দুপুর এবং তোমার নিঃসঙ্গতা
দুপুরে বসেছিলে ড্রইং রুমে সোফায়;
বারবার তাকাচ্ছিলে টেলিফোনের দিকে, যদি
দোয়েলের মতো ঝাপ্সা অন্ধকারে
ডেকে ওঠে। তোমার বিরাগ আর অভিমান
ঘরকে অধিক পর করে দূর আকাশে
মেঘে মেঘে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দোয়েল
নীরব ছিল বলে তুমি উষ্মা প্রকাশ করলে
টেলিফোনের প্রতি।
তোমার হাতের দশটি নখ আরো সুঁচোলো
এবং আগ্রাসী হয়ে উঠল মুহূর্তে,
এখন কেউউ সামনে দাঁড়ালেই
হবে রক্তাক্ত, বুঝবে না কি তার কসুর?
কেন তাকে পশুর মতো আহত হ’তে হলো?
তুমি ফুঁসতে ফুঁসতে
এক সময় কেঁদে ফেলবে, দু’হাতে
ঢেকে ফেলবে মুখ।
বাড়ির পরিচারক আর পরিচারিকা
তোমাকে দেখে বিস্মিত হবে, আবিষ্কার করতে ব্যর্থ
হবে তোমার অন্তর্গত যন্ত্রণা, বেদনা।
তোমার অভিমান শুয়ে থাকবে বেড়ালের পাশে,
বৃষ্টিধারা তোমার নিঃসঙ্গতাকে
আরো বেশি শীতল, নিশ্চুপ এবং নিঃসঙ্গ করে তুলবে।
অবসাদ যখন গ্রাস করবে তোমাকে,
তখন তোমার স্তনাগ্রচূড়া
ছুঁয়ে ছুঁয়ে একজন কবির ভালোবাসা
সোনালি মৌমাছির মতো
গুঞ্জরণ তুলবে,
নিদ্রার আলিঙ্গনে মেঘ
হয়ে-যাওয়া তুমি, ক্ষোভ আর অভিমানের
তোষামোদে আচ্ছন্ন তুমি জানবে না।
দু’দিক থেকে
প্রথম দিন যে জায়গাটায় মুখোমুখি
বসেছিলাম তুমি আর আমি,
আজ এতদিন পরে আবার সেখানেই
আমরা দু’জন এসে বসলাম দু’টি চেয়ারে
প্রায় একই ভঙ্গিতে। সেদিন ছিল
গোধূলিবেলা আর আজ রাত্তির।
সেদিন আমরা দু’জনই
নিজেদের আড়াল করে রেখেছিলাম
সযত্নে, অজান্তেই হয়তো মুখে
টেনে নেয়া হয়েছিল মুখোশ। ভব্যতার বড় দায়।
সেদিন আমরা কথা বলেছি
ঠারে-ঠারে, অথচ আজ
আমাদের মুখ ও মন জুড়ে, কোনো মুখোশ নেই। জানালা
খুলে রেখেছি, আসুক যত হাওয়া,
রোদ, জ্যোৎস্না, কুয়াশা,
বৃষ্টির ছাঁট, ঝিঁঝির ডাক, জোনাকি।
আমরা দু’জন দু’দিন থেকে এসেছি-
তোমার শাড়ির পাড়ে গোধূলিরঙ, চুলে
আটকে রয়েছে রাত্রির কালো, স্তনাগ্রে সোনালি মৌমাছির গুঞ্জরণ
আমার ট্রাউজার্স দোয়েলের একটি পালক, ধূসর
পুলওভারে হলদে পুষ্পরেণু। মুহূর্তগুলোকে
আকণ্ঠ পান করছিলাম সুরাপায়ীর মতো।
প্রথম দিন আমাদের কারো মনেই হু হু করেনি
বিচ্ছেদের ভাবনা; সেই অস্পষ্ট গোধূলিতে
জানতে পারিনি কাকে বলে প্রকৃত বিরহকাতরতা। অথচ
আজ রাতে আমরা কেবলি
বিষণ্ন হয়ে পড়ছি
আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ভেবে। তুমি তোমার
অন্তরে একটি হরিণীর আর্তনাদ শুনতে পেলে
আর আমি একজন প্রায়ন্ধ বাউলের
করুণ দোতারার সুর হয়ে উঠলাম ক্ষণে ক্ষণে। আমরা
দু’দিক থেকে এসেছি, দু’দিকেই চলে যেতে হবে।
নিজেকে নতুন করে
নিজেকে নতুন করে গড়ে
তোমার নিকট যাবো বলে কিছুদিন
থেকে আর থাকি না হাজির
তোমার নিবাসে কিংবা অন্য কোনোখানে
তোমাকে দেখার জন্যে। এই আমি, যার
অবয়বে লেগেছে পুরানো
কিছু দাগ, কিছু ভাঙচুর
নিজেদের প্রবল জানান
দিয়েছে আমার অস্তিত্বের ভূমণ্ডলে।
আমি কি পারবো এইসব
ক্ষয়াচিহ্ন মুছে ফেলে দিতে?
আজ আমি সম্পূর্ণ নতুন হয়ে যাবো
একান্তে তোমার কাছে, যে আমাকে ফেলে
যেতে চায় পথপ্রান্তে উপেক্ষায়; যাবো
তারই সঙ্গে কিংবা তার আগে-
যেদিকে সৃজনশীল ঋতুর ঐশ্বর্য রয়ে গ্যাছে।
নিজেকে বদলে নিয়ে পারবো কি আমি
বাগানের সব ফুল গাছ
শিকড় সমেত তছনছ তুলে নিতে? পারবো কি
প্রজাপতিদের পাখা ছিঁড়ে ঢিবি বানাতে চৌদিকে?
পারবো কি কোনোদিন আগুন ধরাতে কারো ঘরে?
পায়রা হত্যায় মেতে ওঠা সম্ভব কি কখনো আমার?
চাই না করুণা সমবেদনার
সকল নিষ্ফল উচ্চারণ
কখনো আমার কাম্য নয়।
বরং নিজেকে ভেঙেচুরে বারবার
কাটব নতুন পথরেখা। চন্দ্রোদয়ে
রাত্রির শিশির ছুঁয়ে জমে থাকে অশ্রুকণা হয়ে
তোমার নিকট গিয়ে বলব কে বেশি বরণীয়
এখন তোমার কাছে? পুরাতন আমি নাকি এ নতুন জন?
পথের আহ্বান
‘এখানে জিরিয়ে নেই কিছুক্ষণ’ বলে এক শ্রান্ত রাহাগীর
গাছের সুবজ ছায়া নিজের শরীরে
মেখে নেয়; পাখি উড়ে গেল
পাতার আড়াল থেকে, অথচ লোকটা
নির্দয় নিষাদ নয় কোনো। হাতে তার
মারণাস্ত্র নেই, চেহারাও কর্কশতা হীনতার
ছাপ নয়; বরং দু’চোখে তার খেলা করে জ্যোতি,
মানবিক বোধ যার নাম।
আপাতত পথক্লেশে অবসন্ন সেই রাহাগীর
কোমল বিশ্রামপ্রার্থী, আঁজলায় ভরে নিতে চায়
শান্তিজলে অবিরল। ঝরা পাতাদের
কেমন রহস্যময়পথক্লেশে অবসন্ন সেই রাহাগীর
কোমল বিশ্রামপ্রার্থী, আঁজলায় ভরে নিতে চায়
শান্তিজলে অবিরল। ঝরা পাতাদের
কেমন রহস্যময় গান শুনে চোখ বুঁজে আসে।
তার, স্বপ্নাচ্ছন্নতায় সমস্ত শরীর
যেন কোনো ইন্দ্রজালে বন্দি হয়; মাথার গুহায়
ধ্বনি প্রতিধ্বনি জাগে বারবার, অতিকায়
একটি বেড়াল তাকে তাড়া করে, সারা মুখে বেড়ালের থাবা
সেঁটে থাকে ভয়ঙ্কর ভাবে,
রক্ত ঝরে, বোবা যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যায়
সত্তা; স্বপ্ন, মূলত দুঃস্বপ্ন,
তাকে কালো পাচনের বিরাট হাঁড়িতে
হঠাৎ নিক্ষেপ করে, প্রস্পেরোর অনুগত এরিয়েল এসে
উদ্ভ্রান্ত মানুষটিকে ভীষণ দেখায় ভয়। মিরান্দা কোথায়?
অকস্মাৎ মহুয়া, নদেরচাঁদ কংসাই নদীর ধারে হাত
ধরাধরি ক’রে হাঁটে, হুমরা বেদের বিষছুরি
আঁধারে ঝলসে ওঠে, রাহাগীর স্বপ্নের ভিতরে বুকচেরা
আর্তনাদ ক’রে কম্পিত শরীরে চোখ মেলে
নিভৃতে শুনতে পায় ‘এই দেশে উইড়া আইছে দেহি আমার আপন
তোতা পাখি। পথের আহ্বান তবু জোয়ারের জল!