আমাকে বলে দেবে
এই শীতদুপুরে কোন্ দিকে মুখ রেখে তুমি দাঁড়ানো?
তুমি কি বসে আছো তোয়ালে বিছিয়ে
তোমার জীবনসঙ্গীর সান্নিধ্যে সমুদ্রতীরের চওড়া
রঙিন ছাতার তলায়?
চারদিকে রোদ ছড়ানো, জল আর বালি
চিকচিক করছে অভ্রের মতো; তোমার
টুকরো টুকরো কথা ভেসে বেড়াচ্ছে
হাওয়ায়, দৃষ্টি মেলে দিয়েছে সমুদ্রের বিশালতায়।
আকাশ আর সমুদ্রের মিলন দেখে
তোমার কি মনে পড়ছে আমাদের চুম্বনের কথা?
মনে কি পড়ছে আমাদের দু’জনের একান্ত
মুখোমুখি বসে থাকার মুহূর্তগুলো? মনে কি
পড়ছে উড়ে-যাওয়া সেই পাখির কথা, যে আমাদের
কোনো কোনো কথা ডানায় মেখে নিয়েছিল?
তোমার অনুপস্থিতির বেদনা সহনীয়
করে তুলতে চাইছি, অথচ অন্তর্গত এক অভাববোধ
কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরেছে আমার শ্বাসনালী;
শূন্যতার হারপুন আমাকে
শিকারে সফল ক্রমাগত। নিজেকে দেখতে পাচ্ছি অশেষ
এক কৃষ্ণ গহ্বরে অপ্রতিকার্যরূপে আটক।
কেন তুমি এভাবে চলে যাও পেছনে এক
দীর্ঘচঞ্চু ভয়ঙ্কর পাখিকে রেখে,
যে আমার হৃৎপিণ্ড ঠোকরাতে থাকে বিরামহীন
এবং আমাকেই পান করতে বলে রক্তধারা? কেবলি
তোমার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠি, কী এক কুহক
আমাকে নিয়ে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন ফণিমনসার বনে।
কে এই দুঃস্বপ্ন-তাড়িত আমাকে মুক্তি দেবে
তুমি ছাড়া? এখন কি এই দুপুরের রোদ, সন্ধ্যার
পাখি, রাত্রির নক্ষত্র, শিশির অথবা জোনাকি,
বলে দেবে আমাকে এই মুহূর্তে তুমি কোথায়?
আশেক লেনের বাড়ি
বাইরে ঝোড়ো হাওয়া আর তুমুল বৃষ্টি;
এক সময় হাওয়ার বেগ এল ঝিমিয়ে, বৃষ্টির ঘুঙুরও
ক্লান্তিতে ঢিমে হয়ে বাজে, আকাশে
তারার ফুটে ওঠার কামনার স্তব্ধতা। আমার
মাথার ভেতর অনিদ্রার কুচকুচে কাক ডাকছে
অবিরত; লালন-গীতিকা নিয়ে চেয়ারে বসতেই
দূরের পথ থেকে ভেসে আসে কোনো বাউলের গলার
আওয়াজ নয়, মনে হলো এই ধ্বনি আমার খুব চেনা।
লালন-গীতিকা পড়ে রইলো টেবিলে আর
আমার চিনতে ক্ষণকাল দেরি হলো না কয়েক বছর আগে
ছেড়ে-আসা আমাদের কদিমী কালের
আশেক লেনের বাড়ির কণ্ঠস্বর।
সেই কণ্ঠস্বর আমাকে কেমন শ্যাওলা-জড়ানো
সুরে বলে, ‘তোমার বাসর রাতের আভার তাজগীতে
নববধূর মতো উদ্ভাসিত হয়েছিল
আমার পুরোনো হতশ্রী মুখ,
তোমার মনে পড়ে না? অনেকগুলো শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত, বর্ষা
তুমি কাটিয়েছ আমার নিবিড় সান্নিধ্যে।
আমার ছায়ায় বসে ছুটে বেড়িয়েছ তেপান্তরে, দেখেছ
পদ্মপাতায় শিশির, নারকেল গাছের মাথা দোলানো।
বর্ষার দিনে জল থই থই আমার উঠানে তোমার
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভাসিয়েছে কাগজের নৌকা, তোমার পিতা
ভেসে গেছেন অনন্তে আমারই এক বড় ঘরে অদৃশ্য ভেলায়।
স্কিটসৌফীনিয়া-অধিকৃত তোমার ছোট ছেলে
কত ঝাঁ ঝাঁ দাপাদাপিই করেছে আমার ঠাণ্ডা মেঝেতে;
কত দাঁড়কাক যে কী ভীষণ ঠোকরাতো ওর করোটিকে!
‘তোমার কবিতা লেখার খরাকালীন মুহূর্তগুলো
কতবার ভরিয়ে দিয়েছি সৃজনী ধারায়-
মানে, তোমরা যাকে প্রেরণা বলে থাকো,
সেরকম ভূমিকাই মাঝে-মধ্যে পালন করেছি নীরবে।
শুনছি, এখন তোমার সত্তায় খ্যাতির রৌদ্র-জ্যোৎস্না
লুটিয়ে পড়ছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল এই আমারই অঙ্গনে,
কবি হিশেবে তোমার নাকি খুব নাম ডাক
হয়েছে আজকাল। কিন্তু কই বন্ধু, হে সখা আমার, তুমি তো
আজ অব্দি আমাকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখলে না। অথচ
আমার চোখের নিচে কত কবিতাই তো লিখেছ কত বিষয়ে।
‘যখন ওরা শাবল কোদাল দিয়ে উপড়ে নিচ্ছিল
আমার হৃৎপিণ্ড, আমার হাড়গোড় গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল বুলডোজারে,
তখন আমার বিপন্ন অস্তিত্ব যে আর্তনাদ করেছিল
তা, রয়ে গেল তোমার শ্রুতির অগোচরে। আমি এখন
হাইরাইজ দালান, তবু মাঝে-মাঝে
বুক ঠেলে বেরোয় পুরোনো কান্না। হা কপাল, তুমি
একবারও দেখতে এলে না আমাকে। এই পাথুরে
শহরে বাস করতে করতে তোমার হৃদয়ও কি
কংক্রীট হয়ে গ্যাছে? নইলে এতোদিন, আমার মনোবেদনা
ফুটতো অন্তত তোমার দু’চারটি পঙ্ক্তিতে!
লালন-গীতিকার ওপর হঠাৎ একটা মাউথ অর্গান
মেতে ওঠে বাউলনৃত্যে, আর চমকিত আমি
ডায়েরি খুলে নিশুত রাতে কবিতা লিখতে শুরু করি
আমার যৌবনের প্রত্যূষ থেকে প্রৌঢ়ত্বের ঊষাকালে
সাক্ষী, আশ্রয়দাতা এবং সখা
আশেক লেনের সেই ক্ষয়াটে, থুত্থুরে বাড়ির উদ্দেশে।
এই আমার সাধনা
আজকাল ঘরেই বেশি থাকি; নিঃসঙ্গতার
শুড় যখন আমার গা বুলোয় মনোনীতার
স্পর্শের মতো,
দারুণ উপভোগ করি, দু’চোখ বুজে আসে।
কখনো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই,
বুক শেল্ফ থেকে তুলে নিই না-পড়া
কোনো বই, পাতা ওল্টাই, চোখ বুলোই, চাখি
একটি কি দু’টি পাতা; কখনো রেলিং-এ বসা প্রজাপতিকে
দেখি, চোখ জুড়োয় কখনো
শিল্পপল্লীর খয়েরি দালানের কার্ণিশে
ঠাঁই নেওয়া পায়রা যুগলের প্রণয় দৃশ্যটিকে
ধরে রাখি স্মৃতিতে। মনে পড়ে, টেলিফোনের
তারে ভেসে আসা কারো মধুর কণ্ঠস্বর, চকিতে
নতুন পড়া কোনো কবিতা
আমার ইন্দ্রিয়সমূহকে সম্মোহিত করে এবং
এর চেয়ে তৃপ্তিকর আর কী-ইবা হতে পারে?
এই ছায়াচ্ছন্ন নিঃসঙ্গতা আমার প্রয়োজন,
অথচ বাইরের রৌদ্রের চুম্বন, হঠাৎ
বৃষ্টির ছাঁট, বই মেলার সায়াহ্ন ছোঁয়া শব্দের
স্পন্দন আর কবিদের আড্ডা ছাড়াও
আমার চলে না। আকাশের নিঃসীম
শূন্যতার পাশাপাশি নক্ষত্রের মহফিল এবং
অপ্সরার ভুরুর মতো চাঁদ
আমার বড় দরকার। কেবল কোকিল দোয়েল
হলেই আমার সাধ মেটে না; শালিক, চড়ুই,
ফিঙে, ডাহুক, এমনকি কাদাখোঁচা আর দাঁড়কাকও চাই।
গোলাপ যে দেয় তার কাছ থেকে কখনো
সখনো গাঁদা কিংবা বনফুলও পেতে ইচ্ছে করে
এই সাত কাহন শুনে
তোমরা আমাকে কী আখ্যা দেবে, জানি না;
এই যে খাতার পাতায় জখমি সৈনিকের মতো
অসহায় ছড়ানো টুকরো টুকরো
কিছুউ স্তবক, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ রূপবান
না হওয়া অব্দি শান্তি নেই আমার।
ভগ্নাংশ নিয়ে আমার তৃপ্তি নেই,
পূর্ণতাই কাম্য এই অভাজনের।
অসুখ বিসুখ নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া-আসা চলবে
মাঝে-মাঝে, দীর্ঘ জীবন পেলে শোকের সঙ্গে
মুখ দেখাদেখি হবে অনেকবার। পথ
যত পাথরকীর্ণ আর কন্টকসংকুলই কোহ
আনন্দ সরোবরে বারবার সাঁতার কেটে বেঁচে থাকার
আজাঙ্ক্ষা জীইয়ে রাখব, এই আমার সাধনা।