বেকার
উস্কোখুশকো যুবকটি অতল জলে সাঁতারহীন।
পকেট হাতড়ে সিগারেটের শস্তা
প্যাকেট খুঁজে নৈরাশ্যকে পায়। মলিন
অথবা ঝকঝকে কোনো নোট নেই
খুচরো পয়সাও পকেট পলাতক।
ভবিষ্যৎ ওকে ঘন ঘন দেখাচ্ছে মরীচিকা।
যুবক ক্লান্ত পায়ে বিকেলের রাস্তায় হাঁটে,
কখনো তাকায় কেতাদুরস্ত
কোনো দোকানের দিকে; সমস্ত
শহর থেকে চাকরিবাকরি গায়েব,
দরখাস্তের স্তূপের নিচে সম্প্রতি
ওর স্বপ্ন আর নধরকান্তি সাধের
ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পুলিশ
ওকে পরখ করে দূর থেকে, যেন সে ছিঁচকে চোর।
যুবক চকিতে দ্যাখে একটি মেয়ে
রিক্শায় ঝলক খেলিয়ে চলে গেল।
ওর পরনে কি ছিল শালোয়ার কামিজ?
মেয়েটিকে কোথায় যেন কোন্ কালে
দেখেছে মনে পড়ে?
একবার ইচ্ছে হলো পেছনে দৌড়ে গিয়ে
রিক্শা থামিয়ে এই হতচ্ছাড়া হালতে
কি কথা বলবে তার সঙ্গে সদর স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে?
অচেনা পথচারীর ধাক্কা খেল যুবক
মেয়েটি যে ওর পরিচিতা কিংবা একদা-সহপাঠিনী
হবেই তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে? মুখের
আদলে কিছু মিল থাকলেই ইচ্ছা এবং
বাস্তবের ফারাক ঘোচে না সবসময়
মেসের ময়লা বালিশে যুবা মাথা রেখেছে ভরসন্ধ্যায়;
আগামীকাল দৈবাৎ তার কোনো চাকরি
জুটে যাবে, এমন প্রত্যাশা নির্বোধ দুঃস্বপ্নের শামিল,
তবে উস্কোখুশ্কো চুল, ক’দিনের না-কামানো দাড়ি এবং
পেটে ক্ষুধার সুতীক্ষ্ণ কামড় নিয়ে
পায়রাময় এক চিলতে আকাশের দিকে তাকিয়ে
যে ভাববে, রিক্শার ঝলক অতল জলে
তাকে না চাইতে ধার দিয়েছে কিছু খড়কুটো।
মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভেতরে
মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভেতরে চলে যাই
উন্মুক্ত প্রান্তরে, হু হু হাওয়া
আমাকে জড়িয়ে ধরে, সখ্য আঁকে চুলে
জীর্ণ মুখমণ্ডলে, বাহুতে, ফুসফুসে।
অনেক করোটি দেখি মাটির ওপর
কেমন তাকিয়ে থাকে আমার দিকেই। সেই সব
করোটি ঈষৎ আচ্ছাদিত
ঘাস আর সজীব হলুদ কিছু ফুলে।
বালিকার হাত থেকে ছিটকে পড়া কোনো
পুতুলের ভাঙাচোরা টুকরোর মতোই
সেই সব করোটি ব্যথিত পড়ে আছে
স্বপ্নের ভেতরে আজ; প্রজাপতি বসে শূন্য চোখে কোটরে।
ওরা ভালোবেসেছিল আমাদের, আমাদের
দুঃস্বপ্ন বেষ্টিতে দেয়ালের
পাথরগুলোকে গুঁড়ো করে প্রত্যূষের দরজায়
হিরন্ময় স্বপ্নসৌধ দিয়েছিল গড়ে।
এখন ওদের ভুলে দিব্যি বসে চায়ের আসর,
কবিদের নিভাঁজ আড্ডায়
সময় কাটিয়ে দিই ঢের রাজা উজিরের মুণ্ডুপাত করে;
ছেঁড়া পকেটের গর্ত থেকে খসে-পড়া
মুদ্রার ধরনে শুষ্ক ধূলায় গড়ায় অগোচরে।
ময়ূরপঙ্খী নায়ের গাথা
প্রায়শ আমার স্বপ্নে একটি ময়ূরপঙ্খী নাও
ভেসে ওঠে কুয়াশায়। মাঝে মাঝে সে কোন্ ঘাটের
স্মৃতি পাটাতনে
কেমন ক্রন্দন করে, যেন শিশু ঘুমের ভেতর। কখনো বা
কিছু ছায়া সোনালি ময়ূরপঙ্খী নায়ে
হাঁটে, ঘোরে, নাচে দলে দলে।
দীর্ঘকায় সুকান্ত সারেঙ, চোখ যাঁর
মুক্তির আলোয় স্নাত, প্রবল ধরেন হাল, উত্তাল ঢেউয়ের
আঘাতে ময়ূরপঙ্খী নাও
কম্পমান ক্ষণে ক্ষণে। তবু তিনি গন্তব্য সন্ধানে
অবিচল মাল্লাদের নিয়ে এবং চৌদিকে তার
অমরতা গুঞ্জরিত স্বর্ণবর্ণ ভ্রমরের মতো।
কে এক তিরিক্ষি দাঁড়কাক অগোচরে
ঠাম মাস্তুলে বসে, ঠোকরায় পাল, মাঝে মাঝে
চিৎকারে বিদীর্ণ করে হাওয়া। কতিপয়
বিশ্বাসঘাতক আততায়ী ষড়যন্ত্রে মেতে
হঠাৎ হরণ করে সারেঙের প্রাণ। দিগ্ভ্রান্ত
জলযান ঘূর্ণাবর্তে পড়ে
হতে চায় খান খান। কুমন্ত্রণা, কুহকের
আমন্ত্রণ ময়ূরপঙ্খী নাওটিকে কত ভুল ঘাটে
নিয়ে যায়। আখেরে নকল সারেঙের
কাল শেষ হলে
বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে টালমাটাল নায়ের হাল ধরে
মনোনীতা সাহসিকা বাঙালি মানবী একজন।
সুবাতাস পাগুক নতুন পালে, মানবীর মাথায় ঝরুক
নিহত সুকান্ত সারেঙের
স্নেহের শিশির আর মাঝিমাল্লা, যাত্রীদের গানে
ময়ূরপঙ্খীটি যাক নতুন পানির স্রোত কেটে।
যখন কবিতা হরতাল করে
এই যে এখন চারপাশে যা ঘটছে ইতস্তত,
বস্তুত সেসব দেখে শুনে মন মেজাজ যখন
ভীষণ বিগড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের
গান কিংবা বেলায়েত খাঁর সেতার শোনার পর
আবার আকাশে চোখ রেখে
অথবা পেয়ারা গাছে আলোর কাঁপন
দেখে কিংবা জীবনানন্দের
কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়লেই সহজে মেজাজ খুব শান্ত নদী।
কখনো আমার টেলিফোন গৌরী বেশি
ব্যস্ত পেলে অথবা আমার কোনো কথা
তার মনে যদি কালো মেঘ
সৃষ্টি করে, ক্রোধের বেড়াল তাকে আঁচড়াতে থাকে,
আমার কথাই ফের লহমায় সেই কালো মেঘ
এবং বেড়ালটিকে বহুদূরে তাড়িয়ে ঝোঁটিয়ে নিয়ে যায়।
যখন কবিতা অকারণ হরতাল করে বসে
আমার বিরুদ্ধে কিছুকাল
তার মানভঞ্জনের কোনো উপাদান
কী নিসর্গে কী মানুষে কোথাও পাই না খুঁজে। সে যে
কোথায় আড়ালে আবডালে থাকে চিত্রকল্প, প্রতীক ইত্যাদি
নিয়ে আমি দেয়ালে নিয়ত মাথা খুঁড়লেও তার দেখা মেলা
ভার, তবে এ-ও জানি যদ্দিন আমার
হৃদয়ে জাগবে, রঙধনু বারবার
এবং আমার কাঁধে বসবে কোকিল, কবিতার
হরতাল প্রত্যাহার করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই আর।
যাঁরা মাথায় ইতিহাসের জ্যোতি-বলয়
যখন সুবেসাদিকে মুয়াজ্জিনের আজান
চুমো খেলো শহরের অট্রালিকার নিদ্রিত গালে,
ফুটপাতের ঠোঁটে, ল্যাম্পপোস্ট আর
দোকানপাটের নিঝুম সাইনবোর্ডের চিবুকে, বস্তির শীর্ণ শিশুর
শুকিয়ে যাওয়া ঘামের চিহ্নময় কপালে,
লেকের পানির নিথয়, পাখির নীড়ের স্নিগ্ধ নিটোল শান্তিতে,
তখন ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে
কয়েকটি কর্কশ অমাবস্যা ঢুকে পড়ল। অকস্মাৎ
স্বপ্নাদ্য হরিণের আর্তনাদে জেগে উঠে তিনি, প্রশস্তবক্ষ, দীর্ঘকায়,
সুকান্ত পুরুষ, যাঁর মাথায় ইতিহাসের জ্যোতি-বলয়,
এসে দাঁড়ালেন অসীম সাহসের প্রতিভূ।
কতিপয় কর্কশ অমাবস্যা, যাদের অন্ধকার থেকে
বেরিয়ে আসছিল পরিকল্পিত উন্মত্ততার বীভৎস জিভ,
তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিলো এক ঝাঁক দমকা বুলেট। ঈষৎ বিস্ময়-বিহ্বল,
অথচ স্থির, অটল নির্ভীক তিনি অমাবস্যার দিকে
আঙুল উঁচিয়ে ঢলে পড়লেন সিঁড়িতে। সেই মুহূর্তে
বাংলা মায়ের বুক বিদীর্ণ হলো; মেঘনা, পদ্মা, যমুনা, সুরমা,
আড়িয়াল খাঁ, ধরলা, ধলেশ্বরী, কুমার, কর্ণফুলি, বুড়িগঙ্গা এবং
মধুমতি তাজা রক্তে উঠল কানায় কানায়। বাংলায়
লহু-রাঙা ফোরাত বয়ে গেল, সীমারের নির্লোম বুক, শাণিত খঞ্জর,
ইমাম হোসেনের বিষণ্ণ মুখ আর কারবালা প্রান্তর ভেসে উঠল দৃষ্টিপথে!
আকাশের মেঘমালা, এই গাঙ্গের বদ্বীপের সকল গাছপালা,
হঠাৎ জেগে-ওঠা প্রতিটি পাখি,
হাওয়ায় কম্পিত ঘাসের ডগা, সকল ফুলের অন্তর
হয়ে গেল দিগন্ত-কাঁপানো মাতম;
বাংলাদেশ ধারণ করল মহররমের সিয়া বেশ।
সদর রাস্তায় একচক্ষু দানবের মতো ট্যাঙ্কের উলঙ্গ ঘর্ঘর
আজানের ধ্বনিকে ডুবিয়ে দিতে চাইল,
লাঞ্ছিত করল নিসর্গের প্রশান্ত সম্ভ্রমকে,
প্রত্যুষের থমথমে, ফ্যাকাশে মুখে লেগে রইল
নব পরিণীতার রক্তের ছোপ, যার হাতে
তার বুকের রক্তের মতেই টাটকা মেহেদির রঙ,
প্রত্যূষ মুখ লুকিয়ে ফেলতে চাইল
ভয়ার্ত বালক রাসেলের দিকে অমাবস্যাকে অগ্রসর হতে দেখে,
কতিপয়, অমাবস্যাকে হায়েনা-চোখে
মৃত্যুর নগ্ন নৃত্য দেখে
প্রত্যূষ থমকে দাঁড়াল, ধিক্কারের ভাষা স্তব্ধতায় হলো বিলীন।
স্মরণ করতে চাই না সেই সব পাশব হাতকে,
যেগুলো মারণাস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিল তাঁর বুক লক্ষ্য করে
যিনি দুঃখিনী বাংলা মায়ের মহান উদ্ধার;
আমাদের দৃষ্টির স্ফুলিঙ্গে ভস্মীভূত হোক সেসব হাত,
যেগুলো মেতেছিল নারী হত্যা আর শিশু হত্যায়,
আমাদের থুতুতে পচে যাক সেসব হাত,
যেগুলো তাঁকে মাটি-চাপা দিতে চেয়েছিল
জনস্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে, অথচ তিনি মধুমতি নদীর তীরে
গাছপালা, লতাগুল্মঘেরা টুঙ্গিপাড়ায়
দীঘল জমাট অশ্রুপুঞ্জের মতো সমাহিত হয়েও
দিগ্ধিজয়ী সম্রাটের ঔজ্জ্বল্য আর মহিমা নিয়ে
ফিরে এলেন নিজেরই ঘরে, জনগণের নিবিড় আলিঙ্গনে।
দেশের প্রতিটি শাপলা শালুক আর দোয়েল,
ফসল তরঙ্গ আর পল্লীপথ প্রণত তাঁর অপরূপ উদ্ভাসনে এবং
শ্রাবণের অবিরল জলধারা অপার বেদনায় জমাট বেঁধে
আদিগন্ত শোক দিবস হয়ে যায়।