পর্যটন
কবিতা লেখার খাতা, হ্যাঁ আমার খাতাটা চলেছে
গঙ্খীরাজে চেপে, চাঁদ আর
কালপুরুষকে, ছুঁয়ে ঢুকে যাবে
ব্ল্যাকহোলে; না, না, তা হ’তে দেবে না উল্কা,
লেজ দিয়ে পঙ্খীরাজটিকে ঠেলে ঠেলে
পাঠাবে মানস সরোবরে,
যেখানে অনেক রাজহংস, রাজহংসী ভাসমান।
আমার খাতাটা সোজাসুজি জলে নেমে
রাজহংসীদের গলা ধরে কিছুক্ষণ
কাটবে সাঁতার, স্তদ্ধ হবে।
কবিতা লেখার খাতা বুকে কিছু মেঘ ভরে নিয়ে
পর্বতচূড়ায় বসে হয়ে যাবে তরুণ ঈগল,
লড়বে সাপের সঙ্গে, যতক্ষণ শক্র
পরাস্ত না হয় পুরোপুরি।
খাতাটা প্রাচীন এক অট্রালিকা দেখতে পেয়েই
নির্ভয়ে প্রবেশ করে সন্ধ্যেবেলা ভগ্নস্তূপ, গর্তটর্ত, বিধ্বস্ত খিলান,
বাদুড়, গোসাপ গিরগিটি, বুনো ঝোপ
জয়োল্লাসে জুড়ে দেয় মায়াবী কোরাস-
‘কত যুগ যুগান্তর পরে এলে, বহুকাল পর অবশেষে
শোনা যাবে গান, বেজে উঠবে
ধ্বনির নূপুর।‘
আমার লেখার খাতা বলে সবিনয়ে-
‘আমিতো জানি না গান, বুকের ভেতর শুধু কিছু
কবিতা বেড়াই বয়ে।
হাজির জবাব, ‘ওই হলো, প্রকৃত কবিতা আর
গানে নেই কোনোই তফাৎ। অনন্তর স্তব্ধতায়
আশ্বস্ত আমার খাতা তন্ময় আবৃত্তি করে এবং অদূরে
কয়টি অমনোযোগী কঙ্কাল ধূসর, জীর্ণ তূলোট দলিল
দস্তাবেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে। অকস্মাৎ
কে, এক পূর্ণিমা-রঙ নারী এসে দাঁড়ায় সেখানে
বুঝি কবিতার টানে, খাতাটিকে গাঢ় চুমো খেয়ে
বুকে ওর আগুন রঙের এক ফুল গুঁজে দেয়।
আমার লেখার খাতা সৌরলোক, ছায়াপথ, ভাঙা
বাড়ি বুনো ঝোপ, মেঘ, পূর্ণিমা রঙের মানবীর
ঠোঁট আর ফুলের সৌরভ নিয়ে উড়ে
ফিরে আসে আমার টেবিলে। ওর বুকে
আনন্দের নদী বয় না কি
বিষাদের বালি ঝরে, বুঝতে পারি না। শুধু শুনি
কোনো কোনো মধ্যরাতে কেমন অস্পষ্ট কিছু ধ্বনি
কেবলি বেরোতে চায় ওর বুক চিরে স্বপ্নের ভেতর যেন।
বিশ্বেস না হ’লে বলি, হে আমার প্রিয়
পাঠক পাঠিকা প্লিজ কান পেতে শুনুন খানিক।
ফজুল টিকিট
আমরা কুয়াশাঘেরা জনসাধারণ
গোলকধাঁধায় ঘুরি, বুঝি কি না বুঝি, ঘুরছি তো
ঘুরছি শুধুই ডানে কিংবা বামে, কখনো বা খুব
সোজাসুজি। মাথায় কখন
মাথা ঠুকে যায় আর এ ওর শরীরে ধাক্কা লেগে
কোথায় কে যায় গড়াগড়ি;
সহজে পড়ে না চোখে। এরই মধ্যে সদর স্ট্রিট কি
গলি ঘুঁজি, যেখানেই হোক, কালো হিংস্র হাতগুলো
আমাদের সামান্য যা পুঁজি
লুট করে দেয় ছুট এমনকি সন্ত্রস্ত, আংশিক বজ্রাহত
জনকের সমুখেই দুহিতার সম্ভ্রম বিশদ
হয়ে যায় ছিনতাই অস্ত্রের ছায়ায়।
আমরা কুয়াশাঘেরা জনসাধারণ অবিরাম
গোলকধাঁধায় ঘুরি মরি। এ কী রঙ্গ এই বঙ্গে
চোখে পড়ে দিন দুপুরেই! সতেরোটি ঘোড়া আর
আজব সওয়াব আজ ন’শ’ বছরের
প্রেত সেজে রাজপথে মেতেছে যাত্রার ঢঙে ঢের
মিথ্যাচার আর বানোয়াট ইতিহাস প্রচারের
বিমূঢ় নেশায়
জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে।
প্রতিক্রিয়াশীলতার চোরা টানে অন্তঃসারহীন
মরা অতীতের পররাজ্যলোভী হামলাকারীর
প্রেতকেই ডেকে আনে ওরা বর্তমানে,
বিছিয়ে বিস্তর কাঁটা পথে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করে।
কাদাজল ঠেলে ঠেলে পথ চলি, অলিগলি খুঁজি,
যদি বেরুবার দিকচিহ্ন
পেয়ে যাই; কারা মুছে ফেলে দিকচিহ্নগুলি
কালি মেখে রাতারাতি? অকস্মাৎ শুনি
বাঁশির মধুর সুর। এমন আন্ধারে ভাসমান
মলখণ্ডময় কাদাজল ঠেলে ঠেলে
কে বাজায় বাঁশি? তার হাতে কেউ দেয়নি কি গুঁজে
ভীষণ গন্তব্যহীনতার কোনো ফজুল টিকিট?
বিনিময়
‘তোমার শরীরে এত ধুলোবালি কেন?’
আমাকে হামেশা প্রশ্ন করেন পাড়ার পাঁচজন
চোখে মুখে নানা মুদ্রা ফুটিয়ে। নীরব
থাকি, উত্তরের
ঝাঁপি ঢেকে রাখি। যদি বলি,
বহু দীর্ঘ পথ, বহু আঁধিঝড় আমার শরীরে
রেখেছে স্বাক্ষর, তবে তারা
কী করে নেবেন মেনে আমার বয়ান?
‘তোমার দু’পায়ে এত রক্তবিন্দু কেন?’
তাদের এ প্রশ্ন আমি নিশ্চুপ এড়িয়ে যাবো দূর
নক্ষত্রের দিকে
তাকিয়ে, আমার কষ্টচিহ্নগুলি থাক
উত্তরের নিঃসীম ওপারে। লোকগুলি
নির্বিকার হেঁটে চলে যায় এরই মধ্যে,
কিন্তু দু’জনের চোখে সহানুভূতির আর্দ্র
জন্মীলন দেখে মনে কৃতজ্ঞতা অশ্রুকণা হয়।
‘তোমার শরীরে এত পোড়া দাগ কেন?’
লোকদের প্রশ্ন ফের মৌমাছির মতো ওড়ে আমার চৌদিকে।
‘অগ্নিকুণ্ডে নিজেকে পুড়িয়ে এইসব
দাগ আমি অর্জন করেছি;
সহজে বলতে পারতাম। অথচ অদ্যমহীন
শীতল ঔদাস্যে লোকদের কাছে থেকে
বিবৃতি আড়ালে রাখলাম।
এ জীর্ণ শরীরময় ধুলোবালি, গাঢ় রক্তচিহ্ন
আর পোড়া দাগের বদলে
পেয়েছি নিজের মধ্যে কত লতাগুল্মোর চকিত জাগরণ,
ঝর্ণাধারা, বনদোয়েলের শিস, নক্ষত্রের গান-
এও-তো সঙ্কোচে
প্রিতিবেশীদের সত্যি পারিনি জানাতে।
বেঁচে থাকতে চাই
আমার দেহঘরে ধেড়ে ইঁদুরের মতো গর্ত খুঁড়ছে
নানা ব্যাধি, দৃষ্টিহীন বাদুড়ের
ডানার সৃষ্টিছাড়া ছায়া ঘনাচ্ছে আমার দু’চোখ।
অস্তিত্বের তন্তুজালে মাঝে-মধ্যে যে-উৎসব
জ্বলজ্বল করে তার স্থায়িত্বের সীমা ক্রমশ সঙ্কুচিত,
মাথার ভেতরকার দুঃস্বপ্নের দাঁত-নখের
ভয়ানক আঁচড় আমাকে বারবার দাঁড় কারিয়ে দেয়
খাদের কিনারে, তবু বেঁচে থাকতে চাই।
শক্ররা তূণ থেকে একের পর এক শর নিক্ষেপ করছে
আমার দিকে, আমাকে সুনামের
শিখর থেকে ধুলোয় ফেলে পদদলিত করার অভিলাষে
মত্ত কিছু ধর্মান্ধ, কুসংস্কার-পসারী,
আমার প্রাণ হরণের জন্যে ওদের জিভ লকলক করছে
নেকড়ের মতো, যাতে আমার
মুক্ত কণ্ঠস্বর বিজন হাওয়ায় হারিয়ে যায়, সে জন্যে ওদের
ষড়যন্ত্রের অন্ত নেই; তবু আমার বাঁচার সাধ সতেজ।
যে পাখিটি এইমাত্র রেলিঙ-এ উড়ে এসে বসল তার জন্যে,
বাগানের ফুলগুলোর জন্যে,
যে গাছের ছায়া আমার বারান্দায় নমিত প্রার্থনার মতো,
তার জন্যে, বাঁশবাগানের বৃষ্টির গন্ধ, গরুর মাথানের
সদ্যোজাত বাছুরের ঘ্রাণ আর দীঘির ঘাটে তরুণীর
ভাসমান কলসের জন্যে, ধানের ক্ষেতে কৃষকের
রৌদ্রঝলসিত কাস্তের জন্যে, গাঁয়ের বাড়ির বৈঠকখানায় দুপুরে
খাটে শুয়ে ঘুঘুর ডাকে ডুব দেওয়ার জন্যে, গহীন গাঙে
পালতোলা নাওয়ের জন্যে, রঙিলা নায়ের মাঝির
গানের জন্যে, সর্ষে ক্ষেতের প্রজাপতির জন্যে বাঁচতে চাই।
আমার মায়ের মুখের প্রসন্নতার জন্যে,
আমার জীবনসঙ্গিনী, সন্তান-সন্ততি, আমার সকল
ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্যে,
আমার চার বছরের পৌত্রী নয়নার কালো চোখের চাওয়া
আর ফুটফুটে হাসির জন্যে,
যাকে ভালোবাসি, তার জীবনের রৌদ্রজ্যোৎস্না
অনুভব করার জন্যে, তাকে আরো বেশি দেখার জন্যে
বেশ কিছুকাল বাঁচার আনন্দ পেতে চাই।
শীতের দুপুরে আকাশে চিলের চক্করের জন্যে,
ফুটপাতের পাশে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ মানুষের জন্যে,
ঘরেতে ভ্রমরের গুঞ্জনের জন্যে, নিশুত রাতে
কালপুরুষের উপস্থিতির জন্যে,
রবীন্দ্রনাথের গানের জন্যে, লালন গীতিকার জন্যে আর
আমার এখনো লিখতে না-পারা কবিতার জন্যে,
বাংলা কবিতার নতুন বাঁকে দাঁড়ানোর জন্যে,
আমার বেঁচে থাকার স্পৃহা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
প্রতিবাদী মিছিল থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে-আসা
ছোট ভাইয়ের মাথায় বড় আপার
হাত বুলিয়ে দেওয়ার অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্যে,
কারাগার থেকে জনগণনন্দিত রাজবন্দির মুক্তির জন্যে,
সংখ্যালঘুদের নীরব দেশত্যাগ বন্ধ হয়েছে,
স্বদেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই সংবাদ
শোনার জন্যে, দেশ ধুরন্ধর ফতোয়াবাজদের
দন্তনখর থেকে মুক্ত হয়েছে, ঘাতকদের অস্ত্রময় ডেরা
বিলুপ্ত হয়েছে জানার জন্যে, মানবতার বিজয়োৎসব দেখার জন্যে
ফিনিক্স পাখির মতো বারবার বেঁচে উঠতে চাই।