যে আমাকে লেখায়
সাত বাজার ঘুরে ভরদুপুরে এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে
ঘরে ফিরে এসে ঢক পানি খেয়ে
জুতো না খুলেই সটান শুয়ে পড়লাম
বিছানায়। আমার ওপর বইতে থাকে স্বস্তির নদী।
কয়েকটি টুকরো সংলাপ, কিছু বচসা,
কিছু দ্রব্যের বাহারী চেহারা
আমার মগজে ঘুরঘুর করছিল এবং
বুক শেল্ফের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম
কোন্ কোন্ বই এখনো
পড়া হয়নি। কে জানে কখনো পড়া হবে কিনা।
বারবার টেলিফোন সেটে সতৃষ্ণ দৃষ্টি দিই;
কতদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি,
এই সরল সত্য আমাকে শাসন করে কিছুক্ষণ।
একটি কি দু’টি কবিতা লিখলেই, বই পড়লে
কিংবা গান
শুনলেই কি একজনকে দেখতে না পাওয়ার বেদনা
আড়াল করা যায়?
বাজে কাগজের ঝুড়িতে নজর পড়ে হঠাৎ
সেখানে কি খুঁজে পাবো না-লেখা
কবিতার উপাদান? ক্লান্ত আমি ভাবছি, শুধু ভাবছি।
তার সঙ্গে দেখা হবে কি আজ, যে আমাকে লেখায়?
লানতের পঙ্ক্তিমালা
আজ রাতে নাগরিক নিসর্গ বিষয়ে একটি কবিতা
লেখার কথা ভাবছিলাম,
আমার কলম শাদা কাগজের বুকে অক্ষর সাজানোর
অতিপ্রায়ে উন্মুখ, ঠিক তখনই আমার গলির গাছপালা,
ফুলের বাগান, নিশীথ-জড়ানো আসমানের
রহস্যময় সৌন্দর্য লেখনীর গতি রুদ্ধ করে বলল-
‘আজ আমরা তোমাকে আমাদের কথা
লিখতে দেবো না। কবি, আজ তুমি লেখো তোমার
প্রিয়তম জন্মশহরের সেই ছাত্রাবাসের কথা, যেখানে
সশস্ত্র পুলিশের বুটের আঘাতে নিরীহ, নিরস্ত্র ছাত্রদের
ভাতের থালা শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে
মুখ থুবড়ে পড়েছে মাটিতে,
যেখানে মেধাবী শিষ্টাচারপরায়ণ
শিক্ষার্থীর হাত-পা ভেঙে বন্দুকের বাঁট দিয়ে
বর্জ্যের মতো ছুঁড়ে ফেলেছে থানায়,
যেখানে ছাত্রদের কাঁটাতারে বেঁধে পিটিয়ে
আধমরা করে ফেলা হয়েছে,
যে-শিক্ষার্থী ঘুমের ভেতর সুখস্বপ্ন দেখছিল,
সে ভীতসন্ত্রস্ত জেগে উঠল হায়েনার হামলায়
ঘোর দুঃস্বপ্নে, সে বুঝতেই পারল না,
কেন তাকে সইতে হচ্ছে কসাইখানার নিপীড়ন।
আজ রাতে একটি প্রেমের কবিতা লিখব বলে
মনস্থির করলাম। গৌরীর মুখ আমার চোখে ভেসে উঠল।
তার উদ্দেশে কবিতা রচনার জন্যে কলম ধরতেই,
গৌরী, যে এখন এই শহরে নেই, আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
হাত থেকে বলপেন প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলল-
‘আজ আমার উদ্দেশে কোনো কবিতা
লেখার প্রয়োজন নেই।
কবি, বরং আজ তুমি লেখো সেই মায়ের
অশ্রুধারার কথা, যার ছেলের পাঁজর গুঁড়িয়ে গ্যাছে
অত্যাচারী বুটের আঘাতে, তুমি লেখো সেই
বিধবার কথা, যার বুক আজ শস্য-কাটা ক্ষেতের মতো,
যার স্বামীকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসের কর্কশ হাত।
গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সুপ্রিয়া গৌরী বলল-
‘কবি, তুমি আজ তোমার কলম থেকে নিঃসৃত হ’তে দাও
লানতের পঙ্ক্তিমালা
লানত দাও তাদের, যারা তোমার প্রিয়তম শহরকে
একাত্তরের ধরনে বন্দশিবির বানিয়ে
প্রেতনৃত্যে মেতে উঠতে চায়।
লানত দাও তাদের, যারা গণতন্ত্রকে সঙ সাজিয়ে
শহরে ও গ্রামে ভড়ং দেখাচ্ছে সং বিধান রক্ষার,
কবি, তুমি লানত দাও তাদের, যাদের হাত থেকে ঝরছে রক্ত,
যাদের হাতে লাশের গন্ধ,
লানত দাও তাদের যারা ‘মালাউন’ গাল পেড়ে মুক্তিযুদ্ধের
রণধ্বনি এবং জয়ধ্বনি জয়বাংলা ছাত্রদের পায়ুপথে
ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছি বীভৎস উল্লাসে,
লানত দাও তাদের, যাদের কপালে মহাকাল
ফ্যাসিবাদের সীলমোহর এঁকে দিয়েছে;
কবি, তোমার কলম থেকে আজ ফুল-চন্দন নয়,
এই ঘোর অমাবস্যায় ঝরুক
জালিমদের কেল্লা-পোড়ানো স্ফুলিঙ্গ।
লোকটা ভাবে
সবাই ঘুমিয়ে আছে সে সাধের
বিছানায় শেষ রাতে। এখন লোকটা ভাবে বসে-
কাগজ কলম কালি নিয়ে
কাটিয়ে দিয়েছি কতকাল। শত শত
পাতা সাজিয়েছি দিনরাত অনুরাগে,
কখনো কখনো
একটি শব্দের জন্যে উড়িয়ে ধৈর্যের পাল বসে
রয়েছি বিমর্ষ পাটাতনে। শব্দগুলি উঁকিঝুঁকি
দিয়ে দ্রুত শূন্যে লুটোপুটি খেয়ে ছুটে
পালিয়েছে কৌতুকের ঠাটে।
এখন লোকটা ভাবে বাইরে তাকিয়ে-
দূরের আকাশ আর কাছের প্রান্তর, স্তব্ধ নিশুত রাতের
পথঘাট, বসন্তের অস্থির কোকিল, হেমন্তের
নির্ভেজাল শিশির, বাঁশের ঝাড় রেখেছি খাতার
পাতায় কত যে তার হিশেব কে রাখে? আর গৌরী
বারবার সহজেই দাঁড়িয়েছি, বসেছে, রয়েছে
শুয়ে নম্র গোধূলি বেলায়
কলমের নিবিড় ছোঁয়ায়
এখানে কাগজ জুড়ে। কখনো অনেক মানুষের
কলরব রাজপথসহ কী প্রবল ঢুকে পড়ে
খাতার নির্জনতায়। একটি তারা কি খসে গেল
পতনের ঝোঁকে? এমনও তো হয়েছে কখনো
পরি উড়ে এসে খুব নিরালা জ্যোৎস্নায়
অক্ষরের রূপ নিয়ে বেড়িয়েছে সফেদ পাতায়।
রাত্তিরে লোকটা ভাবে টেবিলে বিশ্রান্ত মাথা রেখে-
এই যে অক্ষর সারি সারি
ছড়ানো গড়ানো ডানে বামে,
এ নিয়ে পারি না আর, বমন উদ্রেক করে শুধু।
পরদিন ভোরবেলা লোকটা আবার
কাগজ কলম হাতে অক্ষরের প্রতিমা বানায়।
শুরুতেই বাগানটা
শুরুতেই বাগানটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন;
বড় বেশি উপেক্ষিত ছিল
এতকাল, চতুর্দিক আগাছায় ভরে
আছে, ফুল ঢাকা পড়ে গ্যাছে কাঁটাবনে
আর পশুদের
বিষ্ঠায় দুর্গন্ধময় মাটি। পাখিরা ভুলেও
আসেনি এখানে আর এলেও কখনো গলা খুলে
গায়নি মধুর গান; সন্ত্রাসের ভয়ে
পালিয়েছে দূরে,
খুঁজেছে আশ্রয় মেঘে নীলিমার মৈত্রীর আশায়।
কোদাল, খুরপির ঘায়ে আগাছা উপড়ে ফেলে দিলে
বাগানের মুখশ্রী আসবে ফিরে, নানা
পুষ্প বিকাশের সুরে দুলে
উঠবে আবার, কাঠবিড়ালিরা রোদ
পান করে বুঁদ হয়ে গাছের ছায়ায়
খুঁজবে রূপালির স্বপ্নে ইতস্তত সোনালি বাদাম। ময়ূরের
নাচ দেখে মেঘ
নিমেষে হাসিতে ভেসে পৌঁছে
যাবে দিগন্তের ঘাটে। নিঃসঙ্গ তরুণ
বাঁশের বাঁশির সুরে গোধূলিতে রঙ
ছিটিয়ে চৌদিকে ক্লান্ত হাতে
মাথা রেখে ডুবে যাবে নিদ্রার পাতালে।
ঝকঝকে বাগানের গাছের পাতারা
আনন্দমেলায় সমবেত
শিশুদের মতো দ্যাখো কেমন উচ্ছল। কোটি কোটি
হাত বাগানকে আরো সুন্দর রাখার
বাসনায় আগাছা নিড়ায়, জল ঢালে
শত চারাগাছের গোড়ায়,
ছেঁটে ফেলে নিষ্প্রভ অসুস্থ পাতাদের, সূর্যোদয়ে
সোৎসাহে রচনা করে মাইল মাইলব্যাপী বৃক্ষরাজি আর
ঘন সবুজের আর ফুল পাখিদের,
সর্বমানবের প্রীতি, মেধা আর মননের গাথা।
কোটি কোটি চোখ
নতুনের স্বপ্নে খুব ডাগর উৎসব। আগামীর
নামে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়ুক বাগানে,
কোকিল করুক আজ বসন্তের বিশদ আবাদ।