাজল ঠেলে ঠেলে পথ চলি, অলিগলি খুঁজি,
যদি বেরুবার দিকচিহ্ন
পেয়ে যাই; কারা মুছে ফেলে দিকচিহ্নগুলি
কালি মেখে রাতারাতি? অকস্মাৎ শুনি
বাঁশির মধুর সুর। এমন আন্ধারে ভাসমান
মলখণ্ডময় কাদাজল ঠেলে ঠেলে
কে বাজায় বাঁশি? তার হাতে কেউ দেয়নি কি গুঁজে
ভীষণ গন্তব্যহীনতার কোনো ফজুল টিকিট?

বিনিময়

‘তোমার শরীরে এত ধুলোবালি কেন?’
আমাকে হামেশা প্রশ্ন করেন পাড়ার পাঁচজন
চোখে মুখে নানা মুদ্রা ফুটিয়ে। নীরব
থাকি, উত্তরের
ঝাঁপি ঢেকে রাখি। যদি বলি,
বহু দীর্ঘ পথ, বহু আঁধিঝড় আমার শরীরে
রেখেছে স্বাক্ষর, তবে তারা
কী করে নেবেন মেনে আমার বয়ান?
‘তোমার দু’পায়ে এত রক্তবিন্দু কেন?’
তাদের এ প্রশ্ন আমি নিশ্চুপ এড়িয়ে যাবো দূর
নক্ষত্রের দিকে
তাকিয়ে, আমার কষ্টচিহ্নগুলি থাক
উত্তরের নিঃসীম ওপারে। লোকগুলি
নির্বিকার হেঁটে চলে যায় এরই মধ্যে,
কিন্তু দু’জনের চোখে সহানুভূতির আর্দ্র
জন্মীলন দেখে মনে কৃতজ্ঞতা অশ্রুকণা হয়।

‘তোমার শরীরে এত পোড়া দাগ কেন?’
লোকদের প্রশ্ন ফের মৌমাছির মতো ওড়ে আমার চৌদিকে।
‘অগ্নিকুণ্ডে নিজেকে পুড়িয়ে এইসব
দাগ আমি অর্জন করেছি;
সহজে বলতে পারতাম। অথচ অদ্যমহীন
শীতল ঔদাস্যে লোকদের কাছে থেকে
বিবৃতি আড়ালে রাখলাম।

এ জীর্ণ শরীরময় ধুলোবালি, গাঢ় রক্তচিহ্ন
আর পোড়া দাগের বদলে
পেয়েছি নিজের মধ্যে কত লতাগুল্মোর চকিত জাগরণ,
ঝর্ণাধারা, বনদোয়েলের শিস, নক্ষত্রের গান-
এও-তো সঙ্কোচে
প্রিতিবেশীদের সত্যি পারিনি জানাতে।

বেঁচে থাকতে চাই

আমার দেহঘরে ধেড়ে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ছে
নানা ব্যাধি, দৃষ্টিহীন বাদুড়ের
ডানার সৃষ্টিছাড়া ছায়া ঘনাচ্ছে আমার দু’চোখ।
অস্তিত্বের তন্তুজালে মাঝে-মধ্যে যে-উৎসব
জ্বলজ্বল করে তার স্থায়িত্বের সীমা ক্রমশ সঙ্কুচিত,
মাথার ভেতরকার দুঃস্বপ্নের দাঁত-নখের
ভয়ানক আঁচড় আমাকে বারবার দাঁড় কারিয়ে দেয়
খাদের কিনারে, তবু বেঁচে থাকতে চাই।

শক্ররা তূণ থেকে একের পর এক শর নিক্ষেপ করছে
আমার দিকে, আমাকে সুনামের
শিখর থেকে ধুলোয় ফেলে পদদলিত করার অভিলাষে
মত্ত কিছু ধর্মান্ধ, কুসংস্কার-পসারী,
আমার প্রাণ হরণের জন্যে ওদের জিভ লকলক করছে
নেকড়ের মতো, যাতে আমার
মুক্ত কণ্ঠস্বর বিজন হাওয়ায় হারিয়ে যায়, সে জন্যে ওদের
ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই; তবু আমার বাঁচার সাধ সতেজ।
যে পাখিটি এইমাত্র রেলিঙ-এ উড়ে এসে বসল তার জন্যে,
বাগানের ফুলগুলোর জন্যে,
যে গাছের ছায়া আমার বারান্দায় নমিত প্রার্থনার মতো,
তার জন্যে, বাঁশবাগানের বৃষ্টির গন্ধ, গরুর মাথানের
সদ্যোজাত বাছুরের ঘ্রাণ আর দীঘির ঘাটে তরুণীর
ভাসমান কলসের জন্যে, ধানের ক্ষেতে কৃষকের
রৌদ্রঝলসিত কাস্তের জন্যে, গাঁয়ের বাড়ির বৈঠকখানায় দুপুরে
খাটে শুয়ে ঘুঘুর ডাকে ডুব দেওয়ার জন্যে, গহীন গাঙে
পালতোলা নাওয়ের জন্যে, রঙিলা নায়ের মাঝির
গানের জন্যে, সর্ষে ক্ষেতের প্রজাপতির জন্যে বাঁচতে চাই।

আমার মায়ের মুখের প্রসন্নতার জন্যে,
আমার জীবনসঙ্গিনী, সন্তান-সন্ততি, আমার সকল
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্যে,
আমার চার বছরের পৌত্রী নয়নার কালো চোখের চাওয়া
আর ফুটফুটে হাসির জন্যে,
যাকে ভালোবাসি, তার জীবনের রৌদ্রজ্যোৎস্না
অনুভব করার জন্যে, তাকে আরো বেশি দেখার জন্যে
বেশ কিছুকাল বাঁচার আনন্দ পেতে চাই।

শীতের দুপুরে আকাশে চিলের চক্করের জন্যে,
ফুটপাতের পাশে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে,
ঘরেতে ভ্রমরের গুঞ্জনের জন্যে, নিশুত রাতে
কালপুরুষের উপস্থিতির জন্যে,
রবীন্দ্রনাথের গানের জন্যে, লালন গীতিকার জন্যে আর
আমার এখনো লিখতে না-পারা কবিতার জন্যে,
বাংলা কবিতার নতুন বাঁকে দাঁড়ানোর জন্যে,
আমার বেঁচে থাকার স্পৃহা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

প্রতিবাদী মিছিল থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে-আসা
ছোট ভাইয়ের মাথায় বড় আপার
হাত বুলিয়ে দেওয়ার অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্যে,
কারাগার থেকে জনগণনন্দিত রাজবন্দির মুক্তির জন্যে,
সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ বন্ধ হয়েছে,
স্বদেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই সংবাদ
শোনার জন্যে, দেশ ধুরন্ধর ফতোয়াবাজদের
দন্তনখর থেকে মুক্ত হয়েছে, ঘাতকদের অস্ত্রময় ডেরা
বিলুপ্ত হয়েছে জানার জন্যে, মানবতার বিজয়োৎসব দেখার জন্যে
ফিনিক্‌স পাখির মতো বারবার বেঁচে উঠতে চাই।

বেকার

উস্‌কোখুশকো যুবকটি অতল জলে সাঁতারহীন।
পকেট হাতড়ে সিগারেটের শস্তা
প্যাকেট খুঁজে নৈরাশ্যকে পায়। মলিন
অথবা ঝকঝকে কোনো নোট নেই
খুচরো পয়সাও পকেট পলাতক।
ভবিষ্যৎ ওকে ঘন ঘন দেখাচ্ছে মরীচিকা।

যুবক ক্লান্ত পায়ে বিকেলের রাস্তায় হাঁটে,
কখনো তাকায় কেতাদুরস্ত
কোনো দোকানের দিকে; সমস্ত
শহর থেকে চাকরিবাকরি গায়েব,

দরখাস্তের স্তূপের নিচে সম্প্রতি
ওর স্বপ্ন আর নধরকান্তি সাধের
ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পুলিশ
ওকে পরখ করে দূর থেকে, যেন সে ছিঁচকে চোর।

যুবক চকিতে দ্যাখে একটি মেয়ে
রিক্‌শায় ঝলক খেলিয়ে চলে গেল।
ওর পরনে কি ছিল শালোয়ার কামিজ?
মেয়েটিকে কোথায় যেন কোন্‌ কালে
দেখেছে মনে পড়ে?
একবার ইচ্ছে হলো পেছনে দৌড়ে গিয়ে
রিক্‌শা থামিয়ে এই হতচ্ছাড়া হালতে
কি কথা বলবে তার সঙ্গে সদর স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে?
অচেনা পথচারীর ধাক্কা খেল যুবক

মেয়েটি যে ওর পরিচিতা কিংবা একদা-সহপাঠিনী
হবেই তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে? মুখের
আদলে কিছু মিল থাকলেই ইচ্ছা এবং
বাস্তবের ফারাক ঘোচে না সবসময়

মেসের ময়লা বালিশে যুবা মাথা রেখেছে ভরসন্ধ্যায়;
আগামীকাল দৈবাৎ তার কোনো চাকরি
জুটে যাবে, এমন প্রত্যাশা নির্বোধ দুঃস্বপ্নের শামিল,
তবে উস্‌কোখুশ্‌কো চুল, ক’দিনের না-কামানো দাড়ি এবং
পেটে ক্ষুধার সুতীক্ষ্ণ কামড় নিয়ে
পায়রাময় এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে
যে ভাববে, রিক্‌শার ঝলক অতল জলে
তাকে না চাইতে ধার দিয়েছে কিছু খড়কুটো।

মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভেতরে

মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভেতরে চলে যাই
উন্মুক্ত প্রান্তরে, হু হু হাওয়া
আমাকে জড়িয়ে ধরে, সখ্য আঁকে চুলে
জীর্ণ মুখমণ্ডলে, বাহুতে, ফুসফুসে।

অনেক করোটি দেখি মাটির ওপর
কেমন তাকিয়ে থাকে আমার দিকেই। সেই সব
করোটি ঈষৎ আচ্ছাদিত
ঘাস আর সজীব হলুদ কিছু ফুলে।

বালিকার হাত থেকে ছিটকে পড়া কোনো
পুতুলের ভাঙাচোরা টুকরোর মতোই
সেই সব করোটি ব্যথিত পড়ে আছে
স্বপ্নের ভেতরে আজ; প্রজাপতি বসে শূন্য চোখে কোটরে।
ওরা ভালোবেসেছিল আমাদের, আমাদের

দুঃস্বপ্ন বেষ্টিতে দেয়ালের
পাথরগুলোকে গুঁড়ো করে প্রত্যূষের দরজায়
হিরন্ময় স্বপ্নসৌধ দিয়েছিল গড়ে।

এখন ওদের ভুলে দিব্যি বসে চায়ের আসর,
কবিদের নিভাঁজ আড্ডায়
সময় কাটিয়ে দিই ঢের রাজা উজিরের মুণ্ডুপাত করে;
ছেঁড়া পকেটের গর্ত থেকে খসে-পড়া
মুদ্রার ধরনে শুষ্ক ধূলায় গড়ায় অগোচরে।

ময়ূরপঙ্খী নায়ের গাথা

প্রায়শ আমার স্বপ্নে একটি ময়ূরপঙ্খী নাও
ভেসে ওঠে কুয়াশায়। মাঝে মাঝে সে কোন্‌ ঘাটের
স্মৃতি পাটাতনে
কেমন ক্রন্দন করে, যেন শিশু ঘুমের ভেতর। কখনো বা
কিছু ছায়া সোনালি ময়ূরপঙ্খী নায়ে
হাঁটে, ঘোরে, নাচে দলে দলে।

দীর্ঘকায় সুকান্ত সারেঙ, চোখ যাঁর
মুক্তির আলোয় স্নাত, প্রবল ধরেন হাল, উত্তাল ঢেউয়ের
আঘাতে ময়ূরপঙ্খী নাও
কম্পমান ক্ষণে ক্ষণে। তবু তিনি গন্তব্য সন্ধানে
অবিচল মাল্লাদের নিয়ে এবং চৌদিকে তার
অমরতা গুঞ্জরিত স্বর্ণবর্ণ ভ্রমরের মতো।
কে এক তিরিক্ষি দাঁড়কাক অগোচরে

ঠাম মাস্তুলে বসে, ঠোকরায় পাল, মাঝে মাঝে
চিৎকারে বিদীর্ণ করে হাওয়া। কতিপয়
বিশ্বাসঘাতক আততায়ী ষড়যন্ত্রে মেতে
হঠাৎ হরণ করে সারেঙের প্রাণ। দিগ্‌ভ্রান্ত
জলযান ঘূর্ণাবর্তে পড়ে
হতে চায় খান খান। কুমন্ত্রণা, কুহকের
আমন্ত্রণ ময়ূরপঙ্খী নাওটিকে কত ভুল ঘাটে
নিয়ে যায়। আখেরে নকল সারেঙের
কাল শেষ হলে
বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে টালমাটাল নায়ের হাল ধরে
মনোনীতা সাহসিকা বাঙালি মানবী একজন।
সুবাতাস পাগুক নতুন পালে, মানবীর মাথায় ঝরুক
নিহত সুকান্ত সারেঙের
স্নেহের শিশির আর মাঝিমাল্লা, যাত্রীদের গানে
ময়ূরপঙ্খীটি যাক নতুন পানির স্রোত কেটে।

যখন কবিতা হরতাল করে

এই যে এখন চারপাশে যা ঘটছে ইতস্তত,
বস্তুত সেসব দেখে শুনে মন মেজাজ যখন
ভীষণ বিগড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের
গান কিংবা বেলায়েত খাঁর সেতার শোনার পর
আবার আকাশে চোখ রেখে
অথবা পেয়ারা গাছে আলোর কাঁপন
দেখে কিংবা জীবনানন্দের
কয়েকটি পঙ্‌ক্তি পড়লেই সহজে মেজাজ খুব শান্ত নদী।

কখনো আমার টেলিফোন গৌরী বেশি
ব্যস্ত পেলে অথবা আমার কোনো কথা
তার মনে যদি কালো মেঘ
সৃষ্টি করে, ক্রোধের বেড়াল তাকে আঁচড়াতে থাকে,
আমার কথাই ফের লহমায় সেই কালো মেঘ
এবং বেড়ালটিকে বহুদূরে তাড়িয়ে ঝোঁটিয়ে নিয়ে যায়।

যখন কবিতা অকারণ হরতাল করে বসে
আমার বিরুদ্ধে কিছুকাল
তার মানভঞ্জনের কোনো উপাদান
কী নিসর্গে কী মানুষে কোথাও পাই না খুঁজে। সে যে
কোথায় আড়ালে আবডালে থাকে চিত্রকল্প, প্রতীক ইত্যাদি
নিয়ে আমি দেয়ালে নিয়ত মাথা খুঁড়লেও তার দেখা মেলা
ভার, তবে এ-ও জানি যদ্দিন আমার

হৃদয়ে জাগবে, রঙধনু বারবার
এবং আমার কাঁধে বসবে কোকিল, কবিতার
হরতাল প্রত্যাহার করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই আর।

যাঁরা মাথায় ইতিহাসের জ্যোতি-বলয়

যখন সুবেসাদিকে মুয়াজ্জিনের আজান
চুমো খেলো শহরের অট্রালিকার নিদ্রিত গালে,
ফুটপাতের ঠোঁটে, ল্যাম্পপোস্ট আর
দোকানপাটের নিঝুম সাইনবোর্ডের চিবুকে, বস্তির শীর্ণ শিশুর
শুকিয়ে যাওয়া ঘামের চিহ্নময় কপালে,
লেকের পানির নিথয়, পাখির নীড়ের স্নিগ্ধ নিটোল শান্তিতে,
তখন ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে
কয়েকটি কর্কশ অমাবস্যা ঢুকে পড়ল। অকস্মাৎ
স্বপ্নাদ্য হরিণের আর্তনাদে জেগে উঠে তিনি, প্রশস্তবক্ষ, দীর্ঘকায়,
সুকান্ত পুরুষ, যাঁর মাথায় ইতিহাসের জ্যোতি-বলয়,
এসে দাঁড়ালেন অসীম সাহসের প্রতিভূ।
কতিপয় কর্কশ অমাবস্যা, যাদের অন্ধকার থেকে
বেরিয়ে আসছিল পরিকল্পিত উন্মত্ততার বীভৎস জিভ,
তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিলো এক ঝাঁক দমকা বুলেট। ঈষৎ বিস্ময়-বিহ্বল,
অথচ স্থির, অটল নির্ভীক তিনি অমাবস্যার দিকে
আঙুল উঁচিয়ে ঢলে পড়লেন সিঁড়িতে। সেই মুহূর্তে
বাংলা মায়ের বুক বিদীর্ণ হলো; মেঘনা, পদ্মা, যমুনা, সুরমা,
আড়িয়াল খাঁ, ধরলা, ধলেশ্বরী, কুমার, কর্ণফুলি, বুড়িগঙ্গা এবং
মধুমতি তাজা রক্তে উঠল কানায় কানায়। বাংলায়
লহু-রাঙা ফোরাত বয়ে গেল, সীমারের নির্লোম বুক, শাণিত খঞ্জর,
ইমাম হোসেনের বিষণ্ণ মুখ আর কারবালা প্রান্তর ভেসে উঠল দৃষ্টিপথে!

আকাশের মেঘমালা, এই গাঙ্গের বদ্বীপের সকল গাছপালা,
হঠাৎ জেগে-ওঠা প্রতিটি পাখি,
হাওয়ায় কম্পিত ঘাসের ডগা, সকল ফুলের অন্তর
হয়ে গেল দিগন্ত-কাঁপানো মাতম;
বাংলাদেশ ধারণ করল মহররমের সিয়া বেশ।

সদর রাস্তায় একচক্ষু দানবের মতো ট্যাঙ্কের উলঙ্গ ঘর্ঘর
আজানের ধ্বনিকে ডুবিয়ে দিতে চাইল,
লাঞ্ছিত করল নিসর্গের প্রশান্ত সম্ভ্রমকে,
প্রত্যুষের থমথমে, ফ্যাকাশে মুখে লেগে রইল
নব পরিণীতার রক্তের ছোপ, যার হাতে
তার বুকের রক্তের মতেই টাটকা মেহেদির রঙ,
প্রত্যূষ মুখ লুকিয়ে ফেলতে চাইল
ভয়ার্ত বালক রাসেলের দিকে অমাবস্যাকে অগ্রসর হতে দেখে,

কতিপয়, অমাবস্যাকে হায়েনা-চোখে
মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখে
প্রত্যূষ থমকে দাঁড়াল, ধিক্কারের ভাষা স্তব্ধতায় হলো বিলীন।

স্মরণ করতে চাই না সেই সব পাশব হাতকে,
যেগুলো মারণাস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিল তাঁর বুক লক্ষ্য করে
যিনি দুঃখিনী বাংলা মায়ের মহান উদ্ধার;
আমাদের দৃষ্টির স্ফুলিঙ্গে ভস্মীভূত হোক সেসব হাত,
যেগুলো মেতেছিল নারী হত্যা আর শিশু হত্যায়,
আমাদের থুতুতে পচে যাক সেসব হাত,
যেগুলো তাঁকে মাটি-চাপা দিতে চেয়েছিল

জনস্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে, অথচ তিনি মধুমতি নদীর তীরে
গাছপালা, লতাগুল্মঘেরা টুঙ্গিপাড়ায়
দীঘল জমাট অশ্রুপুঞ্জের মতো সমাহিত হয়েও
দিগ্ধিজয়ী সম্রাটের ঔজ্জ্বল্য আর মহিমা নিয়ে
ফিরে এলেন নিজেরই ঘরে, জনগণের নিবিড় আলিঙ্গনে।
দেশের প্রতিটি শাপলা শালুক আর দোয়েল,
ফসল তরঙ্গ আর পল্লীপথ প্রণত তাঁর অপরূপ উদ্ভাসনে এবং
শ্রাবণের অবিরল জলধারা অপার বেদনায় জমাট বেঁধে
আদিগন্ত শোক দিবস হয়ে যায়।

যে আমাকে লেখায়

সাত বাজার ঘুরে ভরদুপুরে এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে
ঘরে ফিরে এসে ঢক পানি খেয়ে
জুতো না খুলেই সটান শুয়ে পড়লাম
বিছানায়। আমার ওপর বইতে থাকে স্বস্তির নদী।
কয়েকটি টুকরো সংলাপ, কিছু বচসা,
কিছু দ্রব্যের বাহারী চেহারা
আমার মগজে ঘুরঘুর করছিল এবং
বুক শেল্‌ফের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম
কোন্‌ কোন্‌ বই এখনো
পড়া হয়নি। কে জানে কখনো পড়া হবে কিনা।

বারবার টেলিফোন সেটে সতৃষ্ণ দৃষ্টি দিই;
কতদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি,
এই সরল সত্য আমাকে শাসন করে কিছুক্ষণ।
একটি কি দু’টি কবিতা লিখলেই, বই পড়লে
কিংবা গান
শুনলেই কি একজনকে দেখতে না পাওয়ার বেদনা
আড়াল করা যায়?

বাজে কাগজের ঝুড়িতে নজর পড়ে হঠাৎ
সেখানে কি খুঁজে পাবো না-লেখা
কবিতার উপাদান? ক্লান্ত আমি ভাবছি, শুধু ভাবছি।
তার সঙ্গে দেখা হবে কি আজ, যে আমাকে লেখায়?

লানতের পঙ্‌ক্তিমালা

আজ রাতে নাগরিক নিসর্গ বিষয়ে একটি কবিতা
লেখার কথা ভাবছিলাম,
আমার কলম শাদা কাগজের বুকে অক্ষর সাজানোর
অতিপ্রায়ে উন্মুখ, ঠিক তখনই আমার গলির গাছপালা,
ফুলের বাগান, নিশীথ-জড়ানো আসমানের
রহস্যময় সৌন্দর্য লেখনীর গতি রুদ্ধ করে বলল-
‘আজ আমরা তোমাকে আমাদের কথা
লিখতে দেবো না। কবি, আজ তুমি লেখো তোমার
প্রিয়তম জন্মশহরের সেই ছাত্রাবাসের কথা, যেখানে
সশস্ত্র পুলিশের বুটের আঘাতে নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্রদের
ভাতের থালা শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে
মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে,
যেখানে মেধাবী শিষ্টাচারপরায়ণ
শিক্ষার্থীর হাত-পা ভেঙে বন্দুকের বাঁট দিয়ে
বর্জ্যের মতো ছুঁড়ে ফেলেছে থানায়,
যেখানে ছাত্রদের কাঁটাতারে বেঁধে পিটিয়ে
আধমরা করে ফেলা হয়েছে,
যে-শিক্ষার্থী ঘুমের ভেতর সুখস্বপ্ন দেখছিল,
সে ভীতসন্ত্রস্ত জেগে উঠল হায়েনার হামলায়
ঘোর দুঃস্বপ্নে, সে বুঝতেই পারল না,
কেন তাকে সইতে হচ্ছে কসাইখানার নিপীড়ন।

আজ রাতে একটি প্রেমের কবিতা লিখব বলে
মনস্থির করলাম। গৌরীর মুখ আমার চোখে ভেসে উঠল।
তার উদ্দেশে কবিতা রচনার জন্যে কলম ধরতেই,
গৌরী, যে এখন এই শহরে নেই, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
হাত থেকে বলপেন প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলল-
‘আজ আমার উদ্দেশে কোনো কবিতা
লেখার প্রয়োজন নেই।
কবি, বরং আজ তুমি লেখো সেই মায়ের
অশ্রুধারার কথা, যার ছেলের পাঁজর গুঁড়িয়ে গ্যাছে
অত্যাচারী বুটের আঘাতে, তুমি লেখো সেই
বিধবার কথা, যার বুক আজ শস্য-কাটা ক্ষেতের মতো,
যার স্বামীকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসের কর্কশ হাত।

গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সুপ্রিয়া গৌরী বলল-
‘কবি, তুমি আজ তোমার কলম থেকে নিঃসৃত হ’তে দাও
লানতের পঙ্‌ক্তিমালা
লানত দাও তাদের, যারা তোমার প্রিয়তম শহরকে
একাত্তরের ধরনে বন্দশিবির বানিয়ে
প্রেতনৃত্যে মেতে উঠতে চায়।
লানত দাও তাদের, যারা গণতন্ত্রকে সঙ সাজিয়ে
শহরে ও গ্রামে ভড়ং দেখাচ্ছে সং বিধান রক্ষার,
কবি, তুমি লানত দাও তাদের, যাদের হাত থেকে ঝরছে রক্ত,
যাদের হাতে লাশের গন্ধ,
লানত দাও তাদের যারা ‘মালাউন’ গাল পেড়ে মুক্তিযুদ্ধের
রণধ্বনি এবং জয়ধ্বনি জয়বাংলা ছাত্রদের পায়ুপথে
ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছি বীভৎস উল্লাসে,
লানত দাও তাদের, যাদের কপালে মহাকাল
ফ্যাসিবাদের সীলমোহর এঁকে দিয়েছে;
কবি, তোমার কলম থেকে আজ ফুল-চন্দন নয়,
এই ঘোর অমাবস্যায় ঝরুক
জালিমদের কেল্লা-পোড়ানো স্ফুলিঙ্গ।

লোকটা ভাবে

সবাই ঘুমিয়ে আছে সে সাধের
বিছানায় শেষ রাতে। এখন লোকটা ভাবে বসে-
কাগজ কলম কালি নিয়ে
কাটিয়ে দিয়েছি কতকাল। শত শত
পাতা সাজিয়েছি দিনরাত অনুরাগে,
কখনো কখনো
একটি শব্দের জন্যে উড়িয়ে ধৈর্যের পাল বসে
রয়েছি বিমর্ষ পাটাতনে। শব্দগুলি উঁকিঝুঁকি
দিয়ে দ্রুত শূন্যে লুটোপুটি খেয়ে ছুটে
পালিয়েছে কৌতুকের ঠাটে।

এখন লোকটা ভাবে বাইরে তাকিয়ে-
দূরের আকাশ আর কাছের প্রান্তর, স্তব্ধ নিশুত রাতের
পথঘাট, বসন্তের অস্থির কোকিল, হেমন্তের
নির্ভেজাল শিশির, বাঁশের ঝাড় রেখেছি খাতার
পাতায় কত যে তার হিশেব কে রাখে? আর গৌরী
বারবার সহজেই দাঁড়িয়েছি, বসেছে, রয়েছে

শুয়ে নম্র গোধূলি বেলায়
কলমের নিবিড় ছোঁয়ায়
এখানে কাগজ জুড়ে। কখনো অনেক মানুষের
কলরব রাজপথসহ কী প্রবল ঢুকে পড়ে
খাতার নির্জনতায়। একটি তারা কি খসে গেল
পতনের ঝোঁকে? এমনও তো হয়েছে কখনো
পরি উড়ে এসে খুব নিরালা জ্যোৎস্নায়
অক্ষরের রূপ নিয়ে বেড়িয়েছে সফেদ পাতায়।

রাত্তিরে লোকটা ভাবে টেবিলে বিশ্রান্ত মাথা রেখে-
এই যে অক্ষর সারি সারি
ছড়ানো গড়ানো ডানে বামে,
এ নিয়ে পারি না আর, বমন উদ্রেক করে শুধু।

পরদিন ভোরবেলা লোকটা আবার
কাগজ কলম হাতে অক্ষরের প্রতিমা বানায়।

শুরুতেই বাগানটা

শুরুতেই বাগানটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন;
বড় বেশি উপেক্ষিত ছিল
এতকাল, চতুর্দিক আগাছায় ভরে
আছে, ফুল ঢাকা পড়ে গ্যাছে কাঁটাবনে
আর পশুদের
বিষ্ঠায় দুর্গন্ধময় মাটি। পাখিরা ভুলেও
আসেনি এখানে আর এলেও কখনো গলা খুলে
গায়নি মধুর গান; সন্ত্রাসের ভয়ে
পালিয়েছে দূরে,
খুঁজেছে আশ্রয় মেঘে নীলিমার মৈত্রীর আশায়।

কোদাল, খুরপির ঘায়ে আগাছা উপড়ে ফেলে দিলে
বাগানের মুখশ্রী আসবে ফিরে, নানা
পুষ্প বিকাশের সুরে দুলে
উঠবে আবার, কাঠবিড়ালিরা রোদ
পান করে বুঁদ হয়ে গাছের ছায়ায়
খুঁজবে রূপালির স্বপ্নে ইতস্তত সোনালি বাদাম। ময়ূরের
নাচ দেখে মেঘ
নিমেষে হাসিতে ভেসে পৌঁছে
যাবে দিগন্তের ঘাটে। নিঃসঙ্গ তরুণ
বাঁশের বাঁশির সুরে গোধূলিতে রঙ
ছিটিয়ে চৌদিকে ক্লান্ত হাতে
মাথা রেখে ডুবে যাবে নিদ্রার পাতালে।

ঝকঝকে বাগানের গাছের পাতারা
আনন্দমেলায় সমবেত
শিশুদের মতো দ্যাখো কেমন উচ্ছল। কোটি কোটি
হাত বাগানকে আরো সুন্দর রাখার
বাসনায় আগাছা নিড়ায়, জল ঢালে
শত চারাগাছের গোড়ায়,
ছেঁটে ফেলে নিষ্প্রভ অসুস্থ পাতাদের, সূর্যোদয়ে
সোৎসাহে রচনা করে মাইল মাইলব্যাপী বৃক্ষরাজি আর
ঘন সবুজের আর ফুল পাখিদের,
সর্বমানবের প্রীতি, মেধা আর মননের গাথা।
কোটি কোটি চোখ
নতুনের স্বপ্নে খুব ডাগর উৎসব। আগামীর
নামে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়ুক বাগানে,
কোকিল করুক আজ বসন্তের বিশদ আবাদ।

সমস্বরে বলছে

জ্যৈষ্ঠের দুপুর সোনার কলস উপুড় করে
চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে সুবর্ণ ধারা; দুপুরটা
নিজেই সোনার চকচকে পাত হয়ে কাঁপছে।
উপরন্তু তার সোনালি ঝাঁকড়া চুল
হাওয়ায় উড়ছে উদ্দাম, চরাচরে আগুন
ধরাতে চায় এই পোষ-না-মানা জ্যৈষ্ঠের দুপুর;
দুপুরে চোখ ও বুক ফেটে বেরুচ্ছে অজস্র স্ফুলিঙ্গ
আর সবাই কেমন কুড়াতে চায় স্ফুলিঙ্গের ফুল।

দিগন্তের হৃদয় ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে
ভয়স্কর সুন্দর এক ঝড়;
ঝড়ের ঝাপ্টায় থরথর কম্পিত
অচলায়তন। ঘূর্ণিঝড় অচলায়তনের রক্ষীদের
ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে, অপরূপ সেই ঝঞ্ঝার
ধাক্কায় খসে যায় অচলায়তনের
অন্দরমহলের কিছু পলস্তারা, অন্ধকারের
‘গেল, গেল’ রব ক্রমশ হিংস্র হ’য়ে ওঠে।

কারার লৌহকপাট, কালো স্থুল শেকল ভাঙার গানে
হঠাৎ ঝনঝনিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।
হার্মোনিয়াম নেই, ঢোল নেই, মৃদঙ্গ নেই,
নেই বাঁশি, তবু বন্দিশালার তালা-ভাঙানো
ভিত-কাঁপানো আগুন রঙের গান হৃদয়-কুসুম হয়ে
ফুটতে শুরু করে মানবমেলায়।

একটি গুলজার খানকা শরীফে এখন পাথুরে মূর্তির মতো
একজন বসে আছেন; তাঁর গলায় মালায় স্তূপ,
পায়ের তলায় এন্তার আগরবাতি আর লোবান,
বেশুমার ভক্ত পদচুম্বনরত কী খরায় কী বর্ষায়।

তাপ-ওগরানো জ্যৈষ্ঠের দুপুর, অচলায়তন-ধ্বসানো ঝড়,
জনগণ মাতানো ভাঙার গান,
খানকা শরীফের পাথুরে মূর্তি সমস্বরে বলছে-
বস্তুত এই আমিই কাজী নজরুল ইসলাম।

সৈয়দ হকের উদ্দেশে

বন্ধু, আমাদের যাত্রা ছিল নাকি নম্র আর বিনীত?
দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার রসদ ছিল কি ছিল না, ভেবে দেখিনি
একবারও; রক্তের ভেতরে কী এক ময়ূর
পেখম মেলেছিল, নূপুরের ধ্বনি তুমুল বেজেছিল
চিদাকাশে, রং বেরঙের পাখি আমাদের যৌবনকে
অপার স্নেহে দিয়েছিল সুরের ছায়া এবং
চৌদিকে নেমে-আসা ধোঁয়াশাতেও
আমাদের দৃষ্টি ছিল সর্বদা সমুখে নিবদ্ধ।

ধর্মীয় উন্মাদনার ঢাকের প্রবল আওয়াজ কখনো
আমাদের টানেনি, সাম্প্রদায়িকতার
দন্ত-নখর ভাঙার শপথ আমরা নিয়েছিলাম
যাত্রালগ্নেই, জঙ্গি পুরুত আর মোল্লাদের হিংস্র চিৎকার
আর প্রাণ সংহারের হুমকি উপেক্ষা করে
আমরা ভালোবাসেছি লালন ফকির এবং রবীন্দ্রনাথের গান।

আমাদের জীবন থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে
রাঙা রোদ; অতিক্রান্ত যৌবনের দিকে আজ তাকাই
মাঝে-মধ্যে, যেমন পিতা দৃষ্টি দেন পুত্রের প্রতি।
বন্ধু, আমার মনে পড়ছে সেই সদ্য যুবক তোমাকে, যে-তুমি
বিউটি বোর্ডিং-এর এক কোণে একটি টেবিলে বসে লিখতে
গল্প, উপন্যাস আর কখনো সখনো কবিতা।
সেখান থেকে তোমার লেখার খাতা গুটিয়ে নিয়ে
সবার অগোচরে কখন যে তুমি কাসবা, লাসানি, বেক্স, মিরান্ডা
ছেড়ে প্রবেশ করলে তোমার গুলশানের নিজস্ব স্টাডিতে
মনেই পড়ছে না। এখন তুমি স্থুলোদর ঝর্ণাকলম
কিংবা বলপেন ব্যবহার করো না, শুনি; পড়েছিও
তোমার কোনো কোনো লেখায়। এখন তোমার
সৃজনশীল আঙুলগুলো
কম্পিউটারে ক্রীড়াশীল, তোমার মেধা আর
সেই যন্ত্রের যুগলবন্দিতে রচিত হচ্ছে গল্পের বর্ণনা,
কাব্যনাট্যের সংলাপ আর কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।

বন্ধু, এই যে আজ তুমি অজস্র পুষ্পসম্ভারের মাঝখানে বসে
নিজেকে ভাবছ এক সব্যসাচী, তুমি জানো
এ তোমার মেধা, শ্রম ও নিষ্ঠারই উপহার। তোমার
বহুমুখী প্রস্রবণে স্নাত আমরা মুগ্ধাবেশে
চেয়ে আছি তোমার সাফল্যের স্বর্ণচূড়ার দিকে এবং
ভাবছি, আমাদের যাত্রা ছিল নম্র আর বিনীত।
কাঁটাতারের বেড়া ছিল, নানা চোরাবালি,
কিন্তু আমাদের চোখে ছিল দুর্মর
স্বপ্নের স্ফুটনোম্মুখ কুঁড়ি, আমাদের সর্বক্ষণ
পথ দেখিয়েছে মানবিক বোধের
রাহবার জ্যোতি; আমাদের পায়ে যত বেড়িই পরানো
হোক না কেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল স্থির
আর কালপুরুষকে এই ভূখণ্ডে নামিয়ে আনার
কেশর-স্ফীত স্পর্ধা ছিল আমাদেরই।

হেমন্ত সন্ধ্যায়

মেহন্ত হলুদ পিঠ খানিকটা চুল্‌কে নিয়ে উদাস হয়েছে
পড়ে না চোখের পাতা, কৃষকেরা শস্য কেটে ক্ষেত
নগ্ন করে ফিরে গেছে ঘরে; কিছুক্ষণ পরে
কুয়াশার বোরখায় ঢেকে যাবে সন্ধ্যায় শরীর।

কী করবো সন্ধ্যায় আজ? বসে থাকি একা, মাঝে-মাঝে
বাইরে তাকাই; নার্সারির
চারাগাছগুলো স্তব্ধ, আকাশে অস্পষ্ট চাঁদটিকে
চোখ টেপে নক্ষত্রের যৌথ প্রক্রিয়ায়।

আপন চেয়ারে বসে ঘন ঘন চুল টানি, ছিঁড়ি
শূন্যের কুসুম কত, কষ্ট পেতে থাকি
ক্ষণে ক্ষণে তার কথা ভেবে।
কোন্‌ সে সাঁকোর নিজে দাঁড়ানো আমার বিয়াত্রিচে?

মিলান ভেনিস কিংবা ফ্লোরেন্সেও নয়, এই শহরেই আজ
নিভৃতে করেন বাস আমার আপন বিয়াত্রিচে;
সময়ের রেণু সমুদয় উড়ে উড়ে তাকে ছোঁয়
আর তার আঙুলের ডগায় সোনালি মৌমাছির ধ্বনি জাগে।

হেমন্তে হরিদ্রাভ পিঠের ক্ষতটি
বলে, ‘কবি, আমাকে করাও স্নান, করো নিরাময়’
যে আমাকে ভালোবাসে তাকেই কাঁদিয়ে
বারবার, পুড়িয়ে নিজের চোখ অশ্রুহীন আমি;
কীভাবে সারাবো ক্ষত? কী করে ঝরাবো
অব্যর্থ শিশির আর্ত হেমন্তের পীড়িত শরীরে?

Exit mobile version