একটি মুক্তো
“একটি স্বপ্নের পথে হেঁটে গিয়েছি সমুদ্রতীরে”,
বলে তুমি দিয়েছিলে স্বপ্নটির নিখুঁত বর্ণনা।
কী যে নাম সমুদ্রের ছিল না তোমার জানা, শুধু
ঝাউবীথি, গোধূলি, ক’জন ভদ্রলোক ছিল চেনা।
একটি ঝিনুক তুমি দিলে বাড়িয়ে সবার হাতে
একে একে, হতশ্রী ঝিনুকটিকে ওরা দূরে ছুঁড়ে
ফেলে দিলো অবহেলে। সযত্নে কুড়িয়ে নিয়ে তার
বুক চিরে বের করি একটি অনিন্দ্য মুক্তো শেষে।
দিনান্তে আমার করতলে মুক্তো দেখে সকলেই
বড় বেশি ঈর্ষাতুর হয়ে নাল ঠুকে বাঁকা চোখে
তাকালো আমার দিকে, তুমি আস্তে সুস্থে হেঁটে
দাঁড়াল আমার বাম পাশে। কনে-দেখা আলো চুমো
খেলো আমাদের, অকস্মাৎ তুমি হলে স্বয়ম্বরা-
মেতে থাকে পরস্পর বিবাহের অধিক বিবাহে।
কাউকে দেখতে পেলাম না
মজুরের ঘামের ফোঁটার মতো সকালবেলার আলো
চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে আমার ঘরে। টেবিলে
আর কে, নারায়ণের আত্মকথা ‘আমার দিনগুলি’
যেটি গত রাতে পড়ে শেষ করেছি।
আমার কবিতা খাতা
একটি অসমাপ্ত কবিতা
বুকে ধারণ করে
প্রতীক্ষায় আছে আমার কলমের
আঁচড়ের। কবিতাটি লতিয়ে উঠেছে
তোমাকে ঘিরে। কি আশ্চর্য, আজকাল
আমার প্রায় প্রতিটি কবিতা জুড়ে
তোমারই আসা-যাওয়া।
মেঝেতে যমজ স্যান্ডেল অপেক্ষমাণ
আমার পায়ের জন্যে। জানলার লাগোয়া
নারকেল গাছে একটি কি দুটি পাখি,
মাঝে মাঝে গানে সাজায় প্রতিবেশ।
রাস্তার ওপারে হতে চলেছে একটি বাড়ির
ইট, বালি, কুপিয়ে-তোলা মাটি, লোহার শিকময়
উঠোনে কয়েকজন নারী পুরুষ, যারা
একটু পরেই পুরোদমে লেগে যাবে ইট ভাঙার কাজে।
তিনটি গাছ এখনো দাঁড়ানো সেখানে,
কে জানে কখন পড়বে মুখ থুবড়ে
বৃক্ষ ঘাতকের কুঠারের দাপটে।
কয়েকজন ছেলেমেয়ে ইউনিফর্ম পরে
রওয়ানা হয়েছে মর্নিং ইস্কুলে,
যেন ভাসমান এক বাহারি বাগান।
পাড়ার সেই মেয়েমানুষ, যার মাথায় ছিট,
গান গায়, ওর গানে নদীর ঢেউ, শূন্য নৌকা,
আর ধানের শীষের দুলুনি, কখনো কখনো
ওর সুরে সর্বস্ব-হারানো বিলাপ। গ্রীষ্মের সকালে
হাওয়া, হঠাৎ কিছু পাওয়ার খুশি চায়ের চুমুকে,
গত রাতের স্বপ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া। মনে পড়ে,
কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম, দাঁড়িয়ে আছি
সামন্ত যুগের গোধূলিকালীন এক রাজবাড়ির সিংদরজায়।
জানতাম তুমি আছো সেই বাড়ির রহস্যময়
কোনো প্রকোষ্ঠে। কণ্ঠস্বর যদ্দূর সম্ভব
উচ্চগ্রামে চড়িয়ে ডাকলাম তোমাকে,
তুমি এলে না। ভিক্ষুক এলেও তো মানুষ
একবার দরজা খুলে দ্যাখে।
স্বপ্নের ভেতরেই আমার ভীষণ মন খারাপ।
আমি কি পাগলা মেহের আলীর মতো
সেই আধভাঙা রাজবাড়ির
চারপাশে ক্রমাগত চক্কর কাটতে লাগলাম?
নাকি দীর্ঘশ্বাস হয়ে মিলিয়ে গেলাম নিশান্তের
হাওয়ায়?
সকালবেলা আমার ভারি ভালো লাগার কথা,
অথচ আমার মন আজ সীসার মতো ভারী।
এক ধরনের দার্শনিকতা আমাকে খামচে-খুমচে,
ঘাড় ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিধ্বনিময়
প্রকাণ্ড সব গুহায়। রাতের স্বপ্নটিকে
তুড়ি মেরে উড়িয়ে মনোভার কমাবার
চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।
ভাবনার হার ধরে অন্য মোড়ে
নিয়ে গেলাম ভুলিয়ে ভালিয়ে।
সেই মুহূর্তে নিজেকে ভাবতে দিলাম,
তুমি বসে আছো শুধু আমারই প্রতীক্ষায়,
কায়মনোবাক্যে আমারই কথা ভাবছো, একথা ভাবতেই
আমার সমগ্র সত্তা কদম ফুল,
ভাবতে ভালো লাগছে, তুমি আমার জন্যে
ফুঃ বলে তুচ্ছ করতে পারো যা কিছু কাঙ্ক্ষণীয়।
আর আনন্দে ডগমগ সারা ঘর।
এই বিভ্রান্ত যুগে তোমার অনুপস্থিতিকেই
উপস্থিতি বলে জেনেছি!
হঠাৎ একটা বিকট অট্রহাসিতে আমার ঘর থরথর,
যেমন ভূমিকম্পে হয়। কিন্তু সেই ঠা ঠা হাসিকে
অনুসরণ করে টাল সামলে
কাছে পিঠে কাউকে দেখতে পেলাম না।
কালেভদ্রে একটুখানি
কালেভদ্রে একটুখানি দেখার জন্যে
ঘুরে বেড়াই যত্রতত্র, দাঁড়িয়ে থাকি
পথের ধারে।
রোদের আঁচে গা পুড়ে যায়
যখন তখন,
জল-আঁচড়ে আত্মা থেকে রক্ত ঝরে;
দূর দিগন্ত আস্তেসুস্থে রক্ত চাটে।
স্কুটার থেকে নামো যখন
রোদ-ঠেকানো চশমা চোখে,
যখন তোমার শরীর জুড়ে
তাড়ার ছন্দ নেচে ওঠে,
‘ঐ যে এলো, ঐ যে এলো’ বলে ছুটি
তোমার দিকে
একটু খানি দেখার জন্যে,
কুশল বিনিময়ের জন্যে।
‘কখন এলে? নিরালা এই প্রশ্ন ঝরে,
শিউলি যেন তোমার ফুল্ল অধর থেকে।
ইচ্ছে করে বলি হেসে,
‘দিল্লীজোড়া গোধুলিতে
গালিব যখন ছিলেন বেঁচে।
কিন্তু এখন আগামী এক শতক-ছোঁয়া
হাওয়ায় কাঁপে তোমার খোলা
চুলের শিখা।
তখন ও কি সেই সময়ে থাকবো আমি?
গহন কোনো দুপুরবেলা
চোখে নিয়ে কৃষ্ণচূড়ার মোহন আভা
ব্যাকুল ছুটে আসবো আবার তোমার কাছে?
যখন তুমি ধূসর দূরে বসে থাকো,
হিস্পানী এক গিটার বাজে
করুণ সুরে মনের ভেতর,
যখন তোমার হৃৎকমলে চুপিসারে
ভ্রমর কালো ছায়া ফেলে,
পানিমগ্ন শিলার মতো
অবচেতন নড়ে ওঠে ঠারে ঠোরে,
আমার বুকে ধাক্কা লাগে, দদ্মবেশী
আদিবাসী বিস্ফোরিত আর্তনাদে।
যখন তোমার আঁটো স্তনে
জ্যোৎস্না কোমল শুয়ে থাকে,
রহস্যময় একলা গাছে নিভৃতে ফল
পাকতে থাকে।
যখন তোমার গালে জমে রাতের শিশির,
কবন্ধ পাঁচ অশ্বারোহী ছুটে বেড়ায় তেপান্তরে।
আলতো তোমার হাতের ছোঁয়া পাওয়ার জন্যে
হঠাৎ রোদের ঝলক-লাগা
ঝর্ণাধারার মতো তোমার
গলার আওয়াজ শোনার জন্যে,
খুচরো কিছু চুমোর জন্যে,
দুটি বাহুর বন্দরে ঠাঁই পাওয়ার জন্যে,
কালেভদ্রে একটুখানি দেখার জন্যে
আর কতকাল ভিক্ষু হয়ে
পুড়বো রোদে?
ভিজবো একা জল-বাজানো পথের মোড়ে?