কী সুদীর্ঘ অমাবস্যা ছিল
কী সুদীর্ঘ অমাবস্যা ছিল চতুর্দিকে,
বাদুড়ের ওড়াউড়ি, শেয়ালের কর্কশ চিৎকার
ছিল ভ্রষ্ট কালের জঠরে।
নেকড়ের হিংস্রতার মতো
ঝাঁঝালো বাতাস
খাবলে নিচ্ছিল নরমাংস ক্ষণে ক্ষণে,
কী এক অসুখ ভর করেছিল সবার ওপর-
কেউ কারো মুখ দেখে
ভরসা পেত না কিছুতেই, অনাস্থার অব্যর্থ বৃশ্চিক
চোখে মুখে বুকে সেঁটে ছিল সর্বক্ষণ।
তবুও ঘোড়েল কিছু লোক অন্ধকার
ছুঁড়ে ছুঁড়ে এক্কা দোক্কা খেলে
জমিয়েছে প্রভূত পসার নষ্টামিকে
পুঁজি করে, ওদের কুটিল চোখে ছিল
অফুরন্ত নোংরা ফেরেববাজি,
মুখের গহ্বরে লুফে লুফে
ধর্মের অসিদ্ধ ফাঁপা বুলি
ছড়িয়েছে তীব্র কূট আর্সেনিক মানব সমাজে।
এদের সগোত্র যারা তারা দেশে দেশে
সোৎসাহে নিষিদ্ধ করে গ্রন্থ আর পোড়ায় আক্রোশে
প্রসিদ্ধ শিল্পীর চিত্রমালা।
শত অনর্থের ধুম্রজালে নৈরাশ্যের গহ্বরেও
অনেকে আলোর জন্যে করে এবাদত,
ফসল ফলাতে চায় প্রেমে আর মননের ব্যাপক খরায়।
নান্দনিক ভাষা খুঁজে পায়। ইতিহাস
তাদের নিকট-
পাঠায় অজস্র প্রজাপতি; এই সব মানুষকে ঘিরে
রূপালি ঝর্ণার উচ্ছলতা,
দিগ্ধলয়ময় রঙধনুর স্ফূরণ,
অক্ষরবৃত্তের আভা, ইতিহাস প্রেরিত বর্ণিল
অগণিত প্রজাপতি, পাখির উড়াল।
কে আমাকে অমন ডাকে
শয্যাশায়ী ছিলাম ক’দিন। বিকেলে
শয্যার পাশে আমাকে কিছু একটা
হাতড়াতে দেখে
ঘরের দেয়াল ভাবল ভ্রম হয়েছে
আমার। আসলে আমি যে
তখন কল্পরাজ্যে কিছু চিত্রকল্প এবং প্রতীক
কুড়োতে মগ্ন তা দেয়াল, লেখার টেবিল,
বুক শেল্ফ্-কেউই ঠিক
ঠাওর করতে পারে নি।
মৃদু হেসে পাশ ফিরে শুতেই
কোথাকার এক ক্ষ্যাপা বাউল ঘরে ঢুকে
দোতারা বাজিয়ে জুড়ে দেয় নাচ। এ কোন্ সাঁই
আমার কবিতার খাতার মরুভূমিতে
সুরের ঝর্ণাধারা মুদ্রিত করতে চায়?
তাকে বারণ করা সাধ্যাতীত ভাবছি,
এমন সময় একজন তরুণ কবি
এবারের বইমেলায় তার কোনো কবিতার বই
প্রকাশিত না হওয়ার দীর্ঘশ্বাসে
আমাকে ডুবিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। আমি
তার দীর্ঘশ্বাসের স্বরলিপি টুকে রাখার জন্যে
বলপেন হাতে তুলে নিতেই
সে নিমেষে গেল শৈত্যপ্রবাহে আর
তখনো আমার ঘরে ক্ষ্যাপা বাউল
কখনো ভুল ঝাঁকিয়ে, কখনো পাক খেয়ে
নিয়ে আসে ধু ধু গেরুয়া প্রান্তর, গহন ছায়া।
প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর কে আমাকে অমন ডাকে
বারবার ফাল্গুনের দুপুরে?
কোনো কোকিল অথবা দোয়েল নয়,
যেন এক বুকচেরা আর্তনাদ আপন
শহরের চৌদিক থেকে উঠে আসছে ক্রমাগত;
ব্যাকুল বেরিয়ে পড়ি গলির মোড়ে,
খোলা রাস্তায়। বুলেটবেঁধা বাংলা ভাষার
রক্তস্নানে বিহ্বল আমি
ওর বুক থেকে সীসাগুলো তুলে নিয়ে সেখানে
গুচ্ছ গুচ্ছ পলাশ রেখে দিই নত মাথায়।
কোকিল কাহিনী
একটি কোকিল খুব আড়ালেই থাকে সর্বক্ষণ; কেউ তাকে
সহজে দ্যাখে না কোনোখানে, ঘর দোর
কিছু নেই, গুছিয়ে-টুছিয়ে
বসবাস বস্তুত স্বভাবে নেই তার। একজন
কমজোর নজরের কবি শত চেষ্টা চরিত্তির
করেও স্পস্টত ওকে আজ অব্দি দেখতে পায়নি।
কোকিলটি সুর তোলে গ্রীষ্মে ও বসন্তে অবিরত,
এমনকি কনকনে শীতেও কখনো।
হঠাৎ কী হলো তার এক ঝাঁক সুরছুট পাখির সংসর্গে
গিয়ে গান ছেড়ে কিছু কর্কশ আওয়াজে
মেতে ওঠে ঘন ঘন; গান ওকে ছেড়ে
যায়-যায়। কিছু কাল পর
কোকিল সংবিৎ ফিরে পেয়ে
গলায় ফোটাতে চায় গানের গোলাপ।
অথচ ঝরে না সুর, কণ্ঠ ছিঁড়ে যেতে
চায় বিসদৃশ
স্বরের ধমকে; শেষ রাতে কোকিলের বুক থেকে
হঠাৎ বেরোয় তাজা রক্তের ঝলক
এবং আখেরে সেই মুমূর্ষ পাখির
কণ্ঠের অকূল ব্যাকুলতা বেয়ে ঝরে
শুধু গান, নতুন, অতুলনীয় আর
মুগ্ধতায় মগ্ন হয় প্রত্যুষের আভা, পথ, শিশির, গোলাপ।
ক্লিনিক থেকে ফেরার পথে
দূর থেকে বাড়িটাকে মনে হয় অনেক
কান্নার বাষ্পরাশি আর হাসির রৌদ্র দিয়ে তৈরি।
কখনো কখনো মনে হয়, একজন প্রত্যাশা-বৃক্ষ
তার প্রসন্ন ছায়া বিছিয়ে
দাঁড়িয়ে আছেন-সেখানে আমার মাকে
তাঁর তিরাশি বছরের রৌদ্রছায়া সমেত
রেখেছি। তাঁর হৃৎপিণ্ডে
বড় রকমের একটি ধাক্কা লেগেছে।
দু’দিন পর যখন
বেডের পাশে তাঁর হাত ধরে
বসেছিলাম, তিনি তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যেও
ঘরের ভাড়া কত জানতে চাইলেন উদ্বিগ্ন কণ্ঠে। মা আমার,
নিজের শারীরিক যন্ত্রণা এবং
পুত্রের আর্থিক সঙ্গতিকে এমন মুহূর্তেও
তুলাদণ্ডে স্থাপন করলেন দেখে
আমার বুকের ভিতর কেমন হু হু করে ওঠে।
‘কখন আমি বাড়ি যাব’ বাক্যটি
কেন যে তিনি আবৃত্তি করছেন বারবার,
কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করি।
এই রাতে এখন আমাকে যেতে হবে তাঁকে ছেড়ে,
তাঁর সঙ্গে রাতে থাকবে আমার কোনো বোন
অথবা অন্য কোনো নারী
রোগশয্যার পাশে মেয়েদের করতে হয় রাত্রিযাপন!
এখন আমার খুলির ভেতর, শিরায়
বুলবুলি মতো নাচানাচি শুরু করেছে
একটি পঙ্ক্তি; ঐ তো আমার লেখা আমাকে ডাকছে।
ছুটতে থাকি
হঠাৎ জেগে উঠে দেখি মধ্যরাত। আন্ধার ঘরে
এক গা ঘেমে কেমন হাঁসফাঁস করি,
মনে হ’লো একটা অক্সিজেন মাস্ক হলে বাঁচি। বিছানায়
অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও নির্ঘুম।
কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম
কে যেন কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে; সেই
ক্রন্দনধ্বনিকে অনুসরণ করে পৌঁছে যাই
পড়ার ঘরে। জানলার শিক নয়, বুক শেলফ নয়,
পর্দা নয়, আমার পুরনো লেখার টেবিলের
বুক চিরে বেরুচ্ছে কান্না। এর আগে
কোনোদিন এরকম কিছু ঘটেনি। কে এই
তরুণী যে নিশুত রাতে ঝরিয়ে দিচ্ছে মনোবেদনা?
কাঠের টেবিল বেদনার্ত স্বরে বলল
একটি বনের কথা, তার বৃক্ষ স্বজনদের বৃত্তান্ত,
সে বললে এক যুবক-গাছ আর
তার প্রণয় কাহিনী। হাওয়ার দোলায় ওরা
পরস্পর মুখচুম্বন করত সক্কালবেলা, জ্যোৎস্নারাতে,
এত কাছাকাছি ছিল দু’জন।
একদিন বিহানবেলা কিছু লোক ওদের কেটে
সাফ করল বনের একাংশ আর সে কী কান্নার
রোল পড়েছিল সেদিন। বিরহিনী গাছ-তরুণী
আখেরে ছুতোরের কারিগরির সুবাদে
পেলো টেবিলের ডৌল, যার ওপর
এখনো চাপানো রয়েছে কিছু বই, রাইটিং প্যাড, টেবিলল্যাম্প
টেলিফোন সেট আর গাঢ়-নীল ডায়েরি,
যাতে আমি অনেক খুঁজে খুঁজে
জড়ো করেছি বিস্তর নক্ষত্রকণা এবং
প্রবালের টুকরো। আমি চেয়ারে বসে
ব্যথিত হৃদয়ে শুনলাম গাছ-তরুণীর
প্রিয়-বিচ্ছেদের কাহিনী।
লেখার টেবিলের কান্না থামতেই, সেখান থেকে
হাঁস আর বীণা হাতে উঠে এলেন
এক অনিন্দ্য প্রতিমাপ্রতিম নারী
সফেদ হাঁসের ডানার একটি পালক খসিয়ে আমার হাতে
তুলে দিয়ে বললেন, ‘তোমাকে এ আমার উপহার
এখন থেকে এটাই হোক তোমার লেখনী।
হাঁসের পালক ভাসতে থাকে হাওয়ায় আর
আমি তার পেছনে পেছনে ছুটতে থাকি ছুটতে থাকি।