প্রকৃতির দীপ্র স্নিগ্ধ উৎসব
কে তুমি? কে তুমি আমাকে ব্যাকুল ডাকছ এই দারুণ
অবেলায়? তুমি কোনও বিজ্ঞানী নও নিশ্চয়ই,
তোমাকে তোমার দুরূহ গবেষণার কোনও কাজে
এতটুকু সাহায্য করার যোগ্যতা আমার নেই।
কে তুমি এই ঘুটঘুটে আন্ধারে উচ্চস্বরে ডাকছ আমাকে? তুমি কি
দার্শনিক? গূঢ় কোনও তত্ত্বের আলোচনার
প্রাথমিক ধাপে উঠে আসতে পারি, নিজেকে এরকম
ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করতে অপারগ আমি।
অনেক অনেক হৈ-হুল্লোড় থেকে কে ডাকছে আমাকে? কোনও
রাজনৈতিক নেই নেতা গলা ফুলিয়ে আমাকে ডাকবে, হতেই পারে না।
ক্ষমতার জৌলুশে মাতোয়ারা সে ডুবে আছে
মোসাহেবদের বন্দনায়। আমাকে দিয়ে ওর কোনও কাজ হাসিল হওয়ার নয়!
একজন কবি কি আমাকে ডাকছে কালবেলায়?
কেন ডাকবে সে এই বিপন্ন, অসহায় আমাকে? সে-তো এখন
ঝুঁকে রয়েছে তার লেখার টেবিলে। তার খাতার পাতায়্য জ্যোৎস্না,
নদীর ঢেউ খেলা করছে, ফুটছে ফুল, দুলছে আনন্দ-বেদনার
রৌদ্রছায়া। কবির নিজস্ব জগতে সবচেয়ে বিশ্বস্ত,
একনিষ্ঠ সঙ্গী নিঃসঙ্গতা। আমি ওর জন্যে অপরিহার্য কেউ নই।
কণ্ঠে সুরেলা ঢেউ তুলে কে ডাকছে? ডাকছে কি আমাকে?
সেই ডাক দুলে দুলে চলে আসছে আমারই দিকে, আমার সত্তায়
বুলিয়ে দিচ্ছে আদরের রেশম। সত্যের মতো নগ্ন,
গাছের কচি পাতার মতো সজীব, আনন্দময়
একজন শিশু অপ্রতিরোধ্য তুলতুলে ভাষায় ডেকে ডেকে
হাঁটি পাঁটি পা-পা আসছে
আমারই দিকে দু’হাত বাড়িয়ে। ওকে জড়িয়ে ধরার জন্যে
আমি আমার সকল অনীহা আর প্রত্যাখ্যান
সরিয়ে এগিয়ে যাই, ওকে টেনে নিই ব্যাকুল শূন্য বুকে
এবং আমাদের ঘিরে তখন প্রকৃতির দীপ্র স্নিগ্ধ উৎসব।
ফিরে এসো বন্ধু
বন্ধু, এ কেমন অভিমান তোমার? কত না সূর্যোদয়, কত
সূর্যাস্ত বিলীন হলো অনন্তে, অথচ
ভীষণ নির্বাক তুমি, তোমার ঠোঁটে একটিবারও
ঝলসে উঠছে না আমাদের চিরচেনা
সেই মধুর হাসি। প্রিয় সেন্টু, প্রিয় কবিবন্ধু
আবু জাফর ওরায়দুল্লাহ, তোমার নীরবতা এমন
কনকনে শীত আর সইতে পারছি না আমরা, তোমার
কণ্ঠস্বরের জন্যে বড় তৃষ্ণার্ত ঘরের চার দেয়াল,
লেখার টেবিল, বইপত্তর, সবচেয়ে বেশি তোমার প্রিয়তমা
জীবনসঙ্গিনী, তোমার আত্মজা কাকাতুয়া, তোমার
আড্ডাবাজ বন্ধুমণ্ডলী। আর কত হিমযুগ তুমি ঢেলে দেবে
ওদের দিকে? কোন উষ্মায়? কোন একরোখা অভিমানে?
ভাবতেই পারি না এতদিন তুমি এভাবে থাকবে
এমন নীরবতা ভালোবেসে। মনে হয় কত শতাব্দী কেটে গেছে,
তুমি কিংবদন্তির কথা বলো না, তোমার মমতাময়ী মায়ের
কবরের ঝরা ফুলের কথা বলো না। চর্যাপদের
হরিণ আর ইয়েটস-এর রাজহাঁস
তোমার শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, ওদের কি অভ্যর্থনা
জানাবে না তুমি? সস্নেহে বাড়িয়ে কি দেবে না হাত?
ওগো বন্ধু, জাগো কবি, সময় বয়ে যায়।
ফিরে এসো বন্ধু নিস্তব্ধ কুয়াশাচ্ছন্ন প্রান্তর থেকে
ফিরে এসো প্রিয়তমা মনির উষ্ণ আলিঙ্গনে। চেয়ে দেখো,
কী ব্যাকুল দৃষ্টিতে সে অষ্টপ্রহর তাকিয়ে রয়েছে তোমার দিকে,
তাকিয়ে দেখো, যে কোমল হাত সারাক্ষণ তোমার
শুশ্রুষায় নিবেদিত, সেই হাতে নিয়ে আবার
ক্রীড়াপরায়ণ হও তুমি। ভালো করে দেখো তোমার ঘরে কাব্যলক্ষ্মী
অপরূপ চাঞ্চল্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর বারবার
তোমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন কবিতার খাতা। বেলা যে যায়,
এবার চটজলদি কুয়াশার জাল ছিঁড়ে
উঠে পড়ো, আনন্দের ঝর্ণাধারা বইয়ে দাও নিরানন্দ ফ্ল্যাটে।
১.১১.২০০০
ফেরার উপায় নেই
আহারে ছিল না রুচি, উপরন্তু অনিদ্রা আমাকে ঘষটাতে
ঘষটাতে বৃক্ষতলে ফেলে দেয়। এমন অচেনা পরিবেশে
এলেই চৌদিক থেকে কিছু ধ্বনি প্রতিধ্বনি নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে
আমাকে ঝাঁকুনি দেয়। বার বার অস্তিত্বের ভিড় কেঁপে ওঠে।
পরিবেশ পাল্টে যায়, আমার কম্পিত অস্তিত্বের অন্তর্গত
অন্য একজন আচমকা ঝোড়ো ভঙ্গিমায় এসে
ছোট ঘরটায় বসে আমার সম্মুখে। অবয়ব তার খুব
অস্পষ্ট; কখনও চেনা, কখনও বা কেমন অচেনা মনে হয়।
বাস্তবিক! তাকে কোন্ নামের ব্র্যাকেটে সম্বোধন
করবো, স্বাগত জানাবার ভঙ্গিমায়
আন্তরিক গড়বো হাতের মুদ্রা, ভেবেই পাইনি। সে চকিতে
চেয়ারে নিবিড় বসে টেনে নেয় খাতা, যার কতিপয় পাতা
সযত্নে সাজানো কবিতায়। আধোচেনা লোকটার
হাতের কলম লহমায় বেজায় চঞ্চল হয়, সাদা পাতা
ক্রমান্বয়ে প্রফুল্ল ধারণ করে পঙ্ক্তিমালা। এমনই ধরন
লোকটার, যেন আমি নেই এই ঘরের কোথাও।
পরিচিতি হস্তাক্ষরময় পাতা টেবিলের এক কোণে রেখে
চেয়ার ছেড়ে সে চুপচাপ ঠাঁই নেয় পুনরায়
অন্তরে আমার। অকস্মাৎ দু’চোখে আপনকার ছোট ঘর
অনন্য নক্ষত্র পল্লীরূপে প্রতিভাত হয়। অচেনা রূপসী
একজন, সমস্ত শরীর যার জলবিনুময়,
চোখে জ্বলজ্বলে অমরতা, বলেন আমাকে অতি নৈর্ব্যক্তিক
কণ্ঠস্বরে, ‘ব্যর্থতার ধুধু মাঠ কখনও কাউকে
হতাশার ধুলো ছাড়া দেয় না কিছুই। অগণিত কঙ্কালেরা
অট্রহাসি ছুঁড়ে করুণ কান্নার রোল শোনায়, শিরায়
রক্তধারা হিম হয়ে আসে। ফিরে যাও, ফিরে যাও।
আমাকে বিপন্ন করে রূপসীর কণ্ঠস্বর অজানা কোথাও
ডুবে যায়। সরোবরে? সমুদ্দুরে? অথচ আমার
ফেরার উপায় নেই; আশা কিংবা নিরাশায় সেই একই পক্ষে
যেতে হবে চেতনা সজাগ রেখে কায়ক্লেশ সয়ে দিনরাত।
৯.১.২০০১