একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখে
কনকনে শীত সন্ধ্যায় একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী
দেখতে গিয়েছিলাম। নামজাদা অনতিতরুণ
আলোকচিত্রীর অনেকগুলোর ফটোগ্রাফ
দেখবার সুযোগ কে হারাতে চায়
এবং সেই ফটোগ্রাফার যদি হন
বিশেষত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কেউ।
আলোকচিত্রমালায় সৃজনশীলতার স্পর্শ
আমার নান্দনিক বোধকে উদ্দীপিত করে, মুগ্ধতায়
বুঁদ হয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ
একটি ছবি আমাকে কাদাখোঁচার ধরনে
অসম্ভব ঠোকর মারে। সেই ফটোগ্রাফ নির্লজ্জ, ন্যাঙটো
গৌরবে তুলে ধরেছে এমন এক সংবাদপত্রকে,
যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, জাতিসত্তা, ধর্মনিরপেক্ষতা
এবং প্রগতির নাছোড় দুশমন। একাত্তরের
শহীদ মুক্তমতি বুধগণ আর অন্যান্য বুদ্ধিজীবী, যাঁদের
লাঞ্ছিত করে সেই পত্রিকা বারংবার,
আমার উদ্দেশে বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে
বললেন যেন প্রদর্শনী কক্ষের বুক চিরে, ‘প্রতিবাদ করো।
শিল্পীকে আমি ছবিটি সরিয়ে ফেলতে সবিনয়ে
অনুরোধ জানালে তিনি আমাকে
মানবতার কিছু সবক দিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে
নিজের জেদের ঝুটি আঁকড়ে রইলেন। উন্নাসিক, কলাকৈবল্যবাদী
অধ্যাপকের ঢঙে দর্শকদের জানিয়ে দিলেন
রাজনীতি ধুলোয় গড়ায় আর মানবতার অধিষ্ঠান
আকাশছোঁয়া পর্বতচূড়ায়। পেরুবিষয়ক
একটি ছবি তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন ক’জন তরুণ-তরুণীর কাছে।
আমার মুখের ভেতর তখন থুতুর লাভা, থুতু সেই
আপত্তিকর পত্রিকার ফটোগ্রাফের দিকে না কি নিজের সত্তায়
ছুঁড়ে দেবো স্থির বলতে না পেরে একটি শিং-অলা
ক্ষুব্ধ হরিণের মতো প্রদর্শনী-কক্ষ থেকে নীরবে বেরিয়ে গেলাম।
একটি দোয়েলের জন্যে
শীত বিকেলের পড়ন্ত রোদে
টিভি ত্র্যান্টেনায় এসে বসলো
একটি দোয়েল। ভাবছি,
গানে-পাওয়া এই পাখি তার পারি
ছন্দোবদ্ধ সেই শব্দস্তবক।
হে পাখি, আর কতক্ষণ তোমার শিস
হাওয়াকে সঙ্গ দেবে? মুগ্ধ করবে
আমার মতো মর্ত্যজীবীকে?
কে আছে এমন যে তাড়িয়ে দেবে
এক ঝটকায় এরূপ মাধুর্যকে?
ছোট্র এ সুন্দরকে অকস্মাৎ গুলিতে
বিদ্ধ করবে কোন্ পাষণ্ড?
তবু আশঙ্কা-মেঘে
ঢেকে যায় মন, একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকি
সঙ্গীতময় ত্র্যান্টেনার দিকে এবং
তোমার মুখ
সুদূর ছায়াপথ বেয়ে
নক্ষত্রের ভিড় উজিয়ে
আমার কাছে এল নিঃশব্দে, যেন
চাঁদের পালকি থেকে নামলে তুমি।
আমি সিএ দোয়েলকে
মিনতি জানালাম
তোমার উদ্দেশে একটি প্রেমের গান
গাইবার জন্যে। অথচ পাখি কখন উড়াল দিল
জানতে পারিনি। অপ্রস্তুত আমি
আমার থরথর হৃদয়কে
একটি দোয়েল কিংবা কোনো গুণীর তান হয়ে উঠার জন্যে
নিজের সত্তায় অজস্র তারা ফোটাতে থাকি।
কবি সম্পর্কিত মেডিক্ল্ বুলেটিন
আট বছর পর কবিকে আবার ডাকছে
স্ট্রেচার, নার্সের হাঁস সফেদ ত্র্যাপ্রোন, মেজার গ্লাস, শীর্ণ বেড, স্টেথিস্কোপ
চিকিৎসকের ঝুঁকে থাকা,
অনুসন্ধানী চোখ;
কবিকে হাসপাতলের বেড ডাকছে পাঁশুটে আঙুল নেড়ে।
বুলেটিন-১
যে পাড়ায় কবির বসবাস, সেখানকার
সবগুলো গাছ পাতা হারিয়ে এখন কংকাল,
টবের প্রতিটি ফুল প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই
পোকার খোরাক-হয়ে যাচ্ছে বেশ ক’দিন থেকে,
প্রতিক্রিয়ার
ইদানীং কবির বিবমিষা, ভেদবমি।
বুলেটিন-২
শহরময় দাঁড়কাকের দাপট সহ্যশক্তিকে
হামানদিস্তায় ভীষণ গুঁড়িয়ে দিয়েছে;
কোকিল-তাড়ানো দাঁড়কাকের দঙ্গল ক্রমাগত
ঠোকরাবে নান্দনিকতা আর মানবিকতাকে;
কোকিলের গানবিহীন ধূসর বসন্তের দিকে তাকিয়ে
কবি খুকখুক কাশছে, কাঁপছে ঘুসঘুসে জ্বরে।
বুলেটিন-৩
সিংহভাগ ভোটারহীন ভোটকেন্দ্রে ভূতুড়ে ভোটভর্তি
বাক্সগুলোকে হৈ হৈ ফুলচন্দন দিয়ে
ঢোল-শোহরতে অবৈধ সাংসদদের রুপালি পালকিতে চড়িয়ে
বসানো হয়েছে কুরসিতে। লাঠিচার্জ,
টিয়ারগ্যাস, রবার বুলেট, খালিশ গুলি, নরহত্যা-
অতঃপর কবির ঘনঘন রক্তবমন।
বুলেটিন-৪
সিন্দাবাদের বুড়োর মতো মানুষের কাঁধে চেপে-বসা
মেকি সরকারের অঙ্গুলি হেলনে, আজব কাণ্ড,
সেনাবাহিনী মোতায়েন ঘাসফুল, ফড়িং
প্রজাপতি আর পাখির নীড় সমুদয়
ক্রুদ্ধ বুটের তলায় পিষে ফেলার জন্যে। স্পেশালিস্ট
চিকিৎসকদের ডায়াগনসিস-কবি সম্প্রতি মানসিক রোগী।
বুলেটিন-৫
আখেরে ক’দিন ইন্টারোগেশনের পর কবিকে বিশেষ
ব্যবস্থাধীনে হেমায়েতপুর পাঠানো হলো! তামাম শুদ্
কবির অনুগামী
‘আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে; এই সব
সভা সমিতির কোলাহল,
এ পুনরাবৃত্তি
আমাকে ক্লান্তির ঘাটে ভিড়িয়ে দিয়েছে অবেলায়’,
বলে তিনি দ্যাখেন বিস্ময়ে
এখন চাঁদের মুখে অন্তঃসারশূন্য কথামালা,
খসড়া প্রস্তাব আর সাড়ম্বর গঠনতন্ত্রের
ছাপ লেগে আছে, যেন বসন্তের দাগ। হঠকারী
শ্লোগানসমূহ নক্ষত্রের পাড়ায় জাগায় ত্রাস
ঘন ঘন, চতুর্দিকে মেধার মড়ক।
তিনি প্রায় দাঁড়াতে অক্ষম, হাঁটু যন্ত্রণায় চাপে
বেঁকে যেতে চায়, জুতো জোড়া
ভীষণ অস্বস্তিকর ঠেকে, ছোঁড়া মোজা
বড় ঢিলে, কবিদের মঞ্চে অ-কবিতা
করে দাপাদাপি, অসহায় নতমুখ কবি নষ্ট
শোরগোল থেকে আস্তে করেন প্রস্থান।
করতালি-রহিত, ব্যথিত
কবির পেছনে যায় জোনাকি, মল্লিকা, প্রজাপতি,
মেঘ, শিরিষের পাতা, বিনীত দোয়েল
নক্ষত্রের গহন মিছিল।
কাজী নজরুল ইসলামকে নিবেদিত
আপনি এবং আমি, নজরুল ইসলাম, আমরা দু’জন
পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে চলেছি কেবলি। আপনার এখন তো
কিছুই কেনার নেই; আপনার ভাণ্ডার সে কবে থেকে পূর্ণ,
আমি আজো শূন্য হাতে ফিরি কখনো দুঃখিত ঘাটে,
কখনো বা আঘাটায়। আপনার কোনো তাড়া নেই প্রকৃতই;
কেবল যে কালো বুনো ঘোড়াটা সে রাতে অতিশয় ম্রিয়মাণ
হাসপাতালের বেডে ফেলেছিল কেমন নিঃশ্বাস বারংবার,
তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে হয়তো বা, নাকি অন্য দৃশ্য কোনো?
আপনি এবং আমি, নজরুল ইসলাম, আমরা দু’জন
পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে চলেছি, মরুভূমি, মরূদ্যান
পেরিয়ে পেরিয়ে বনভূমি এসেছি বিপণী কেন্দ্রে আপাতত।
তাহলে শুনুন কবি, দোহাই পথের, কিছু কথা, যা এখনো
অকথিত, জানতে ইচ্ছে করে খুব-যখন সে কালো ঘোড়া তার
কেশর দুলিয়ে আপনাকে পিঠে নিয়ে ছুটে গেল মেঘলোকে
তখন কি কারো মুখ দেখবার আশায় আপনি আপনার
অমন বিখ্যাত চক্ষুদ্বয় মেলে দিয়েছিলেন ব্যাকুল চতুর্দিকে?
আপনার সাধ কবিতার বাগান বাড়ির মতো অন্তরালে
বড় বেশি ছায়া-ঢাকা রয়ে গেছে, আপনিও আর্ত মহাদ্বীপ!
নজরুল ইসলাম, উদার রাজার মতো চলেছেন হেঁটে
আর আমি আপনার পাশে সংকুচিত সর্বক্ষণ, অথচ কী
ব্যাকুল হাঁটছি একা-একা। কিছুই কেনার নেই আপনার,
অতিশয় নিঃস্ব আমি, আমার রসদ চাই সকাল-সন্ধ্যায়।
আমাকে কিনতে হবে এখনো অনেক কিছু-এই তো দোকানে
সোনালি আপেল আর সুনীল গীটার, মুখচ্ছবি-চিত্রকল্প
টোমাটোর অন্তরালে উপমা এবং আঙুরের অন্তঃপুরে
প্রতীক কিনতে হবে। আপনার কিছুই কেনার নেই আর।