আমি কি বলেছি
একবারও আমি কি বলেছি আসবো না আগামীতে
তোমাদের কাছে আর? উত্তোলিত হাতের মুঠোয়
লাগবে না নীলিমার ছোঁয়া?
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখে কোনোদিন
পদযাত্রা করবো না? তবে
কেন এত কানাঘুষো তোমাদের চায়ের আসরে
বস্তুত আমাকে নিয়ে? আমিতো বলিনি আসবো না,
মেলাবো না কণ্ঠ তোমাদের কণ্ঠস্বরে। তবু কেন
কথায় কথায়
কাঁটার ঝিলিক রাত্রিদিন? হায়, আমার নসিব,
এখনো ধোঁয়াচ্ছে ঘোর সংশয় নিয়ত।
এই যে আমাকে, হে বন্ধুরা, এত দিন কাছে পিঠে
দেখতে পাচ্ছো না, এর মানে এ নয় যে আমি দূরে
সরে গেছি তোমাদের কাছ
থেকে, আপাতত
গা এলিয়ে আশমানে চোখ রেখে দেখে
নিচ্ছি তারাদের মাইফেল। বহুদিন
আকাশের দিকে তাকানো
ঝিমানো ঝিলের মতো অবসর ছিল না আমার।
এই যে এখন জনসভা, হট্রগোল ছেড়ে ছুড়ে নিরালায়
গোলাপ, চামেলী, জুঁই নিয়ে, বই নিয়ে
মেতে আছি প্রায় সারাক্ষণ, তা বলে ভেবো না আমি
পলাতক। ভেবো নাপ আমার
অঙ্গীকার সরোবরে ডুবিয়ে মাছের
বুড়বুড়ি, ফাৎনার কম্পন আর পাতা ভেসে-যাওয়া
দেখে দেখে জীবন কাটিয়ে দেবো। এটা সত্য বটে,
পাখির চোখের অভ্যন্তরে
কোন্ রহস্যের খেলা চলে তার অন্বেষণে আজ দীর্ঘ বেলা বয়ে যায়।
কে আমি? কোথায় যাব? ইত্যকার প্রশ্নেরও ঠোকর
খেতে হয়, এর মানে এ নয় যে দানবের দাপটের কথা,
সংহার মূর্তির কথা ভুলে গেছি, সকল কিছুই
জ্বলন্ত লোহার সদ্য ছ্যাঁকের মতোই
দগদগে হয়ে আছে স্মৃতির কপালে।
এই যে মধুর এক মহিলার মুখ মনে করে
প্রহরে প্রহরে জ্বলি একা, তার উদ্দেশে সাজাই
অক্ষরের অর্ঘ্য রাত জেগে,
এর অর্থ যদি এ রকম প্রকৃত দাঁড়িয়ে যায়,
ভাবি না দেশের কথা, দশের দুর্দশা
বিষয়ে চরম উদাসীন আমি, তাহলে মিথ্যাকে
রাশি রাশি প্রশ্রয়ের মালা
পরিয়ে হুল্লোড় করা ছাড়া আর হবে না কিছুই।
এখন থমকে আছে সব, মনে হয়। অতিশয় ক্লান্ত আমি,
ব্যধির মুঠোয় বন্দি। জানি না কখন
আবার মুক্তির হাওয়া হাড়ে আনবে ফিরিয়ে তেজ,
অস্তিত্বে উঠবে জ্বলে বিদ্রোহী দেয়ালি
নিমেষে উপেক্ষা করে সব ভাঙচুর। শুধু জানি,
থমকে দাঁড়ানো মানে সকল সময় একেবারে
থেমে যাওয়া নয়, দেখে নিও
প্রয়োজন হলে কোনো হাঁক ডাক শোনার আগেই
আবার আসবো চলে প্রতিবাদী মিছিলে মিটিঙে।
আমিতো বলিনি আসবো না; আপাতত
স্বপ্নের চুমকিগুলি নেড়ে চেড়ে খানিক জিরিয়ে
নিতে চাই। আসবোই, ছুটে আসবোই।
শরীরের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যদিও
ঘুমিয়ে পড়েছে তবু চেতনার গভীর ভূস্তরে
একটি জাগর পাখি ক্রমাগত গান গেয়ে যায়।
আরো কিছু সময়
আরো কিছু সময় আমাকে দিলে, প্রিয়তমা, খুব
বেশি ক্ষতি হবে কি তোমার?
মালা-থেকে-খসা মুক্তো যেন
তোমার সময়,
প্রত্যহ ছিটকে পড়ে এদিক ওদিক। দু’চারটে
বেশি মুক্তো নির্দ্বিধায় তুলে দাও যদি
আমার ঝুলিতে, পৃথিবীর
বিখ্যাত আহ্নিকগতি থেমে যাবে, এমন তো নয়। থাক থাক
কোনো নড়বড়ে অজুহাতে অথবা যুক্তিকে ক্রাচে
দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই আর মুক্তি চাই
অনুপস্থিতির স্বৈরাচার থেকে; এসো
আমার নিকট সব তুচ্ছতার জঞ্জাল পুড়িয়ে। কেন তুমি
বুঝতে পারো না হায় প্রতীক্ষায় দিনরাত হাওয়ায় হাওয়ায়
উড়িয়ে দেয়ার মতো প্রচুর সময় নেই আমার মুঠোয়?
এই যে এখনো হাওয়া টেনে নিতে পারে ফুসফুস,
এখনো দু’চোখ
বাগান, পুকুর, পাখি, গ্রীষ্মের দুপুরে, নিরিবিলি গৃহকোণে
সুস্নিগ্ধ সুরাই কিয়দ্দূরে বিষাদের প্রতিমূর্তি একা ঘোড়া
দেখে নেয়; নিঝুম বৃষ্টির শব্দ, দোয়েলের গান
কানে আসে আজো,
এ এক পরম আশার্বাদ; কিন্তু কত অনিশ্চিত
আর ক্ষণস্থায়ী। চলে যেতে পারতাম
এই তো সেদিন দূরে, বহুদূরে, জীবনের অদৃশ্য ওপারে
পরিযায়ী পাখির ধরনে ছায়া রেখে
কারো কারো মনের দেয়ালে। যদি এক
বছর আগেও
নিতাম বিদায়, তবে হতো না তোমার সঙ্গে দেখা
কোনো কালে। এ আমার হাত, ওষ্ঠ, বুক
ঈর্ষাযোগ্য হতো না কখনো
দেবদূতের; তবু স্বস্তিহীন, শান্তিহীন দিন যায়, রাত
কাটে মনগড়া রত্নখচিত দেয়ালে
কোন্ সে দেশের বোধিদীপ্ত পাখিদের গান শুনে।
কী লাভ এভাবে বেঁচে থাকা ধুঁকে ধুঁকে,
হতাশার দিকে ঝুঁকে বুকে
নিয়ে অপ্রাপ্তির অমানিশা?
বরং এখনই এসো, প্রিয়তমা, শুষে নাও জিভে
অথবা নিঃশ্বাসে
হৃৎপিণ্ড আমার, যাতে সেখানে স্পন্দিত
না হয় কখনো আর তোমাকে পাওয়ার
দারুণ দহনময় মধ্যাহ্ন-আকাঙ্ক্ষা নিত্যদিন।
অথচ বাঁচাই কাম্য ততদিন, যতদিন তুমি
রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় হেঁটে যাও, তুলে নাও আলগোছে
নুয়ে উঠোনের গাছ থেকে ফুল, এবং তোমার
চুল ওড়ে খোলা পথে কিংবা ঘরে ফ্যানের হাওয়ায়।
এখন তো যে কোনো ছুতোয়
একরোখা কোনো চৌকিদারের ভঙিতে
মৃত্যু এসে লাঠি ঠোকে আমার চৌকাঠে,
আমার নিঃশ্বাস দ্রুত ক্রোক, করে নেবে বলে ভীষণ শাসায়
অন্তরাল থেকে, বিশেষতঃ
যখন থাকো না তুমি পাশে। বস্তুতঃ তোমার উপস্থিতি লেখে
জীবনের নাম
আমার নিঃশ্বাসে, তাই তোমাকেই চাই
চুম্বনে, নিবিড় আলিঙ্গনে আর তুমি তো জানোই, প্রিয়তমা,
আমার আয়ুর সীমা সরহদ কত সংকুচিত।
আলো অন্ধকার
বৃষ্টির সেহ্রা পরে ফ্ল্যাটবাড়িটা দাঁড়ানো
রাস্তার ধারে। তোমার ড্রইরুমে
আমরা দুজন গল্প করছি এটা সেটা নিয়ে, মাঝে মাঝে
পড়ছি কবিতা। কখনো জীবনানন্দের
দারুচিনি দ্বীপের ভেতর আমার প্রবেশ,
কখনো বা আলিঙ্গনরহিত অঙ্গে অঙ্গে
ইয়েটস-এর শাদা পাখির পাখার ঝাপট
আর সমুদ্রের ফেনা ছুঁয়ে যাওয়া। এক সময় চায়ে
চুমুক দিতে দিতে
ছন্দ বিষয়ে তোমার কৌতুহল চড় ইয়ের আঙ্গিক।
আমার কাছ থেকে তুলে নিচ্ছিলে জবাব,
যেমন পাখি ফলমূল
চঞ্চু দিয়ে। টিপয়ে শূন্য চায়ের কাপ আর
স্ন্যাকস-এর ভগ্নাংশ; তখনো
বৃষ্টির বাজনা থামে নি। সোফায়
গা এলিয়ে হঠাৎ তুমি বললে, ‘ধরা যাক তোমার
ডান হাত আমার হাতে এসে নীড় বাঁধলো
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধরনে, তখন কী করবে তুমি?’
চমকে উঠলাম। আমিতো সেই কবে থেকে
প্রবেশ করতে চাই তোমার একলা ভেতরে,
জাগিয়ে তুলতে চাই তোমার
অত্যন্ত ভেতরকার তোমাকে আর তোমার সত্তায় সরাসরি
মিশিয়ে দিতে চাই আমার সত্তা।
জীবনানন্দের কাব্যসম্ভার থেকে
চোখ তুলে তুমি তাকালে
আমার মধ্যবিত্ত সংস্কারে আরণ্যক ঝড় জাগিয়ে।
তোমার দৃষ্টি এবং হাসিতে ক্রমাগত
কাঁপতে থাকে কয়েক শতাব্দীর আলো-অন্ধকার।