তোমার জন্মদিন
মোরগের গর্বিত ঝুঁটি, স্বপ্নে-দেখা
রক্তিম ফুলের উন্মীলন, অন্ধকার ঠেলে
ঘোষণা করে, আজ তোমার জন্মদিন।
আমার হৃদয়ের রোদের ঝলক
পবিত্র, ভাস্বর আয়াতের ছন্দে জানায়,
আজ তোমার জন্মদিন।
জানলার পাশে দাঁড়ানো
গাছের ডালে বসে-থাকা পাখির শিস
স্তব্ধতাকে চমকিয়ে শোনালো,
আজ তোমার জন্মদিন।
ঘরে হঠাৎ ঢুকে-পড়া ভ্রমর গুন্গুনিয়ে
বলে গেল আজ তার জন্মদিন,
যার চোখে চোখ রাখলে মনে হয়-
পৃথিবীতে নেমে এসেছে স্বর্গসিঁড়ি।
আজ নার্সের অ্যাপ্রনের মতো সারসের শরীর
আরো বেশি শাদা আজ উজ্জ্বল,
সূর্যের আবীর আরো বেশি রঙিন হয়ে
প্রতিবিম্বিত দিনের গালে, নদী আরো বেশি নদী;
আজ ফুলের স্তবকগুলো আনন্দের, রবীন্দ্রনাথের গান
অধিক রাবিন্দ্রিক এবং
আকাশের অধিক দূরের আকাশ।
আয়ুষ্মতী শব্দটি প্রকৃতির কণ্ঠে
উদারা মুদারায় বাজতে থাকে অষ্টপ্রহর।
তোমার জন্মদিন দেখছে, আমি সেই কবে থেকে
টেবিলে ঝুঁকে উদ্যমকে ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোয়
রূপান্তরিত করে একটি কবিতা লিখছি,
যার পর্বে পর্বে তোমার সুগন্ধি নিঃশ্বাস,
স্তনের ওঠা-নামা আর চুলের ছায়া।
আমার অসমাপ্ত কবিতাকে
দুরন্ত হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে
দূরের ফ্ল্যাটে গিয়ে চুপিসারে
গুঁজে দিতে চায় তোমার ব্লাউজের ভেতর।
তোমার জন্মদিন আমার চুলে
আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে সকালবেলা,
পায়ের কাছে জাগিয়ে তুলছে একটি ঝর্ণা।
আজ তোমার জন্মদিন। কী উপহার
কিনবো তোমার জন্যে? শাড়ি-টাড়ি? না কি
ফুলের তোড়া? অথচ এই সবকিছুই বড় মামুলি।
কী সেই উপহার, যার তুলনায় হীরের নেকলেসও
অতিশয় তুচ্ছ? হৃদয়,
যা আমি আগেই অর্পণ করেছি তোমাকে
কোনো এক দুপুরে অতীত বর্তমান মুছে-দেয়া বিহ্বলতায়।
তবু আর কিছু নয়, কেবল এই ধুক পুক করা
বুক নিয়ে দাঁড়াতে চাই
তোমার সামনে। আমাদের সম্পর্কের ওপর
ফুল ঝরুক, ঝরুক স্বর্গশিশির।
তোমার জন্মদিন সবার অগোচরে কী উন্মুখ
চুমো খাচ্ছে আমাকে তোমার মতোই।
দেখা যায় কিনা
কী যে হয়েছে তাঁর, ইদানীং কোনো কিছুই
তেমন স্পষ্ট দেখতে পান না, না হাতের কাছের
চায়ের পেয়ালা, না দূরের গাছপালা। অনেকটা
আন্দাজে ঠাওর করে নেন। হাসপাতালে যাই যাই
করেও যাওয়া হলো না আজ অব্দি।
রোয়াকে বসে থাকেন, যতক্ষণ না উড়ে যাওয়া ঝাঁক ঝাঁক
পাখির পাখায় লাগে সাঁঝবেলার
আগেকার আবীর সেই রঙ দেখে তাঁর মনে পড়ে
বাসর ঘর, একটা লাজরাঙা টুকটুকে মুখ,
উপ্টান আর মেহেদীর ঘ্রাণ।
তিন কূলে কেউ নেই তাঁর। অথচ একদা ছিল
অনেকেই। তিনি তিল কুড়িয়ে তাল
করতে গাধার খাটুনি খেটেও সংসারের চেহারা
তেমন পাল্টাতে পারেন নি। বরং হারিয়েছেন
গৃহিনীকে; বড় ছেলেটা বায়ান্নোয়
বাংলা হরফের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে নিজে বাঁচে নি।
মেজো ছেলে উণসত্তরে রাজপথে
জনতরঙ্গের সঙ্গে হলো একাকার। ছেলের লাশ
ফেরত পান নি পিতা। বাকী তিন ছেলের দিকে
তাকিয়ে টেনে ধরেন শোকের লাগাম।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ঘরের মায়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো তাঁর
দুই ছেলে। বিজয় ছিনিয়ে অনেকেই আপন ঘরে
এল ফিরে, কিন্তু তার দুই ছেলে
কখনো ফিরে আসে নি। তাঁর শুকনো চোখে
পাথরের আদল,
তিনি এখন প্রায় টেরাকোটার মূর্তি!
মেজাজে তিনি হরতালী নন, তবে মনেপ্রাণে চান
যারা হরতাল করে তাদের ঘরে যেন জ্বলে আনন্দের বাতি।
সাতাশিতে তাঁর বয়স দাঁড়ালো দুই কম চার কুড়ি।
কনিষ্ঠ ছেলেটাকে আগলে রাখেন
সারাক্ষণ, রাখেন চোখে চোখে। জানেন, গণআন্দোলনের
আওয়াজ কী দুর্বার আকর্ষণ করে
তাঁর পুত্রদের, যেমন সাতসমুদ্র তের নদীর ঢেউ
নাবিককে। থাকুক, অন্তত কনিষ্ঠ পুত্র তাঁর থাকুক,
মনে মনে জপেন তিনি। কিন্তু ঘর আর পিতার বুক
অন্ধকার করে চৌদিক ঝলসে-দেয়া প্রায়-অপার্থিব
আলোর সংকেতে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র
ছুটে যায় মিছিলে। ফিরে এসে জনকের বুক
শবেবরাতে দীপাবলী দিয়ে সাজায় না।
এবার তিনি আদিম মানুষের মতো
ডুকরে ওঠেন। তাঁর সত্তা-চেরা আর্তনাদে
বাংলাদেশের নিসর্গ নিঃঝুম কান্নায় কম্পমান।
অস্তিত্বের সমস্ত কান্না সেচে ফেলে
তিনি বসে থাকেন রোয়াকে, এখন তিনি ডাঙায়
তুলে-রাখা নৌকো। তাঁর চোখ থেকে
রোশনি ক্রমাগত বিদায় নিচ্ছে, তবু কপালে হাত ঠেকিয়ে
দেখতে চাইছেন তাঁর তেজী ছেলেরা
যে সমাজবদলের কথা বলতো দীপ্র কণ্ঠস্বরে
তার চিহ্ন আজ খুব আব্ছা হলেও
কোথাও দেখা যায় কিনা।
দ্রুত মুছে দেবো
সদ্য সন্ধ্যা সাঁঝের সজ্জা ছেড়ে
শরীরে জড়ালো রাতের রেশমি শাড়ি।
এক লহমায় আমাকে অবাক করে
অপরূপ শোভা পেয়ে যায় ফ্ল্যাটবাড়ি।
কলিংবেলের ডাকে সাড়া দিয়ে দেখি,
দাঁড়িয়ে রয়েছো দরজার পাশে একা।
ভুলেও ভাবিনি হবে আচানক রাতে
আজকেই ফের তোমার সঙ্গে দেখা।
খোদার রহম, প্রসন্ন ভাগ্যতারা,
কোথায় বসাবো কিছুতে পাই না ভেবে।
এদিক ওদিক চেয়ে থাকি অসহায়,
জানি ক্রটি হলে তুমি ক্ষমা করে দেবে।
বাসন্তী রঙ তোমার শরীর জুড়ে
মেতেছে দৃষ্টি-জুড়ানো খেলায় আজ।
হৃদয়ে আমার সাত সাগরের দোলা,
কী ফুল ফোটায় সত্তায় ঋতুরাজ।
ইলেকট্রিকের আলোয় কর্ণমূলে
লাজুক হাসিতে কাঁপলো স্বর্ণদুল।
আমি নিশ্চুপ; তুমিও অথৈবচ;
কানে ফুটে আছে স্বর্গীয় দু’টি ফুল।
চলেছি দু’জন রিকশায় শিশুরাতে,
সামনে ছড়ানো তোমার ফেরার পথ।
হঠাৎ কোথায় উধাও একটু দুল?
বল্লে, ‘চুমোর অপূর্ব খেসারত।
আমাকে খোঁচায় অস্বস্তির কাঁটা,
নিজেকে কেবলি মনে হয় অপরাধী।
খুঁজে পেলে দুল নিজেরই শাড়ির ভাঁজে,
আমি মনে মনে স্বস্তির সুর সাধি।
‘কী সুখ পাচ্ছো আমাকে মথিত করে?
কী হবে এমন যাত্রার পরিণতি?
আখেরে কীভাবে চিহ্নিত হবো আমি?
তোমার প্রশ্নে থামে প্রমোদের গতি!
কম্পাসহীন নাবিকের মতো ভাসি;
ঝড়ে ভেঙে গেলে সুদৃশ্য মাস্তুল,
স্রোতে হাবুডুবু খেয়ে বলবো না, ‘হায়,
আমাদের প্রেমে ছিল ভয়ানক ভুল।
বাসুকির মতো ফণা তুলে ঢেউগুলি
করুক আঘাত, পাবো না কখনো ভয়।
তোমার এ-হাত লগ্ন থাকলে হাতে
কোনো সংঘাতে মানবো না পরাজয়।
দুঃসময়ের কৃষ্ণপক্ষে আছি;
বিশ্বব্যাপ্ত ধ্বংসের ঝাঁপতালে-
যখন অনেকে আত্মবিনাশে মাতে,
আমরা দোহার সাজবো না কোনোকালে।
পৃথিবীর সব বৃক্ষ আজকে যদি
বজ্রদগ্ধ হয় হোক প্রিয়তমা,
আমরা ছড়িয়ে প্রেমের পুষ্পরেণু
দ্রুত মুছে দেবো অকল্যাণের অমা।