দুটো চোখ
এই তো সেদিন গোধূলিতে আধলেখা একটি কবিতা শেষ
করবার ইচ্ছায় টেবিলে ঝুঁকে ছিলাম লেখায়
মগ্ন কিছুক্ষণ, কয়েকটি শব্দ আমার মাথায়
বাগানে সুস্নিগ্ধ প্রজাপতির ধরনে উড়ে উড়ে
দিব্যি ঘুরে বেড়ায়, কখনও ফুলে বসে নিরিবিলি
পাখনা নাচায়, পঙ্ক্তি হয়ে দেখা দেয়
খাতার পাতায়। হৈ হুল্লোড় নেই, অকস্মাৎ দেখি,
টেবিলের মধ্যস্থলে একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে
বিহ্বল আমার দিকে। কার চোখ? মনে হয় চিনি,
অথচ অচেনা লাগে পরমুহূর্তেই।
সেই দুটি চোখ এখন হ্যাঙারে
ঝোলানো মলিন ট্রাউজারে, তখন উজ্জ্বল বিছানায় আর
আমার নিঝুম ঘুমে ঘুরে বেড়ায় কেবলি। চক্ষুদ্বয়
কিছু কি বলতে চায়? বলতে কি চায় কোনও ইতিহাস
অথবা খুলতে চায় দূর কোনও ট্রাজেডির জট? হায়, আমি
মরণের পূর্বমুহূর্তেও জেনে যাবো না সে দুটি
চোখের না-বলা কথা। শুধু মাঝে মাঝে দেখা দেবে
আমার এ বাসগৃহে, সভাস্থলে, কখনও বা পৌরপথে। ভাবি,
ওরা একালেরই কারও স্মিত মুখে সুশোভিত কিংবা
সুদূর কালের কোনও রূপসীর প্রগাঢ় নয়ন।
১৩.১২.২০০০
দূরত্ব
দূরত্ব থেকেই যায়, কাছে থাকলেও; এই যে এখানে আমি
শত শত মাইলের ব্যবধানে একা।
ভিনদেশে রেস্ট হাউজের শূন্য ঘরে নিঃসঙ্গতা
নিয়ে বসে আছি বহুক্ষণ, মনে হয় বহুকাল,
ভাবছো কেমন করে এই ভয়ঙ্কর শীতল হিংস্রতা নাম্নী
রমণীর সঙ্গে ঘর করছি এখন? এমনই তো হয়ে থাকে
বহুদিন ভিন্ন ভিন্ন রূপে। এমনকি যখন তোমার পাশে
বসে থাকি বাক্যহারা কিংবা তোমার কথার কলি
প্রস্ফুটিত হয়, চেয়ে থাকি
গভীর তোমার দিকে, ডুবে যাই গহন পাতালে বড় একা।
২০.১২.২০০০
ধিক্কারের ঝড়
লালনের আখড়ার
চোখ থেকে আজকাল
অবিরল জল ঝরে,
এখন তো লালনের
আখড়ার বুক ফেটে
চৌচির গাছের শোকে,
অশুভ ছায়ায় ম্লান
সব বাউলের মুখ,
উঁচু দালানের ভিত
নড়ে ধিক্কারের ঝড়ে;
মেঘলোকে ফোটে, ভাসে
মরমী কুসুমগুলি।
আখড়ার হৃৎপদ্মে
একতারা কেঁদে মরে,
একী ঝকমারি আজ,
লালনের নেই ঠাঁই
তাঁরই নিজ আখড়ায়,
তাড়া খাওয়া সাঁইজির
একতারা বেজে চলে
মাঠে, হাট বাজারেই।
১৪.১.২০০১
নিদ্রার কুয়াশায়
ইদানীং এই স্বপ্ন অনাহূত অতিথির মতো
হুট করে চলে আসে আমার নিদ্রার কুয়াশায়,
দাঁড়ায় কোমরে হাত রেখে খাস খোলা
দরজায় নির্দ্বিধায়। ঠোঁটে তার কৌতুক মেশানো
হাসি খেলা করে, যেন সেই মৃদু হাসি
একটি কাহিনী ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেছে,
যা বলার তাগিদে এখানে এসে পড়ে
বারবার বিনা আমন্ত্রণে। আছে তার অলিখিত অধিকার।
এ স্বপ্নের জিভ গল্পময় আরব্য হাজার এক রজনীর
শাহেরজাদীর মতো। অনর্গল বলে সে আমার
কবিতার কথা, বলে-অম্লান জীবনানন্দ, পল এলুয়ার,
ইয়েটস্ ফেলেছেন নিরিবিলি ছায়া
আস্তেসুস্থে বিমুগ্ধ প্রহরে
আমার অজ্ঞাতে অধমের কোনও কোনও কবিতায়।
নেমকহারাম নই, করবো না অস্বীকার। এ-ও তো বলেন
গুণীজন-কোনও কোনও কবিতা হতেই পারে অন্য কবিতার
জন্মভূমি, লালিত হতেই পারে কিছু
নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসহ। এ নিয়ে চায়ের পেয়ালায় নিরর্থক ঝড় তোলা।
কয়েক মুহূর্ত পরে সতেজ শরীর থেকে সব ঝরাপাতা ঝেড়ে ফেলে
জেগে ওঠে স্বপ্নের আলাদা অংশ নতুন আলোয়-
এ স্বপ্ন আমারই সত্তা, লাফিয়ে উঠেছে কণ্ঠে তার
মায়াবী সুরের এক দীপ্তিময় পাখি যার দু’টি
চোখে ক্ষণে ক্ষণে খেলে যায় সত্যের বিদ্যুৎ, কণ্ঠে
ঝলসিত কী উদাত্ত উচ্চারণ, ‘আমি কারও প্রতিধ্বনি নই।
আমাকে সমীহ করো আর না-ই করো,
যতই সামান্য হই, তবুও অনন্য সর্বদাই।
২৯.৬.২০০০
পাউরুটিগণ
রাত্তির ডাগর হ’লে দোকানিরা বেবাক দোকানপাট বন্ধ
করে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর এক
তালাবদ্ধ জমকালো কনফেকশনারি দোকানে
পাঁউরুটিগণ সভা থেকে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়ে
উড়ে উড়ে দোকানের বাইরে ছড়িয়ে
পড়ে আসমানে মেঘলোকে, নানাদিকে, যেন পাখি।
পাউরুটিগণ উড়ে উড়ে যাচ্ছে ডাগর রাত্তিরে
নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে মহল্লায়, সুনীল সমুদ্রতীরে, সোমত্থ
নদীর
বুক ছুঁয়ে, আহত বনের গাছ এবং পাখির নীড়ে কিছু
আদর বুলিয়ে; উড্ডয়নে ক্লান্তি নেই দ্রোহীদের।
আখেরে উড়ন্ত পাউরুটিগণ নামে ভালোবেসে
ধূসর মাটিতে
যেখানে নিঘুর্ম ছটফট
করছে ক্ষুধায় ক’টি মানবসন্তান। দ্রোহী পাউরুটিগণ
ওদের নিকট এলে অন্ধকারও আলোর অধিক
হয়ে যায়, হীরের অধিক হয় বেশ কিছু চোখ।
ভীষণ ক্ষুধার্ত নরনারী লহমায় খেয়ে ফেলে সব রুটি,
আর দ্রোহী পাউরুটিগণ
অকাতরে এই আত্মবিসর্জনে ধন্য মানে
নিজেদের ক্ষণিক জীবন।
২৯ ১২ ২০০০
পাড়াতলী গাঁয়ে যাই
পাড়াতলী একটি গাঁয়ের নাম, এই সহজ কথাটি আজ
অনেকেই জানে বলে অনুমান করি। পাড়াতলী
আমাদের আদি বাসস্থান
বহু যুগ ধরে কল্লোলিত মেঘনা নদীর তীরে। এখানেই
ছিলেন আমার পিতা, পিতামহ, মাতামহ আর
প্রবীণ প্রপিতামহ আর বহু গুরুজন। আরও অনেকের
নাম সময়ের কালি ঢেকে
ফেলেছে সে কবে, আমি জানতে পারিনি।
পাড়াতলী গাঁয়ে কখনও সখনও যাই গূঢ় আকর্ষণে
নিজের উৎসের আর পিতার নির্মিত
দালানে প্রবেশ করি কিছু স্মৃতির সুঘ্রাণ নিতে। দালানের
পাশেই পুরনো মসজিদ, মসজিদটির পাশে
কী নিঝুম গোরস্তান, যেখানে আমার পিতা, পিতামহ আর
মাতামহ গভীর, গভীরতম ঘুমে অচেতন এবং আমার প্রিয়
সন্তানও সেখানে আছে মাটির নিচে ঘুমপাড়ানিয়া
গানে মগ্ন দুনিয়ার মাঠের খেলার মায়া ভুলে।
পাড়াতলী গাঁয়ে আজও বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। এই গ্রাম
এখনও প্রকৃত গ্রাম রয়ে গেছে, নগরের নষ্টামি, ভ্রষ্টামি
এখনও করেনি স্পর্শ। মেঘনা নদীর ডাকে, আমার উৎসের
গভীর গভীর টানে মাঝে মাঝে আমি পাড়াতলী গাঁয়ে যাই।
১৭.১২.২০০০