- বইয়ের নামঃ হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অকাল বসন্ত
বেশ কিছুদিন ধরে আছি রোগশয্যায়
যদি বলি, অস্থিমজ্জায় অজস্র ইঁদুর দাঁত বসিয়ে
ক্রমাগত খসিয়ে নিচ্ছে সারবস্তু, মিথ্যা বলা হবে না।
ঘড়ির কড়া শাসন মেনে ওষুধ খাওয়া,
মাঝে মধ্যে ডাক্তারের কাছে যাওয়া চেক-আপের জন্যে।
অন্য কোথাও ধীরে সুস্থে অথবা হন্যে হয়ে
যাতায়াত করা বারণ, কারণ, নাজুক ফুসফুসের
পক্ষে গেরিলা বীজাণুর চোরাগোপ্তা হামলা
সামলানো কঠিন। দু’বেলা ভেন্টোলিন
ইনহেলার দিয়ে শ্বাসটুকু বজায় রাখা এভাবেই
থাকা না থাকার নাগরদোলায় ভুলছন্দে হায়রে ওঠানামা,
গায়ের জামায় নিজের নাকেই লাগে রোগের চিম্সে গন্ধ।
টেবিলে তার পাঠানো ক্যামেলিয়া সগৌরবে
বিরাজ করে, ছড়ায় সৌরভ। বিছানায় শুয়ে শুয়ে দেখি,
এ কী খাটের চৌদিকে গজিয়ে ওঠা নলখাগড়া
থকথকে কাদা, কয়েকটি তাগড়া কাদাখোঁচা, হাড়গিলা
ভাঙা ডাল, মরা পচা পাতার মধ্যে গলাফোলা
একটা কোলা ব্যাঙ আচানক ঠ্যাঙ তুলে লাফিয়ে
গা ঢাকা দেয় খাটের তলায়,
সেই বদ্ধ জলায় অমাবস্যার করাল ছাপ।
খাটের চারপাশের পঙ্কিল কাদা কর্কশ বনবাদাড়
গড়াতে গড়াতে আমার কবিতার খাতায়
চলে আসে,
সুন্দরীতমা নগ্ন হেরার সাঁতারের
ছিটকে-পড়া জলকণা সমুদয়
আর পরশ পাথর খুঁজি। যা অপ্রাপণীয়
অথচ সন্ধ্যানের যোগ্য তা-ই আমার পুঁজি।
কাদা লেপা কবিতার খাতায় ছন্নছাড়া শূন্যতার বিলাপ,
সেখানে নিষ্ফলা ঋতুর পুষ্পহীনতা,
হঠাৎ কোন্ ধূসর রাজ্য থেকে উড়ে এসে একটা কোকিল
ব্যাকুল সুরে কবিতার খাতায় ডেকে আনলো অকাল বসন্ত।
অনুবাদক
গোলাপ নিঃশব্দে এসে বলে যায় সৌন্দর্যের কথা
আপনার সুগন্ধের কথা,
মন দিয়ে শুনি;
পাখি তার উড়ালের কথা,
গানের সুরের কথা বলে যায় পাখা নেড়ে শুনি;
শিশির নিজের কথা কোমল গচ্ছিত রেখে যায়
আমার শ্রুতিতে। গৌরী তুমি
আমাকে নিয়ত বলো ভালোবাসা, জ্যোৎস্না,
রোদ্দুর, বৃষ্টির কথা।
মনোরকম বাচনভঙ্গিতে বলো তুমি
আমাদের বিজয়ের কথা, নির্যাতিত
মানুষের কথা, প্রগতির রথের অপ্রতিরোধ্য
দুর্বার চলার কথা; মানবিক অনুভূতিমালা
উচ্চারিত ক্ষণে ক্ষণে তোমার বিনম্র কণ্ঠস্বরে, শুনে যাই
সবচেয়ে বেশি আমি তোমার কথাই গৌরী রোজ
সানন্দে গ্রহণ করি নিজের খাতায়। কথাগুলো
রূপান্তরে প্রকাশিত আমার স্বাক্ষরে,
যদিও প্রকৃতপক্ষে আমি অনুবাদক ব্যতীত কিছু নই!
অমাবস্যাময়ী এক নারী
এখন বয়সের সেই সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছি,
যেখানে উষ্ণতার চেয়ে শৈত্যপ্রবাহ
প্রবল, যেখানে শরীরে যখন তখন আতশবাজি
ফোয়ারার মতো উচ্ছ্বসিত নয়, যদিও
সময়ের তিমিরাচ্ছন্ন গলিতে মুখ থুবড়ে পড়ার পরেও
প্রায়শ হৃদয় শবেবরাতের মোমবাতির উৎসব।
এখন আমি সেই নারীকে কামনা করি প্রতিক্ষণ,
যার যৌবন শারদ মধ্যাহ্ন থেকে হেমন্ত-গোধূলিতে
ঝুঁকে পড়তে কলেজের ছাত্রীর মতো উন্মুখ।
আমার কত সকাল আর দুপুর
স্পন্দিত তার কথার ষড়জে নিখাদে, কত সন্ধ্যা
হয়েছে দীপান্বিতা তার উপস্থিতিতে। তার কথাগুলো
আমি সতত পান করি, যেমন তৃষ্ণার্ত হরিণ
গোধূলির রঙ-লাগা ঝিলের জল।
মাঝে মধ্যে কে আমাকে নিক্ষেপ করে সিয়াহ গহ্বরে,
যেখানে মানুষ আর পশুর হাড়গোড়
বেকুর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে বিকৃত অন্ধত্বে? কে আমার
ওপর বিছিয়ে দেয় নিষ্ঠুর অনুপস্থিতির
ধূসর চাদর? কে আমাকে লকলকে শীতল জিহ্বায়
চাটতে থাকে প্রহরের পর প্রহর? কী করে সেই
গহ্বর থেকে পরিত্রাণ পাবো ভেবে পাই না। আমার
চৌদিকে ঝুলে থাকে নীরবতার মৌমাছি পুঞ্জ।
যার টলটলে অনন্তের ছোঁয়া-লাগা চোখ,
কখনো আনন্দে, কখনো বা বিষাদে
আল্পুত যার সৌন্দর্য, মাঝে-মধ্যে তার তার সঙ্গে দিনের পর দিন
দেখা-না হওয়ার করাত
আমাকে টুকরো টুকরো করে, আমার হৃৎপিণ্ডের
রক্তক্ষরণে অশ্রুপাত করে দোয়েল আর নক্ষত্রেরা।
কোত্থেকে অমাবস্যাময়ী এক নারী
তীক্ষ্ণ উলঙ্গতাকে নাচিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে;
ওর হিংস্র দু’টি বেড়াল-চোখ
আর দীর্ঘ ধারালো দশটি নোখ আমার
শরীর আঁচড়াতে থাকে। অসহ্য ব্যথায়
কাতরাতে কাতরাতে বলি, ‘কে তুমি?’ অন্ধকারকে
অধিক তমসাবৃত করে সে বলে, ‘আমাকে বেশ
ভালোই চেনার কথা তোমার। যারা জানে
ভালোবাসা কারে কয় তারা আমার
নাম রেখেছে বিরহ।
এই রমণীর কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে
সেই উল্লসিত সোনালি
নারীর উদ্দেশে হাত বাড়াই, যাকে
মিলন বলে শনাক্ত করতে শিখেছি কী স্বপ্নে, কী জাগরণে।
এখন তার না-থাকার কালো, লোনা পানির ঝাপ্টা
ঢুকে পড়ছে আমার হৃদয়ের ক্ষতে।
অশ্রুকণাগুলো
হঠাৎ তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল; বসেছিলে
ভোরছোঁয়া, ঘোরলাগা সোফায় নিভৃতে। সামান্যই
কথা হলো, চক্ষুমিলনের
সুঘ্রাণ ছড়ানো সারা ঘরে;
তোমার পায়ের কাছে নম্র খেলা করে
শীতের হলুদ আভা, তখন আমার
ভারি ইচ্ছে হলো শুয়ে পড়ি
সেখানে কার্পেটে। অকস্মাৎ কী যে হলো-
তোমার দু’চোখ থেকে বইল জলধারা;
অশ্রুকণাগুলো শব্দহীনতায় বলে, ‘তোমাকেই ভালোবাসি।
আদিবার জন্মদিনে
শৈশবে কত খরগোশ আর বেড়ালের ছানা
ছিল তো তোমার সাধের খেলা সাথী।
এখন কখনো গাঢ় সন্ধ্যায় ভালোবাসে তুমি
তাদের স্মরণে জ্বালো কি মোমের বাতি?
সেই যে সেদিন দুপুর, বেলায় হলদে পাখিটা
খাঁচার ভেতরে ঠাণ্ডা রইল মরে,
তার কথা আজ বান্ধবীদের সঙ্গে মেশার
সময় কখনো হঠাৎ মনে কি পড়ে?
দু’বছর আগে যেমনটি ছিলে দেখতে হে মেয়ে,
তুমি তো এখন নয়কো তেমন মোটে।
তোমার শরীরে সোনালি দুপুরে, রূপালি নিশীথে
ক্ষণে ক্ষণে মেয়ে মায়াময় শোভা লোটে।
ষোল বছরের দুয়ারে পা রেখে চম্কে তাকাও
কোলে শুয়ে থাকা কুকুর ছানার দিকে;
পাখিদের ধ্বনি শুনতে না পেলে তোমার সকাল
অথবা দুপুর মনে হয় বড় ফিকে।
তুমিই তোমাকে ডাকছ অদূরে দাঁড়িয়ে আভাসে
অপরূপ তীরে,-যৌবন যার নাম।
সেই স্বর্ণিল তটে হেসে খেলে বেড়াবে কী সুখে,
হাওয়ায় উড়বে ঘন কালো কেশদাম।
ঘুমের মধ্যে তোমার অধরে যখন হাসির
কুসুম নীরবে পেলব পাপড়ি মেলে,
তখন তোমার মায়ের স্নেহের টলটলে হ্রদে
জ্যোৎস্না জড়ানো কত ঢেউ যায় খেলে।
কোনো ধুলিঝড়ে তোমার সুখের রঙিন প্রবাহে
যেন কোনোদিন না পড়ে কখনো যতি,
বলি তুমি মেয়ে হও যে আয়ুষ্মতী।