তুষার-কবরে
এই কবিতা কি লিখতে পারবো শেষ পর্যন্ত?
‘তুমি নেই’ শব্দ দু’টি লাফিয়ে-ওঠা
মাছের মতো আমাকে স্পর্শ করার সঙ্গেই
আমার কলম ছাড়লো দীর্ঘশ্বাস,
আমার কবিতা লেখার খাতা জুড়ে
পোড়োবাড়ির হাহাকার;
নিমেষে ঝাপসা হয়ে এল বর্ণমালা, স্বরবর্ণ থেকে
ব্যঞ্জনবর্ণের পার্থক্য বোঝা
যাচ্ছিল না কিছুতে। না-লেখা পঙ্ক্তি দু’টির চোখে
জমে ওঠে শিশির।
শীতার্ত আঙুলের আলিঙ্গনে আমার কলম স্থবির;
জানলায় তোমার মুখ
রাখলে কী করে এই ভরসন্ধ্যায়? তোমার চোখ,
স্বর্ণাত গাল আর রঙিন ঠোঁট এমন জীবন্ত যে,
এই দৃশ্যটিকে দৃষ্টিভ্রমের ফল বলে ভাবতে পারা গেল না।
জানলা আর দেয়াল ভেদ করে নিশ্চিত
তুমি এসে দাঁড়াবে পাশে, বসবে শূন্য চেয়ারে,
খেলবে শাড়ির আঁচল নিয়ে, টেবিল থেকে
হাতে তুলে নেবে নতুন কোনো কবিতার বই অথবা
কোনো লিটল ম্যাগাজিন। হয়তো
গাঢ় তাকাবে আমার দিকে, পাঠ করতে চাইবে
আমার মুখের রেখাবলীর টেক্সট।
এসব কিছুই ঘটবে না; কেননা জানলায় তোমার
মুখ ছিল না, সেখানে এই মুহূর্তে
অনুপস্থিতির কুয়াশাময় ঊর্ণাজাল
ঝুলছে এবং আমার সত্তায়
তুষারাবৃত মেরুপ্রদেশের তীক্ষ্ণ নির্জনতায়।
এক পর্যটকের ছায়া আর ক্ষুধার্ত নেকড়ের চিৎকার।
কাঙ্ক্ষিত কবিতাটি শেষ পর্যন্ত তুমিহীনতার
তুষার-কবরে জমে থাকবে চিরকাল।
তোমাকে মনে পড়া না-পড়া
শহরের বুকে চেপে বসেছে একটা ভেজা কালো কম্বল
এবং আমি আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গে
পেশেন্স খেলছিলাম অনেকক্ষণ থেকে। ভাবছিলাম,
ঘরের ভেতর অন্তত কোনো বেড়াল থাকলে ভালো ছিল।
তুমি চলে যাবে অনেক দূরে, এই ভাবনার
রোমশ ইঁদুর যখন ধারালো দাঁতে
বেশ দক্ষতায় কাটছিল আমার হৃদয়তন্ত্রী, হঠাৎ
টেলিফোন গায়ক পাখি হয়ে উঠল;
তোমার কণ্ঠস্বর স্পর্শ করল আমাকে, চুম্বনের
স্বাদ পেলাম যেন। তুমি বললে, ‘কী করে থাকব
তোমাকে না দেখে? আমাকে বলে দাও কবি। আমার
কথা মনে কি পড়বে তোমার? কোন্ প্রহরে
আমাকে মনে পড়বে?
কিছুক্ষণ নীরবতাকে বইতে দিয়ে বললাম, যদি বলতে
কোন্ মুহূর্তে মনে পড়বে না তোমাকে,
তাহলে উত্তর দিতে পারতাম খুব সহজে।
যখন চুলে চালাব চিরুনি মনে পড়বে তোমার কথা;
যখন রবীন্দ্র রচনাবলীর পাতা ওল্টাবো,
তোমাকে মনে পড়বে আমার;
যখন কবিতা লিখতে বসব, তোমার ভাবনা
আমাকে আলিঙ্গন করবে; যখন
গোধূলিবেলা আকাশে পাখির পঙ্ক্তি
চোখে পড়বে, তোমার মনে পড়বে; যখন
নির্ঘুম শয্যায় এপাশ ওপাশ করব, কুয়াশাময়
পথের নিস্তব্ধতাকে অনুভব করব, তোমাকে ভাবব।
‘যদি গহন রাতে কালো আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে
হঠাৎ মৃত্যু এসে আমার দিকে
দাবা খেলার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, তোমার
এই অপটু, অনভিজ্ঞ কবি সেই মহূর্তে তোমাকেই স্মরণ করবে।
তোমাদের মুখ
তোমরা কি এখনও দেখতে পাচ্ছ না
তোমাদের মুখ? পাঁচ বছরে কী কদাকার আর বীভৎস
হয়ে উঠেছে তোমাদের মুখ,
তা কি চোখে পড়ছে না এখনও?
এত অন্ধ তোমরা যে
নিজেদের কদর্যতা, হিংস্রতা, স্বেচ্ছাচারিতা,
নগ্ন বর্বরতা-সব কিছুই এখনও
পরম মোহনীয় ঠেকছে!
মানুষের ভোটাধিকার তোমরা
কেড়ে নিয়েছ, তামাশা বানিয়েছ
গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে।
তোমাদের নির্লজ্জ জালিয়াতি
সংসদকে রূপান্তরিত করেছে
সার্কাসের তাঁবুতে, যেখানে
নকল, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়লদের
ভাঁড়ামো, জনতার হুঙ্কারে
মসনদ টলোমলো, অথচ প্রতারণা এবং
ধোঁকাবাজিতে দখল-করা সিংহাসন
আঁকড়ে থাকার কী লকলকে লালসা
তোমাদের মুখে ঝুলে রয়েছে।
তোমরা তোমাদের শিকারি কুকুরদের
ছেড়ে দিয়েছ নিরস্ত্র মানুষের
কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলার জন্যে।
তোমরা হত্যা করেছ কৃষকদের
ছাত্র আর রাজনৈতিক কর্মীদের,
তোমরা জেলখানায় পুরেছ প্রতিবাদী মানুষকে।
তোমরা তখন লাঠির আঘাতে ভূলুণ্ঠিত করেছ মতিয়া চৌধুরীকে, তখন
বাংলাদেশ প্রমিথিউসের চোখের মতো
ঝরিয়েছে আগুন।
তোমরা লাল শাপলার ফুল, দোয়েল,
কোকিল আর কৃষ্ণচূড়াকে পদদলিত করেছ,
কবিতরদের টুকরো টুকরো করে
ফেলে দিয়েছ আবর্জনার স্তূপে,
কবির হৃদয়কে করেছে রক্তাক্ত, তোমাদের
তাণ্ডবে শান্তি গা ঢাকা দিয়েছে
ভূতলবাসী রাজনীতিকের মতো,
সুন্দর গ্যাছে নির্বাসনে।
অসুস্থতার কারাগারে বন্দি আমি,
অষ্টপ্রহর রুগ্ন ফুসফুস নিয়ে বিড়ম্বিত।
নিষেধের তর্জনী আমার দিকে উদ্যত,
চিকিৎসকের কড়া বিধান
আমার পায়ে পরিয়েছে বেড়ি
তবু আমি ছুটে যেতে চাই রাজপথে,
যে আমার পদধ্বনি চেনে, সামিল
হতে চাই মিছিলে, জনতার মঞ্চে, যেখানে
মানুষ দৃপ্ত প্রত্যয়ে নজরুলের আগুন-ঝরানো
কবিতার মতো অঙ্গীকারাবদ্ধ আর সঙ্গীতময়।
জনসাধারণ আজ দাবানল এবং
বানের পানির মতো অপ্রতিরোধ্য,
অন্যায় আর অনাচারের নিকট স্তম্ভগুলি
গুঁড়িয়ে ফেলার জন্যে, স্বৈরাচারীদের
বিতাড়নের জন্যে,
ষড়যন্ত্রের ফাঁস ছিন্ন করার উদ্দীপনায়
নতুন পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে
পেশী সঞ্চারিত করছে, মুঠো ভরে তুলে নিচ্ছে সূর্য কণায়।
দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি
রাত্রির মখমল-আদর গায়ে জড়িয়ে
বসেছিলাম আমার ঘরে। পুরনো চেয়ারের আরাম
রাতের রেশমি অনুরাগের সঙ্গে উড়িত
এক যুগলবন্দিতে। আমার সামনে নগ্নিকার মতো
উন্মোচিত কবিতার খাতার। অনেকদিন পর রাত্তিরে
কবিতা লেখার জন্যে প্রস্তুত করেছি নিজেকে।
কবিতার একটি পঙ্ক্তিও লিখে উঠতে পারিনি
এক ঘণ্টার চেষ্টার পরেও। মাথার
পাতলা-হয়ে আসা চুল নিজেকে খুব অসহায়
মনে হচ্ছিল, হঠাৎ পথের কী একটা আওয়াজে
চমকে উঠি। কখন ক্লান্তির আঙুলগুলো আমার
চেতনাকে আস্তে ঠেলে দিল তন্দ্রার চৌহদ্দিতে,
টের পাইনি। কার উপস্থিতির আভায় ঘর
উদ্ভাসিত হলো এবং আমি চোখ কচলে দেখি
আমার টেবিলে হাত রেখে একটু ঝুঁকে
দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি। আলখাল্লা-পরা
অসামান্য ব্যক্তিটি যে রবীন্দ্রনাথ, চিনতে
দেরি হলো না। তিনি আমার কবিতার
খাতার দিকে তাকিয়ে রইলের কিছুক্ষণ।
আমি বিহ্বলতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্তায় সশ্রদ্ধ মুদ্রা। রবীন্দ্রনাথ
আমার কাঁধে চাপ দিয়ে বসতে বললেন আমাকে।
‘লেখো তুমি, কবির ধ্যানে বিঘ্ন ঘটাতে চাইনে,
তোমার উদ্যমে সাক্ষী হ’তে চাই’-শব্দগুলো তাঁর কণ্ঠে
ঝঙ্কৃত হলো সুরেলা বাদ্যযন্ত্রের মতো।
‘তিনটি অক্ষরের একটি শব্দের অভাবে আমি
শুরু করতে পারছি না আমার নতুন সনেট’, কোনোমতে
জানাতে পারলাম তাঁকে। কবিগুরু আকাশের সুদূরতায়
দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইলেন আগের ভঙ্গিতেই।
‘নিজেকে অপেক্ষা করতে শেখাও, এই আমি
আশি বছরের রবীন্দ্রনাথ একটি শব্দের জন্যে অপেক্ষা
করেছি প্রহরের পর প্রহর, দুপুরে কখনো
নরম শয্যায় শয়ন করিনি, পাছে ঘুমিয়ে পড়ে।
তোমরা তো জানো কত শ্রম আমাকে
করতে হয়েছে। সাধনায় যতি পড়েনি বলেই কবিতা
এসেছে আমার কাছে যেমন পাতা আসে গাছে,
মাছের ঝাঁক ভেসে ওঠে জলাশয়ে’- রবীন্দ্রনাথের
উচ্চারণে উৎসাহ-জাগানিয়া সুরের ঢেউ। আমি
তিন অক্ষরের একটি শব্দের জন্যে আবার সতৃষ্ণ হয়ে উঠি
‘তুমি অনেক প্রেমের কবিতা লিখেছ’, কবিগুরু মৃদু হেসে
বললেন, ‘তাই তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই আমার
কাদম্বয়ী বৌঠান যখন বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতার
কাছে আমার কবিতাকে তেমন আমল দিতেন না,
তখন, লুকাব না, ঈর্ষার আলপিন বিঁধতো
মর্মমূলে। বৌঠান কি সত্যি আমার জন্যে
আত্মহত্যা করেছিলেন, তুমি ভাব? আমি নিজে
সেই রহস্যে মুখ থেকে কখনো আবরণ সরাতে পারিনি।
শ্রাবণ রাত্রিকে জ্যোতির জোয়ারে ভাসিয়ে তিনি
নিরীক্ষণ করলেন আমার ঘর; অমরতা, তাঁর চিরসঙ্গী, তাঁকে
এগোনোর তাগিদ দেয়। নক্ষত্রের বর্ষণ বনবাণীর প্রতি উদাসীন
তিনি যাত্রা করলেন নিরুদ্দেশে, দিকচিহ্নহীন অনন্তে।
ভ্রমরের গুঞ্জরণের মতো কী একটা সুর বাজতে থাকে
আমার ভিতর, তিনটি অক্ষরের একটি শব্দ
জানলা দিয়ে উড়ে এসে বসলো আমার
কবিতায় খাতায়, শূন্য স্থানে বিদ্যুল্লতা, কেমন ফুলঝুরি।