তাঁর পেছনে
নানা জনের নানা কথা,
কেউ কারো কথা শুনছে বলে
মনে হলো না। শুধু একটা কলরব
সারা ঘর জুড়ে। বহু কণ্ঠস্বরের
মধ্যে আমার গলার আওয়াজ
সাঁঝ বেলার আলোর মতো আবছা।
আমি থমকে দাঁড়ানো, জখমি, তেজী
ঘোড়ার মতো আন্দোলন বিষয়ে
কিছু বলতে চাইলাম। নামী দামী
নেতারা মুখে ঐক্যের বুলি নিয়ে
অনৈক্যের বহু মুণ্ডু-অলা ষাঁড়টিকে
ছেড়ে দিয়েছেন ময়দানে; এই সুযোগ যিনি
এদেশের হর্তা কর্তা বিধাতা,
তিনি গণতন্ত্রকে দিব্যি
ঘোল খাইয়ে ছাড়ছেন। নিজে
তিনি সাচ্চা ধার্মিক কিনা তা শুধু
আলেমুল গায়েবই বলতে পারেন,
তবে নিজের তখতটিকে সামলে সুমলে,
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমের তাগিদে
ধর্মের কল নাড়াতে চাইছেন
জোরেশোরে। কিন্তু তার কি জানা নেই
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে?
এসব কথা বলতে চাইছিলাম উচ্চকণ্ঠে,
কিন্তু আমার গলা থেকে কোনো আওয়াজ
বেরুচ্ছিল না। ক্লান্ত হয়ে জনশূন্য ঘরে
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেবিলে মাথা রেখে;
হতাশার কুয়াশা
আমাকে জড়িয়ে রেখেছে।
হঠাৎ চমকে উঠে দেখি, কে যেন
হাত রেখেছে আমার কাঁধে।
তাকে কখনো দেখেছি বলে
মনে হলো না, অথচ অনেক চেনা সেই মুখ।
তাঁর হাতে জ্বলজ্বলে একটি পতাকা,রক্তের মতো লাল!
জোরালো কণ্ঠে বললেন তিনি-,
তোমরা এভাবে অরণ্যে রোদন করবে,
একে অন্যের কুশ পুত্তলিকা পোড়াবে,
হতাশার আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণে
বুঁদ হয়ে থাকবে পরাজয়ের নেশায়,
এ জন্যেই কি রাজবন্দিরা বছরের পর বছর
জীবন ক্ষইয়ে দিচ্ছেন জেলে?
এ জন্যেই কি আমরা বুকের রক্ত দিয়ে
স্বদেশের ধুলোমাখা পা
ধুয়েছি বার বার?
এ জন্যেই কি সেজে গুজে নওশা হবার বয়সে
আমরা বরণ করেছি শাহাদত?
কেন তুমি এমন নীরব, নিঝুম হয়ে আছো?
আমার কণ্ঠস্বর কোথাও পৌছয় না,
আমি বললাম তাঁর চোখে চোখ রেখে।
‘এ নিয়ে ভাবনা করো না,
বজ্র বয়ে বেড়াবে তোমার কণ্ঠস্বর,
আর সেই আওয়াজ পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে।
কানে আসে তাঁর গমগমে উত্তর।
তারপর সেই শহীদ মাথা উঁচিয়ে
হাওয়ায় নিশান উড়িয়ে
জোর কদমে চললেন এগিয়ে।
আমি তাঁকে অনুসরণ করবো কি করবো না
ভাবছি এবং চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই দেখি
তাঁর পেছনে
গনগনে এক জনসমুদ্র।
তাদের কথা
বনেদি ঘরের কেউ নই, বলা যায়
অত্যন্ত অগণ্য আমি। গোলাপ, রজনীগন্ধা অথবা চামেলি
কারো সমতুল্য নই, থাকে না আমার প্রতীক্ষায়
কখনো ড্রইংরুমে কোনো ফুলদানি
পায়ের নিচেই থাকি সবার এবং
পিঁপড়ে, পোকামাকড়েরা মাঝে মাঝে
করে খুনসুটি।
যখন যুবক যুবতীরা,
যাদের সত্তায়, প্রেম রঙধনু হয়ে
জ্বলে, যারা ঘাসের ওপর বসে, কথা
ফুরুলে তাকায় এ আমার একরত্তি
অস্তিত্বের দিকে; বুঝতেই পারো সামান্য ঘাসের
ফুল ছাড়া অন্য কিছু নই।
অথচ তোমরা আমাকেও নিশ্চিহ্ন করার প্রায়
সব আয়োজন শেষ করে
এনেছো বস্তুত।
খুব হালকা উড়ে উড়ে রঙের বাহার আর খুশি
ছড়িয়ে বেড়াই সবখানে।
এ আমার খেলা; যদি বলো
বাঁচার আনন্দ, মেনে নেবো তর্কহীন।
আমাকে ধরার জন্যে খুকুমণিদের
দল আর কখনো কখনো
খেয়ালী বয়স্ক মজাদার কেউ কেউ
নাওয়া খাওয়া ছেড়ে
আমার পেছনে ছোটে। আমি যে রঙিন প্রজাপতি
এ কথা নিশ্চয়
না বললেও চলে; জানি, ঘর,
বারান্দা, বাগান, ঝোপঝাড় আর মাঠ থেকে দ্রুত
আমার সকল রঙ মুছে ফেলবার
সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে
ফেলেছো তোমার দেশ-দেশান্তরে ধীমান বন্ধুরা!
আমি কারো সাতে পাঁচে নেই, তর তর
গাছ বেয়ে উঠি,
নেমে আসি ঘাসে বার বার, কখনো বা দালানের
ছাদে যাই, রোদ শুকি, ছায়া পান করি আর এদিক ওদিক
চোখ রেখে ছোটাছুটি করার খেলায়
মেতে থাকি। যতদূর জানি,
একবার এক দীর্ঘকায় গৌরবর্ণ কবি আমার মাথাটা
চুলকিয়ে দেয়ার বাসনা
প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ছোট অসামান্য কবিতায়।
তোমরা আমাকে, এই কাঠবিড়ালিকে,
পৃথিবীর ঘ্রাণময় গাছের কোটর, রৌদ্রছায়া
থেকে মহরুম করবার বলিহারি
নেশায় মেতেছো।
এই যে আমাকে দ্যাখো, নদী
নালায় সাঁতার কাটি, সর্বদা চাঞ্চল্যে ভরপুর,
কখনো কখনো মাছরাঙা
ছোঁ মেরে, ওপরে তুলে নিয়ে পরিপাটি
ভোজ সেরে নিতে চায়। প্রায় প্রত্যহই
জেলে জাল ফেলে
জীবিকার টানে, তোলে যতক্ষণ পারা
যায়, আমরাও বেঁচে থাকবার সাধ
নিয়ে করি বসবাস জলজ পুরীতে। আমাদের
সহজে সবংশে ধ্বংস করবার জন্যে লেগে গ্যাছো
আদাজল খেয়ে; ভাবি, পাবে কি নিস্তার
পদ্মা আর মেঘনার, তিস্তার, মিসিসিপি, গঙ্গা,
হোয়াংহো ভলগার মৎস্যকুল?
ভোরবেলা আমার গানের সুরে ঘুম
ভাঙে তোমাদের,
আমার রঙিন পাখা থেকে ঝরে কত
স্বপ্নের মুকুল অবলীলাক্রমে, আমি
এবং আমার ঝাঁক ঝাঁক সঙ্গী মধুর সঙ্গীতে
ফাল্গুনকে ডেকে আনি, আশপাশ মুড়ে দিই, পুষ্পল সজ্জায়,
অথচ তোমরা আমাদের লুপ্ত করে
বিষাক্ত রাসায়নিক পদ্ধতির নিপুণ প্রয়োগে
বসন্তকে নিস্তব্ধ করার
নাছোড় চক্রান্তে নিয়োজিত।
(সকলে মিলে) ঘাসফুল, প্রজাপতি, মাছ,
পাখি কি কাঠবিড়ালি, যাকে ইচ্ছে বিলুপ্তির দিকে
ঠেলে দাও; কোনো খেদ নেই।
এ এক ভীষণ পরিহাস,
স্বয়ং তোমরা নিজেরাই নিজেদের
নির্মুল করার কী ব্যাপক খর প্রতিযোগিতায়
লিপ্ত ইদানীং।
তোমার চিঠির একটি বাক্য
আখেরে দক্ষিণ বাংলার সুদূর গ্রাম থেকে
এল সেই চিঠি, যার জন্যে প্রতিদিন
ডাকবাক্স খুলেছি দু’ বেলা
বালকের পাখির বাসা হাতড়ানো অধীরতায়।
চিঠিটা অনেক আগেই
পৌছুনোর কথা, অথচ এল
অনেকদিন পরে,
যেন সাত সমুদ্র তেরো নদী
পাড়ি দিয়ে এসেছে। চিঠিটাকে
লুকিয়ে চুমু খেলাম
বার বার, বলা যায়,
মহাসমারোহে।
সেই চিঠিতে তোমার কার্পণ্যের কাঁটাগুলো
আমাকে খোঁচালো অনেকক্ষণ।
আনন্দে লাফিয়ে উঠবো নাকি
ব্যথিত মুখে বসে থাকবো,
মনস্থির করা গেল না কিছুতেই।
আমার জখমি হৃদয় লাগাবার মতো মলম
কোথাও নেই ভেবে
নিশ্চুপ বসে থাকলাম।
তোমাকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয়,
লিখেছো তুমি।
কীসের ভয়? কেন ভয়? তার
কোনো উল্লেখ কিংবা ইঙ্গিত ছিল না কোথাও।
বাক্যটি নেড়ে চেড়ে দেখার সময়
দৃষ্টি পথে ঝিকিয়ে ওঠে আমার অতীত এবং বর্তমান।
মনে পড়লো আম্র মেহমান নেওয়াজ
মরহুম আব্বার কথা।
আমাকে তিনি তাঁর দরাজ সরাইখানার
একজন অতিথি
বলেই ভাবতেন।
আমাদের পুরানো বাসায় কখন আসি আর
কখনই বা বেরিয়ে যাই,
তিনি ঠাত্তর করতে পারতেন না
সহজে। আমাকে ঘিরে তাঁর
স্বপ্নগুলো ক্রমাগত গুঁড়িয়ে
যাচ্ছিল বলে আমাকে নিয়ে
ভারি ভয় ছিল আব্বার।
ছোটবেলায় আমি যখন ছটি ঘরে,
তখন আমার একটা মারাত্মক অসুখ
হয়েছিল; বাঁচার আশা ছিল না এতটুকু,
সেই তখন থেকেই
আমাকে নিয়ে আম্মা যে ভয়
পেয়েছিলেন, এখনো, এত বছর পরেও তা কাটেনি।
আমার গৃহিণীরও আমাকে নিয়ে বড় ভয়।
পাখিও বাসা বানায়,
অথচ আমাকে দিয়ে এখনো তা হয়নি।
যার মন এমন উডু উডু, যে চাকরির পোক্ত তরী
কুলে ভেড়ার আগেই স্বেচ্ছায় তড়িঘড়ি ডুবিয়ে দেয়,
তার বিষয়ে ভয় কখনো যায় না অস্তাচলে।
আমার যাঁরা শুভাথী, তাঁরা
আজকের আমার শরীর সম্পর্কে সারাক্ষণ
ভয়ে ভয়ে থাকেন,
পাছে হঠাৎ একদিন সটান
তাঁদের কাঁধে চড়ে
পৌঁছে যাই গোরস্তানে।
যেসব কবি ঈর্ষা করেন আমাকে,
তাঁদেরও ভারি ভয় আমাকে নিয়ে,
পাছে তাদের খ্যাতির টগবগে ঘোড়াকে
ডিঙিয়ে আমাকে উড়িয়ে
নিয়ে যান বহুদূরে যশের ফেরেশ্তা।
শক্রপক্ষ খামখাই আমার ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে
আমাকে ধরাশায়ী করার বড়াইয়ে ফেটে পড়েন।
এবং আমাকে নিয়ে স্বৈরাচারী সরকারেরও বড় ভয়।
কখন আমার কলম বেমক্কা উগরে দেয়
ওদের ভিতটলানো পংক্তিমালা,
ওরা তা নিয়ে ধন্দে থাকে দিনভর, রাতভর!