তবুও ভোরবেলা
চিনি তাকে, পুরোপুরি নয়, আংশিকভাবেই,
বলা যায়। কথা হয় মাঝে মাঝে কখনও পথের
এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কখনও বা নদীতীরে গোধূলিতে
জনহীনতায়, সেইসব কথা কিছু কিছু বুঝি, সিংহভাগ
বোধের আড়ালে থেকে যায়। কোথায় নিবাস তার, জীবিকার
কী ধরন, জানতে পারিনি কোনওদিন। তিনি কি সংসারত্যাগী?
একদিন নিবিড় গোধূলিলগ্নে পথে যেতে যেতে গাঢ় স্বরে
আমাকে বলেন তিনি, ‘একটি অদ্ভুত জীব দ্রুত চেটে চেটে
খাচ্ছে ঘরবাড়ি, পথঘাট এবং দোকানপাট। জীবটির
সমস্ত শরীরে ফুটে উঠছে আক্রোশ, জিভ থেকে
ঝরছে উত্তপ্ত লাভা। বিভীষিকাময়
ধ্বংসের বিষাক্ত কাঁটা বিদ্ধ হচ্ছে ডানে বামে। একটু পরেই
তুমিও শুনতে, পাবে সম্মিলিত সত্তাদীর্ণ ক্রন্দনের রোল
এখানে, সর্বত্র, বলে তিনি অন্তর্হিত অতিদূর গোধূলিতে।
তবুও কিশোরী ছোটে ভোরবেলা প্রজাপতির পেছনে, সরু
গলিতে যুবক গান গায়, ফেরিঅলা ডেকে যায়, বারান্দায়
তরুণ-তরুণী প্রেমালাপ করে, প্রবীণেরা হাওয়া খেতে যান
পার্কে, আমি বই খুলে বসি, দেখি ভাসমান মেঘ।
১৪.১২.২০০০
তসলিমার জন্যে পঙ্ক্তিমালা
তসলিমা, প্যারিসের কিয়দ্দূরে একটি মনোরম
সবুজ-ওড়না জড়ানো শান্ত এলাকায়
এক রাত্তিরে তুমি ছুটে এলে এই অসুস্থ, ভাঙাচোরা
আমার কাছে। আমি জানি, তুমিও ভালো করেই জানো,
তসলিমা, যে যাই ভাবুক, তোমার আমার সম্পর্ক
চাওয়া-পাওয়ার কোনও বুনিয়াদে স্থাপিত নয়।
তসলিমা, তুমি যে বিষাক্ত শরাহত কাতর
হরিণীর মতো তা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। হ্যাঁ, তুমি
নাছোড় আকুলতায় হাজির হয়েছিলে, ঘন ঘন সিগারেট ফোঁকা
তোমার মনের আবহাওয়াকে নগ্ন করে
তুলছিল; বেদনা দরবারী রাগ হয়ে
ছড়িয়ে পড়ছিল তোমার সত্তাকে ঘিরে। তোমার দুটি চোখ
বিস্তারিত বর্ণনাকে টপকে এক সীমাহীন যন্ত্রণার
ইতিহাসকে প্রকাশ করছিল আশ্চর্য ভঙ্গিতে।
খ্যাতির জৌলুশ এখানে বলডান্স মগ্ন তোমার সঙ্গে,
চারপাশে থেকে তোমার দিকে এগিয়ে আসছে শ্যাম্পেনের
বোতল, পানপত্র, ভোগবাদী দর্শনের টানাহ্যাঁচড়ায়
তসলিমা, তুমি ক্লান্ত, ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ,
দেখতে পেয়ে আমার মনে বিষণ্নতার লতাগুল্ম ঝুলে রইল।
ভীষণ ব্যস্ত তুমি, যেন কোনও অতিশয় মূল্যবান রঙিন মাছ
আটকা পড়েছ জটিল জালে। তোমার ছটফটানি
আমি প্রত্যক্ষ করি তরুণ বন্ধুর পাশাপাশি বসে তার ড্রইংরুমে।
না তসলিমা, তোমার আর কোনওদিনই খাওয়া হবে না
মায়ের হাতে রাঁধা ভাপ-ওঠা লাল চালের ভাত,
টাট্কি মাছের ভর্তা, শিং মাছের ঝোল; তোমার না আর
কোনওদিন উত্তর আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে
তোমার অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাবেন না, তোমার
কল্যাণের জন্যে খোদার আরশে মাথা লুটিয়ে
পড়ে থাকবেন না। না তসলিমা, মার সঙ্গে
তোমার কস্মিনকালেও আর দেখা হবে না। এ কথা অনেক আগেই
জেনে গেছ তুমি। তোমার সুতীক্ষ্ম বোধ তোমাকে
অনেক কিছুকেই খোলা রাস্তায় ন্যাংটো করতে শিখিয়েছে।
তসলিমা, তোমার কি মনে পড়ে সেইসব আগুনে ঝলসানো
দিনগুলোর কথা, যখন তুমি, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আমি
কতিপয় তরুণ তরুণী ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি
তোমার ফ্ল্যাটে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরে
তোমার সম্ভাব্য বিপদের কথা আঁচ করে। প্রতিটি
মুহূর্ত আমাদের কেটেছিল আশঙ্কায়, আতঙ্কে এবং
শাসন-না-মানা এক ধরনের আনন্দে। সেই অতিবাহিত সময়
আজও মনে যুগপৎ বেদনা ও আনন্দের প্রহর ডেকে আনে
রাখালিয়া সুরের মতো। তসলিমা, তুমি সেই সুরে
ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হও মৈয়মনসিং-এর কোনও পুকুরঘাটে,
ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, আড়িয়ালা খাঁর তীরে, ফেব্রুয়ারির বইমেলায়
কলকাতার কফিহাউসে কলেজ স্ট্রিটে।
তসলিমা, তুমি সেই রাতে শুধু আমাকে দেখার জন্যেই
ছুটে আসোনি প্যারিসের কিয়দ্দূরে এক শান্ত এলাকায়। লুকিও না,
সত্যি কথাটি বলেই ফেলো তুমি তো স্পষ্টভাষিণী। আসলে
তুমি আমার কাছে এসেছিলে ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদী, রাস্তার
ধুলোর ঘ্রাণ শুঁকে নিতে, কান পেতে শুনতে
বাংলাদেশের হৃৎস্পন্দন, তুমি বিদেশে স্বদেশকে আলিঙ্গন
করতেই এসেছিলে ছুটে গোল্লাছুট খেলতে আসা বালিকার ধরনে।
অথচ এই দেশ থেকেই তোমাকে কতিপয় অন্ধ, নির্বিবেক, নিষ্ঠুর লোক
হিঁচড়ে টেনে বের করে দিলো দু’দেশের সীমানা-চিহ্নিত
কাঁটাতারের ওপারে, যেখানেও আখেরে ঠাঁই হলো না তোমার।
১৩.৫.২০০০.
তার খেদোক্তি
ভীষণ অসুস্থ কবি; শয্যাগত তিন মাস ধরে। মুখে তার
রুচি নেই, বমি হয় ঘন ঘন, রাত্তিরে গায়ের ঘুম,
কিছু ছায়া ভাসে চোখে। যে-নারী কবির প্রিয়তমা
সেভাবে বিষণ্নতায় ডুবে, ‘প্রজাপতি,
লেজঝোলা পাখি, পিঁপড়ে, দেয়ালবিহারী টিকটিকি, এমনকি
অদূরে দাঁড়ানো নিম গাছের সবুজ পাতা, রোদ, জ্যোৎস্না আর
বৃষ্টিধারা দ্যাখে তাকে বারবার বাঁধহীন। কাব্যলক্ষ্মী রোজ
গভীর রাত্তিরে যান তার শয্যাপাশে, জপেন কত না পঙ্ক্তি
কানে কানে; শুক্নো ঠোঁটে মদির আবেগে দেন এঁকে
অগণন তপ্ত চুমো, অথচ পারি না আমি যেতে
আমার কবির কাছে যখন তখন। হা সমাজ,
হায় লোকলাজ, যাক গুঁড়িয়ে সকল কিছু আজ।
গুঁড়িয়ে যায় না কিছু, সমাজপতিরা আজও বড়ই কঠোর,
বিদ্রোহের শিখা ফুঁয়ে ফুঁয়ে নেভাবার
আয়োজনে বেজায় তৎপর অনেকেই। কত হৃৎপদ্ম শুকায়
নিষ্ঠুর খরায় অন্তরালে, জাঁহাবাজ নখর এবং ওষ্ঠ
ঠুক্রে ঠুক্রে খায়্য প্রণয়ের চোখ, মানবতা শুধু
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর চিতাগ্নিতে পোড়ে বিবেকের শব।
৭.১১.২০০০