সমস্বরে বলছে
জ্যৈষ্ঠের দুপুর সোনার কলস উপুড় করে
চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে সুবর্ণ ধারা; দুপুরটা
নিজেই সোনার চকচকে পাত হয়ে কাঁপছে।
উপরন্তু তার সোনালি ঝাঁকড়া চুল
হাওয়ায় উড়ছে উদ্দাম, চরাচরে আগুন
ধরাতে চায় এই পোষ-না-মানা জ্যৈষ্ঠের দুপুর;
দুপুরে চোখ ও বুক ফেটে বেরুচ্ছে অজস্র স্ফুলিঙ্গ
আর সবাই কেমন কুড়াতে চায় স্ফুলিঙ্গের ফুল।
দিগন্তের হৃদয় ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে
ভয়স্কর সুন্দর এক ঝড়;
ঝড়ের ঝাপ্টায় থরথর কম্পিত
অচলায়তন। ঘূর্ণিঝড় অচলায়তনের রক্ষীদের
ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে, অপরূপ সেই ঝঞ্ঝার
ধাক্কায় খসে যায় অচলায়তনের
অন্দরমহলের কিছু পলস্তারা, অন্ধকারের
‘গেল, গেল’ রব ক্রমশ হিংস্র হ’য়ে ওঠে।
কারার লৌহকপাট, কালো স্থুল শেকল ভাঙার গানে
হঠাৎ ঝনঝনিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।
হার্মোনিয়াম নেই, ঢোল নেই, মৃদঙ্গ নেই,
নেই বাঁশি, তবু বন্দিশালার তালা-ভাঙানো
ভিত-কাঁপানো আগুন রঙের গান হৃদয়-কুসুম হয়ে
ফুটতে শুরু করে মানবমেলায়।
একটি গুলজার খানকা শরীফে এখন পাথুরে মূর্তির মতো
একজন বসে আছেন; তাঁর গলায় মালায় স্তূপ,
পায়ের তলায় এন্তার আগরবাতি আর লোবান,
বেশুমার ভক্ত পদচুম্বনরত কী খরায় কী বর্ষায়।
তাপ-ওগরানো জ্যৈষ্ঠের দুপুর, অচলায়তন-ধ্বসানো ঝড়,
জনগণ মাতানো ভাঙার গান,
খানকা শরীফের পাথুরে মূর্তি সমস্বরে বলছে-
বস্তুত এই আমিই কাজী নজরুল ইসলাম।
সৈয়দ হকের উদ্দেশে
বন্ধু, আমাদের যাত্রা ছিল নাকি নম্র আর বিনীত?
দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার রসদ ছিল কি ছিল না, ভেবে দেখিনি
একবারও; রক্তের ভেতরে কী এক ময়ূর
পেখম মেলেছিল, নূপুরের ধ্বনি তুমুল বেজেছিল
চিদাকাশে, রং বেরঙের পাখি আমাদের যৌবনকে
অপার স্নেহে দিয়েছিল সুরের ছায়া এবং
চৌদিকে নেমে-আসা ধোঁয়াশাতেও
আমাদের দৃষ্টি ছিল সর্বদা সমুখে নিবদ্ধ।
ধর্মীয় উন্মাদনার ঢাকের প্রবল আওয়াজ কখনো
আমাদের টানেনি, সাম্প্রদায়িকতার
দন্ত-নখর ভাঙার শপথ আমরা নিয়েছিলাম
যাত্রালগ্নেই, জঙ্গি পুরুত আর মোল্লাদের হিংস্র চিৎকার
আর প্রাণ সংহারের হুমকি উপেক্ষা করে
আমরা ভালোবাসেছি লালন ফকির এবং রবীন্দ্রনাথের গান।
আমাদের জীবন থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে
রাঙা রোদ; অতিক্রান্ত যৌবনের দিকে আজ তাকাই
মাঝে-মধ্যে, যেমন পিতা দৃষ্টি দেন পুত্রের প্রতি।
বন্ধু, আমার মনে পড়ছে সেই সদ্য যুবক তোমাকে, যে-তুমি
বিউটি বোর্ডিং-এর এক কোণে একটি টেবিলে বসে লিখতে
গল্প, উপন্যাস আর কখনো সখনো কবিতা।
সেখান থেকে তোমার লেখার খাতা গুটিয়ে নিয়ে
সবার অগোচরে কখন যে তুমি কাসবা, লাসানি, বেক্স, মিরান্ডা
ছেড়ে প্রবেশ করলে তোমার গুলশানের নিজস্ব স্টাডিতে
মনেই পড়ছে না। এখন তুমি স্থুলোদর ঝর্ণাকলম
কিংবা বলপেন ব্যবহার করো না, শুনি; পড়েছিও
তোমার কোনো কোনো লেখায়। এখন তোমার
সৃজনশীল আঙুলগুলো
কম্পিউটারে ক্রীড়াশীল, তোমার মেধা আর
সেই যন্ত্রের যুগলবন্দিতে রচিত হচ্ছে গল্পের বর্ণনা,
কাব্যনাট্যের সংলাপ আর কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
বন্ধু, এই যে আজ তুমি অজস্র পুষ্পসম্ভারের মাঝখানে বসে
নিজেকে ভাবছ এক সব্যসাচী, তুমি জানো
এ তোমার মেধা, শ্রম ও নিষ্ঠারই উপহার। তোমার
বহুমুখী প্রস্রবণে স্নাত আমরা মুগ্ধাবেশে
চেয়ে আছি তোমার সাফল্যের স্বর্ণচূড়ার দিকে এবং
ভাবছি, আমাদের যাত্রা ছিল নম্র আর বিনীত।
কাঁটাতারের বেড়া ছিল, নানা চোরাবালি,
কিন্তু আমাদের চোখে ছিল দুর্মর
স্বপ্নের স্ফুটনোম্মুখ কুঁড়ি, আমাদের সর্বক্ষণ
পথ দেখিয়েছে মানবিক বোধের
রাহবার জ্যোতি; আমাদের পায়ে যত বেড়িই পরানো
হোক না কেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল স্থির
আর কালপুরুষকে এই ভূখণ্ডে নামিয়ে আনার
কেশর-স্ফীত স্পর্ধা ছিল আমাদেরই।
হেমন্ত সন্ধ্যায়
মেহন্ত হলুদ পিঠ খানিকটা চুল্কে নিয়ে উদাস হয়েছে
পড়ে না চোখের পাতা, কৃষকেরা শস্য কেটে ক্ষেত
নগ্ন করে ফিরে গেছে ঘরে; কিছুক্ষণ পরে
কুয়াশার বোরখায় ঢেকে যাবে সন্ধ্যায় শরীর।
কী করবো সন্ধ্যায় আজ? বসে থাকি একা, মাঝে-মাঝে
বাইরে তাকাই; নার্সারির
চারাগাছগুলো স্তব্ধ, আকাশে অস্পষ্ট চাঁদটিকে
চোখ টেপে নক্ষত্রের যৌথ প্রক্রিয়ায়।
আপন চেয়ারে বসে ঘন ঘন চুল টানি, ছিঁড়ি
শূন্যের কুসুম কত, কষ্ট পেতে থাকি
ক্ষণে ক্ষণে তার কথা ভেবে।
কোন্ সে সাঁকোর নিজে দাঁড়ানো আমার বিয়াত্রিচে?
মিলান ভেনিস কিংবা ফ্লোরেন্সেও নয়, এই শহরেই আজ
নিভৃতে করেন বাস আমার আপন বিয়াত্রিচে;
সময়ের রেণু সমুদয় উড়ে উড়ে তাকে ছোঁয়
আর তার আঙুলের ডগায় সোনালি মৌমাছির ধ্বনি জাগে।
হেমন্তে হরিদ্রাভ পিঠের ক্ষতটি
বলে, ‘কবি, আমাকে করাও স্নান, করো নিরাময়’
যে আমাকে ভালোবাসে তাকেই কাঁদিয়ে
বারবার, পুড়িয়ে নিজের চোখ অশ্রুহীন আমি;
কীভাবে সারাবো ক্ষত? কী করে ঝরাবো
অব্যর্থ শিশির আর্ত হেমন্তের পীড়িত শরীরে?