গোধূলিতে প্রত্যাশা
অনেকটা পথ তো হেঁটেছি এ যাবত। রৌদ্রছায়া
দেখা হলো বেশ কিছু, পাথরের সন্ত্রাসে জখমি হয়ে খুব
কখনও ক্লান্তিতে চোখ বুজে এসেছে বিজন পথে,
যেখানে ঘাতক পশু কিংবা মানুষ নামের স্রেফ
নকল তক্মা-আঁটা জানোয়ার ওঁৎ পেতে থাকে। কখনও বা
মধ্যপথে অকস্মাৎ ফুলের সুঘ্রাণে প্রাণ সঞ্জীবিত হয়।
কত যে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে খুঁজতে হবে শুভ
ঠিকানা কোথাও। কিন্তু সত্যি কি ঠিকানা বলে কিছু
কোথাও বিরাজ করে? কায়ক্লেশে যেখানেই যাই
নিজেকে বেগানা লাগে খুব, সবাই আমার দিকে
তাকায় এমন ঢঙে, যেন আমি এক সঙ, এসেছি সুদূর
অচেনা অজানা কোনও গ্রহ থেকে। কেউ
করে না আলাপ, শুধু দৃষ্টি হেনে যে যার গন্তব্যে
পৌঁছে যায় হয়তো বা। আমি একা পড়ে থাকি পথের কিনারে,
ভীষণ সিঁটিয়ে থাকি নিজের ভেতর। কয়েকটি রুক্ষ গাছ
আজ সাক্ষী আমার নিঃসঙ্গতার; রক্তখেকো পাখি ডেকে ওঠে
নানা দিক থেকে, দিশেহারা আমি চোখ মেলে রাখি
সেদিকেই, যখন যেদিক থেকে সন্ত্রাসী পাখির ধমকের শব্দ আসে।
আমার পথের শেষ কোথায়, জানি না। যেখানেই
হোক না, সেখানে যেন থাকে সুশীতল
ঝরনাধারা, লতাগুল্ম, গাঢ় ছায়া-ছড়ানো ক’জন
প্রবীণ দয়ালু গাছ, যারা ক্লান্তি মুছিয়ে দেবেন
পথিকের। আর যেন থাকেন নিকটে
জ্যোতির্ময়ী কেউ, যিনি আমার ব্যাকুল আঁজলায়
দেবেন ঝরিয়ে গোধূলিতে
ঝরনার শীতল জল প্রণয়ের গহন আঙ্গিকে।
৮.৭.২০০০
জীবন হোক হাসি-ঝলসিত শারদ আকাশ
এ কী হলো! ভাবিনি কখনও আগে এরকম হুট
করে, হায়, গোধূলি আসবে নেমে জীবনে আমার
কাঁপিয়ে সত্তার মূল কাঠামো, ছিলাম
মগ্ন কাজে, সাদা
কাগজে আঁচড়ে কেটে কেটে, কত রাত হয়ে গেছে
শিশুর হাসির মতো ফুটফুটে ভোর। কখনও বা
তুইতোকারিতে, হাসি-হুল্লোড়ে করেছি নরক
গুলজার ইয়ারবক্সির সঙ্গে। প্রণয় পেখম
মেলে কত বিমুগ্ধ প্রহরে
করেছে আমাকে ঋণী, কেটেছি সাঁতার ঝলমলে সরোবরে।
আজ এই গাঢ় গোধূলিতে ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গতা
শিরায় শৈত্যপ্রবাহ আনে, এমনকি
ভিড়ে আরও বেশি একা লাগে, মনে হয় ডুবে যাবো
অতল আন্ধারে। কত ছায়া-সহচর আসে যায়,
কেউ চুপচাপ বসে থাকে, কেউ বা ভ্যাংচায় মুখ, কেউ কেউ
অঙ্গুলি নির্দেশ করে মাটির স্তূপের দিকে, নিভৃত কবর
যার ডাক নাম। যেন খুব কাছের কাউকে ডেকে
ইচ্ছে হয় বলি এই গোধূলিতে মগজ ভীষণ
যাচ্ছে ছিঁড়ে নখরের সুতীক্ষ্ণ আঘাতে। কে আমাকে
বাঁচারে এমন সন্ত্রাসের নগ্ন নিপীড়ন থেকে?
কেউ কেউ ভীষণ ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে ধমকায়-
‘বুড়ো তোকে মৃত্যু এই মুহূর্তে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাক। আজ আমি
এমনই বেহুদা আর ঘূণিত উদ্বৃত্ত কেউ, খুব
অপ্রয়োজনীয় আর নিশ্চিত বাতিল। আকাশের
দিকে চোখ চলে যায় অভ্যাসবশত, চোখ ভিজে
ওঠে প্রায়, তবু শুক্নো রয়ে যায়, বড় জ্বালা করে।
তবে কি আমার উপস্থিতি এই গোধূলিতে এতই অসহ্য,
আমাকে এখনই চলে যেতে হবে সব ছেড়েছুড়ে? এখনই কি
ওরা সব আমার দু’চোখে
সূর্যাস্ত আনতে চায়? আমি যা দিয়েছি এতকাল
নিজেকে পীড়ন করে, নিংড়ে, তার নেই কি কোনওই মূল্য, হায়?
সবই কানাকড়ি আর এক মুঠো ধুলো?
কারও বাড়া ভাতে ছাই দিইনি কস্মিনকালে, কারও
বাগান করিনি লণ্ডভণ্ড বুনো মোষ ছেড়ে দিয়ে। আমি শুধু
চেয়েছি থাকতে নিরিবিলি আপনজনের মাঝে,
চেয়েছি ঝরুক জীবনের সুধা আমার উৎসুক ঠোঁটে,
বর্ষায় উঠুক বেজে মাঝে মাঝে বৃষ্টির নূপুর,
শিশুর মধুর কণ্ঠস্বরে গান হোক সারা ঘর,
গ্রীষ্মে কিংবা শীতে হৃদয়ের ভিটে মুখরিত হোক
উৎসবে, জীবন হোক হাসি-ঝলসিত শান্ত শারদ আকাশ।
১৬.৮.২০০০
টাইটান
প্যারিসের সহনশীল দূরবর্তী নিঝুম জায়গা নোয়াজিএলে
এক গা ঘুম থেকে ঝকঝকে সকালে জেগে উঠে কী এক ঘোরে
দেখতে পাই, প্রিয় স্বদেশে আমি সুদূর সময়ের একটি অগ্নিরথে
সওয়ার। রথ বিপুল আগুনের গোলা ছুঁড়ছে চারদিকে। এই
গোলাগুলো শান্ত, ভালো মানুষদের গায়ে লাগছে না।
আমার হাতে মারাত্মক সব অস্ত্র, যেগুলো থেকে নিঃশ্বাস বেরুচ্ছে নিশ্চিত
মৃত্যুর; কিন্তু এই অবধারিত নিঃশ্বাস এতটুকু ছোঁবে না অবোধ শিশু
অথবা সৎ, নিরপরাধ, শান্তিপ্রিয় নারী-পুরুষদের।
এই অগ্নিরথের সারথি সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণ। ইতিমধ্যে আমি
রূপান্তরিত এক টাইটানে। অতিকায় মানুষটি সংরক্ষিত এক
অভেদ্য বর্মে, আমার অগ্নিময় ফুৎকার এক ঝটকায় পুড়িয়ে
ফেলবে বিচিত্র জঞ্জাল, মানবতার জাতশক্র হিংস্র ধর্মান্ধ, নানা
ধর্মের মৌলবাদী, নিষ্ঠুর উৎপীড়নকারীর সকল প্রকাশ্য ও গুপ্ত আস্তানা।
শত বাধাবিপত্তি উজিয়ে এতকাল যে ইলিম হাসিল করেছি, কসম তার,
আমার ভেতর একরত্তিও সংহার-প্রবৃত্তি নেই।
১৪.৫.২০০
নোআজিএল (প্যারিস)
ডাক
ছেলেবেলা হেসে খেলে কেটে গেছে, কৈশোরে হেঁটেছি
নিষ্কণ্টক, পাথরবিহীন পথে এবং যৌবনে
পথ চলাতেই ছিল রাঙা পলাশের
জয়োল্লাস, পূর্ণিমার শান্ত মাদকতা আর অনিন্দ্য সঙ্গীত
হৃদয়ের। অথচ যৌবনোত্তর কালে
আকাশ আচ্ছন্ন হলো কালো মেঘে, ঝড়ক্ষুব্ধ কত
দিনরাত কাটলো উদ্বেগে, বারবার
জানা ও অজানা না শঙ্কায় উঠেছি কেঁপে নিজেরই ভিটায়।
বিস্তর বয়স হলো, শরীরের কাঠামো বড়ই
নড়বড়ে, রকমারি অসুখের চোরাগোপ্তা মারে প্রায়শই
হচ্ছি কাবু। কী-যে হলো, আজকাল রজ্জু দেখলেই
বিষধর সর্প বলে ভ্রম হয়, আঁতকে উঠে ক’হাত পেছনে
হটে যাই, ঘিরে ধরে দুঃস্বপ্নের জাল অষ্পষ্ট নিদ্রার কালে।
কত প্রতারণা আর কত যে জোচ্চুরি, খুব ঠাণ্ডা
মাথায় দিনদুপুরে সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ বস্তুত মনুষ্যরূপী
পশুদের বর্ধমান। অসহায় মানবের আর্তনাদে মেঘ,
নক্ষত্রের বুক দীর্ণ হয় হামেশাই। কত মুখ
অবলীলাক্রমে হলো বিকট মুখোশ কারও গোপন সংকেতে।
কোজাগরী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাধারা পারে না ঘোচাতে
ঘাতকের রক্তপায়ী ছোরার খুনের ছাপ, ব্যর্থ অপরাধী
রিভলবারের কালি মোছাতে সর্বদা। ইদানীং
শুভ আত্মাহুতি দেয় অশুভের পঙ্কিল ডোবায়।
কুচক্রী ছায়ার নিচে দিন কাটে, রাত
অনিদ্রার কাঁটায় নিয়ত বিদ্ধ কম্পিত হৃদয়ে শুনি
একটি আবছা ডাক। আজকাল সেই ডাক আমার শরীর
ছুঁয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে, একদা যা ছিল
অস্তিত্ববিহীন প্রায়। এখন তো নিজ গৃহকোণে
লেখার টেবিলে ঝুঁকে বই পড়া কিংবা কবিতার পঙ্ক্তিমালা
রচনার ধ্যানকালে অথবা যখন প্রিয় বন্ধুমণ্ডলীর
গুলজার আড্ডায় বেজায় মশগুল কিংবা চেনা শ্যামলীর
ওভারব্রিজের ভিড়ে হেঁটে যাই, কবি-সম্মেলনে এক কোণে
চুপাচুপ বসে থাকি, সে-ডাক আমাকে আচমকা
ভীষণ চমকে দেয়। এ-ও জানি, একদিন এই ডাক এমন অমোঘ,
দুর্নিবার হবে, গাঢ় অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হবো আত্মসমর্পণে!