নাম ধরে ডেকে যাবো
একবার বাগে পেলে আমাকে মাটিতে ফেলে যারা
আদিম হিংস্রতা নিয়ে খোঁচাবে বল্লমে, নিষ্ঠীবন
ছিটোবে বিস্তর মুখে এবং চুলের মুঠি ধরে
হিড় হিড় টেনে নিয়ে যাবে গোরস্তানে কিংবা হৈ হৈ
নাচবে আমাকে ঘিরে, কী অবাক কাণ্ড, তুমি আজ
তাদেরই শিবিরে মক্ষিরাণী হয়ে আছো সগৌরবে।
দৈবক্রমে দেখা হলো আমাদের বিপন্ন বেলায়,
সবকিছু জেনে শুনে একটি গোলাপ, হৃদয়ের
রক্তসেচে ফুটে-ওঠা, দিলাম তোমার করতলে
নির্দ্বিধায়। তুমিও আমার চোখে চোখ রেখে কী-যে
আবৃত্তি করলে হে মধুরতমা টীকাভাষ্যহীন,
ফুটলো অপূর্ব মুদ্রা অন্তরঙ্গ আঙ্গিকে নীরবে।
কথা বলি পরস্পর, মাঝে মাঝে নেপথ্যে ভ্রমণ
অবেলায়, হাতে তুলে নিই হাত, তোমার ঠোঁটের
কোমলতা পাইটের কখনো হঠাৎ আলগোছে।
আমাদের কোথায় যে নিয়ে যাবে শেষ তক এই
চোরা টান; আপাতত বুঝি না কিছুই শুধু চেয়ে
থাকি সারাক্ষণ মুগ্ধাবেশে তোমার মুখের দিকে।
এরকম তাকিও না, বলে তুমি কপট শাসনে
জ্বলে ওঠো একরাশ নক্ষত্রের মতো, পরে ফের
আমার পাঁজর ঘেঁষে চলে এসে নিমেষে বুঝিয়ে
দাও কাকে বলে ভালোবাসা। তোমার ত্বকের মৃদু
উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায় কী মদির।
নীরবতা গান হয়ে ওঠে, অপরূপ উন্মীলন।
তুমিতো দুপুরে আছো, গোধূলিতে আমি। কখন যে
সত্তা চিরে বেজে ওঠে মরাল সঙ্গীত, জানা নেই।
আমরা দু’জন অসহায় চলেছি বিরূপ স্রোতে
ভেসে, তীর খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত চোখ, তবু আশা রাখি
অন্ধকার ঘনিয়ে এলেও হয়তো উদ্ধারের রূপে
উঠবে জেগে অকপটে দুর্নিবার তোমার পূর্ণিমা
এভাবে কি যাবে দিন চিরদিন? ভয়ে ভয়ে থাকি,
স্থানাভাবে পথে পথে ঘুরি চুপিসারে, মাঝে মাঝে
সব কিছু তাচ্ছিল্যের ফুঁয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে চলি
হাত ধরে এ শহরে। কখনো কখনো ভাবি, তুমি
আমাকে নিভিয়ে কোনোদিন হঠাৎ যাবে কি চলে
উজাড় বাগান ছেড়ে হে আমার সর্বশেষ ফুল?
যদি যাও, কেয়ামত হয়ে যাবে। পারমাণবিক
ভস্মস্তূপে নিমজ্জিত আমি চাইবো চিৎকারে সাড়া
জাগাতে, অথচ সেই আর্তনাদ শোনার মতন
কেউ বেঁচে থাকবে না আর। হাশরের ময়দানে
কেউ কারো ফরিয়াদ শুনতে চায় না, তবু জেনো
খুঁজবো তোমাকে, নাম ধরে ডেকে যাবো নিরন্তর।
নিভিয়ে এক ফুঁয়ে
আকাশ যেন আজ ঠান্ডা ভারী কাঁথা,
ময়লা ফুটো দিয়ে মারছে উঁকি তারা;
পায় না মনে ঠাঁই ঘরে ফেরার টান,
কলিংবেল দিলো ঝাঁকুনি সন্ধ্যাকে।
পাশের ঘরে এই কবিকে তাড়াতাড়ি
লুকিয়ে রেখে তুমি বিদায় চেয়ে নিলে।
তোমার ব্যবহারে কেমন মায়া ছিলো,
নিষ্ঠুরতা বলে তাকে পারিনি ধরে নিতে।
বুকের ঝাড়বাতি নিভিয়ে এক ফুয়ে
আমাকে ফেলে তুমি ক্ষিপ্র চলে গেলে।
আমার স্বপ্নের পাপড়ি সমুদয়
ছিড়েছো কুটি কুটি, হুতুশে তাই মন।
অথচ কিছু আগে দুজনে হাতে হাত
রেখেছি অনুরাগে, ওষ্ঠে নিয়ে ঠোঁট
ভুলেছি লহমায় জগৎ সংসার।
কার সে ঝট্কায় গিয়েছো দূরে সরে।
তখন কাছ থেকে বুকের ওঠা নামা,
ঠোঁটের নড়া আর চোখের ঝলকানি
দেখেছি তন্ময় এবং তোমাকেই
ব্যাকুল পান করে কেটেছে সারা বেলা।
আমাকে রেখে গেছো এ শীতে অসহায়,
একলা বসে দেখি অস্তাগামী চাঁদ,
আড়ালে শুনি মৃদু পাখির ডানা ঝাড়া।
হৃদয়ে ধূলিঝড় প্রহর গুণি শুধু।
কখন তুমি ফিরে আসবে জানি না তা।
কোথায় বসে আছো কেমন হুল্লোড়ে?
কথার হাইফেনে, বিদ্রূপের তোড়ে
পড়ে কি মনে তাকে, এসেছো ফেলে যাকে?
তোমার সত্তায় পূর্ণ অধিকার
প্রতিষ্ঠিত হায় হলো না প্রিয়তমা।
তোমার বরতনু আমার খর তাপে
মাখন হয়ে আজো গলেনি একবারও।
যখনই কাছে আসো, আলিঙ্গনে বাঁধো,
হঠাৎ জেগে ওঠে তীব্র কোলাহল।
নিষাদ তীর ছোঁড়ে আমার দিকে, তুমি
আমাকে বারবার আড়াল করে রাখো।
কিন্তু কতকাল থাকবে আবডাল?
আমি কি তস্কর অথবা আততায়ী?
নিজেকে মিছেমিছি অন্তরালে ঢাকি,
হৃদয় ঘায়ে ঘায়ে রক্তজবা হয়।
যখন পুনরায় আসবে তুমি আর
আমার চোখে মুখে নামবে নিরিবিলি
তোমার মসৃণ চুলের কালো ঢল,
বক্ষে নেবো টেনে, কখনো ছাড়বো না।
হন্তারক এই যুগের তমসায়
আমাকে একা ফেলে যেও না তুমি ফের;
না দাও যদি তুলে প্রেমের হাতে ফল,
ইহজীবনে আর ছোঁবো না তণ্ডুল।
মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায়
আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি ভিড়াক্রান্ত সদরঘাটের
টার্মিনাল ছেড়ে।
যখন দাঁড়াবে ডেকে, হাওয়ায় উড়বে
শ্যাম্পুকরা রেশম-মসৃণ চুল, তখন তোয়ার
মুখ কোন্ দিকে, কোন্ ভঙ্গিতে স্থাপিত,
জানবো না। সৌন্দর্যখচিত সেই মুখ
তখন কি আমার সত্তার উল্টোদিকে
ফেরানো বিষণ্নতায় ছাওয়া? নাকি আমার দিকেই
প্রসারিত চুম্বনের প্রতীক্ষায় থরথর? তুমি
কখনো উচ্ছল জলরাশি
দেখবে, কখনো আসমানে লেগে থাকা
চিতার স্তিমিত আগুনের মতো কিছু আবীরের
ছোপ; যদি আরো কিছুক্ষণ
সেখানে নজর রাখো, দেখবে পাখিরা
ডানায় আমার যন্ত্রণার ভস্ম মেখে উড়ে যাচ্ছে অতিশয়
দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ের লোভে, কে জানে কোথায়।
‘আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি’, এই
ছোট বাক্যে খৃষ্ট পূর্বকালের করুণ দীর্ঘশ্বাস, মরুচারী
কায়েসের দশদিক দীর্ণ-করা উদ্ভ্রান্ত, পবিত্র, ব্যক্তিগত
আর্তনাদ, ফরহাদ-রচিত অনিন্দ্য নহরের
উন্মথিত কান্না আছে আর
হঠাৎ শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের ঘ্রাণ, ঝরাপাতা
আর মৃত দোয়েলের পালকের ফিস্ফিসসে শিহরণ আছে,
তুমি কি জেনেছো? সন্ধ্যেবেলা
তোমার এ যাওয়া
যেন ঢাকা শহরের সব রূপ রস গন্ধ নিয়ে
চলে যাওয়া। কাল ভোর থেকে
কোনো রাগরাগিণী কলাপ মেলবে না,
এবং প্রেমিক-প্রেমিকারা
‘ভালোবাসা’ শব্দের বদলে বারংবার
‘ঘৃণা’ উচ্চারণ করে নিজেরাই বিস্ময়ের ঘোরে
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হবে। লুটেরা, ছিঁচকে চোর দেখে
পুলিশ চম্পট দেবে করতলে প্রাণ ভোমরাটা
রেখে, গেরস্তেরা দিনদুপুরেও ভয়ে
প্রকাশ্য রাস্তায় বেরুবে না,
রাস্ট্রাদূতগণ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক
চুক্তিপত্রে সই করা থেকে
নিয়ত বিরত থাকবেন!
পানি কেটে যাচ্ছে জলযান। হঠাৎ ফেনিল
ঢেউ এসে ঢুকে পড়ে ফ্ল্যাট বাড়িটার ছোট ঘরে,
ছিঁটে লাগে চোখে মুখে, কবিতার বই
টেবিলে শুইয়ে রেখে ভাবি সেই জলযানটির
কথা, যাকে দেখিনি কখনো, যে তোমাকে
নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে তোমার। সে মুহূর্তে মনে হলো
আমার এ মুখের ওপর
ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ কালো চুল। আজ রাতে কিছুতেই
ঘুম আসবে না; সারারাত
তোমার রেশমি চুল আঙুলে জড়িয়ে নিরিবিলি
খেলবো, কখন পূর্বদিক রাঙা হয়ে
উঠবে আবীরের ছোপে, যেমন ঈষৎ
লজ্জায় তোমার গাল। অলৌকিক পঞ্চ ডাল থেকে
যুঁই চামেলীর মতো ঝরে যাবে হৃদয়ে কবিতা,
তুমি আর কবিতা নিমেষে একাকার। ছিটিয়ে স্মৃতির পানি
জলযান যাচ্ছে চলে আমার হৃদয় ভেদ করে।
সূর্যোদয়ে আহত আলোর মৃত্যুচিহ্ন দেখে ফেলে
আমার আপন কবিতার খাতা মরাল সঙ্গীত
গেয়ে ডুবে যাবে
সুদূর মানস সরোবরে নাকি বিদ্রোহ বিদ্রোহ
বলে রুদ্র রোষে ফেটে পড়বে, চৌদিকে
ব্যাপক ছড়িয়ে দেবে মোহন আতশবাজি। তুমি
কেবিনে ঘুমুবে গুটিসুটি
অথবা নামবে ঘাটে, বহুদিনকার
বন্ধ জানালাটা খুলে দিয়ে গাছগাছালির স্তব্ধ শ্যামলিমা
মেখে নেবে চোখে, তখন কি মনে পড়বে তোমার
বেকার কবির কথা যে সংঘের ভেতরে থেকেও
চকিতে কেমন একা, ভীষণ একলা হয়ে যায়।
তুমি চলে যাবার পরেই শুরু হলো একটানা
টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি, যেন গাছের সবুজ পাতা, ছাদের কার্ণিশ
থেকে ঝরে অবিরল ব্যথিত রাজধানীর অশ্রুজল।
তুমি নেই বলে কিছুতেই শহরের
ক্রন্দন থামে না। গুলীবিদ্ধ চখার চৌদিকে চখী
চক্রাকারে উড়ে উড়ে কাঁদে যে ধরনে
অবিকল সে রকম আর্তনাদ করে এ শহর,
মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায়।
তুমি চলে যাবার পরেই
টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি, এ শহর
কেমন হতশ্রী হয়ে গ্যাছে, দেখে যাও একবার।
আসবে কদিন পরে? অপেক্ষায় আছি নিত্যদিন,
যেমন প্রকৃত
মোমিন থাকেন প্রতীক্ষায় ঈদের চাঁদের জন্যে রমজানে।
আমার নিকট থেকে কতদূরে চলে গ্যাছো শরীরে জড়িয়ে
আসমান। কতকাল কেটে গেল, তবু
আসোনি এখানে ফিরে স্যুটকেস হাতে,
কপালে খয়েরি টিপ, অনিদ্রার ছাপ
টাঙ্গাইল শাড়ীটির ভাঁজে। প্রেমের দেবতা বুঝি
ফৌত হয়ে গেছেন হঠাৎ
গুপ্ত ঘাতকের হাতে। নইলে কেন আজ
দিগঙ্গনা জুড়ে
দিয়েছে বিলাপ আর আমার প্রেমের
পদাবলী কেবলী আছড়ে পড়ে, মাথা কোটে শিলাতটে?