কল্যাণের বাঁশি
মাইল মাইল পথ পেরিয়ে এসেছি ক্লান্তি নিয়ে
ঘর্মাক্ত শরীরে এই বৃক্ষতলে। জনশূন্যতায়
জায়াগাটা থমথমে খুব, দাঁড়াবো কি
আবার এগিয়ে যাবো সামনের দিকে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো
বেজায় কঠিন হলো। শঙ্কা বৃশ্চিকের মতো করছে দংশন
ক্রমাগত আমাকে, ধোঁয়াটে মনে হয় সবকিছু।
আমাকে ডাকছে ধুধু পথ, কাছে টানছে সবুজ ঘাস আর
পাখি বলে, ‘যেও না পথিক কোনওখানে,
এখানেই বিশ্রামের স্থান বেছে নাও, পরে রাঙা সূর্যোদয়
তোমাকে দেখাবে পথ। পাখির গানের মতো কথা
আশার কুসুম স্নিগ্ধ সুরভি ছড়ায় মনে। বসি বৃক্ষতলে।
এখানেই এই বিয়াবানে অন্ধকারাচ্ছন্ন নিশীথের কাছে
কী পাবো প্রার্থনা করে? নিদ্রা লুট হয়ে যাবে বিচিত্র আওয়াজে,
অমূলক নয় দুর্ভাবনা, দূর নদীতীর থেকে
কোনও গূঢ় বার্তা আসবে না জানি, তবু
অমাবস্যা-রাতে চেয়ে থাকি, যদি শোনা যায় কিছু, যদি
কারও পদধ্বনি বেজে ওঠে রুক্ষ পথে।
অকস্মাৎ আমার হৃদয়ে জাগে অন্ধকার হননের গান
আর এই বিরানায় নিমেষেই চন্দ্রোদয় হয়
রাজসিক ভঙ্গিমায়। অশুভের ডঙ্কা যত জোরেই বাজুক,
কল্যাণের বাঁশি আমি বাজাবো নিশ্চিত সুন্দরের তালে তালে।
১৩.১২.২০০০
কিছু বাতিল কাগজ
প্রায়শই খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে বসাই নিজেকে
বিভিন্ন আসনে আর স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। নানা কোণ
থেকে দেখি নিজেকে, আবার জুড়ে দিয়ে
আমার আমাকে খুব কাছ থেকে সম্পূর্ণ সত্তার
আসল আদলটুকু নিবিড় পরখ
করে নিই অভিজ্ঞ দর্জির ভঙ্গিমায়।
এই যে লোকটা আমি হামেশাই বসে থাকি সামান্য চেয়ারে,
বই পড়ি, খবরের কাগজে বুলাই চোখ আর
অনেক সফেদ পাতা পঙ্ক্তিতে সাজিয়ে তুলি গভীর নিষ্ঠায়,
যখন আমার দিকে দৃষ্টি দেয় কেউ কেউ, তারা বিস্ময়ের ঢেউয়ে
ঢেউয়ে নড়ে ওঠে, কেউ কেউ ঠোঁট নিপুণ বেঁকিয়ে
উপেক্ষার হাসি হেসে দূরে সরে গিয়ে বড় স্মার্ট ভঙ্গিমায়
হাঁটে, এই আমার ভেতরকার লোক
মাথার গভীর হ্রদে কিছু রঙিন মাছের খেলা মাঝে মাঝে
অনুভব করে লালনের তরিকায়-সেইসব মাছ কোন্ জাদুবলে
কবিতার পঙ্ক্তিরূপে খুব সন্তরণপ্রিয় হয়ে ওঠে।
অন্ধকার কাঁকড়ার মতো মতো হাঁটে চতুর্দিকে, তবু আলো খুঁজি,
যেমন নদের চাঁদ ঘুরে বেড়ায় একলা শূন্য নদীতীরে
আর বনবাঁদাড়ে ব্যাকুল মহুয়ার খোঁজে চোখে চোখ
রাখার সুতীব্র পিপাসায়। কণ্ঠ বিশুষ্ক ভীষণ।
মাঝে মাঝে কী বৈশাখে কিংবা মাঘে সামাজিকতায়
বড় বেশি মেতে উঠি। এ আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তবু কেন
এভাবে কাটাই ঢের সময়, বুঝি না। কখন যে
নিজের ভেতর ঘটে বিস্ফোরণ, কেঁপে উঠি ভয়াবহভাবে।
পরমুহূর্তেই ঠিক অদৃশ্য রবারে মুছে ফেলি খুঁটিনাটি
অতি দ্রুত। নীরবে টেবিলে ঝুঁকে কবিতার খাতা
খুলে বসি, মনের ভেতরে
কখনও ভ্রমর করে গুনগুন, কখনও বা জোনাকিরা জ্বলে
আর নেভে। ভিন্ন লোক হয়ে কলমের প্রভুরূপে স্বর্গে
মর্ত্যে করি বিচরণ, কীভাবে? নিজেরই জানা নেই।
মাঝে মধ্যে কাটাকুটিময় কিছু শব্দ-উঁকি-দেয়া
কাগজ বাইরে ফেলে দিই দূরে দারুণ হেলায়। মনে হয়, মনে হলে
তৃপ্তি পাই, সেসব কুড়িয়ে নেন অনন্তযৌবনা একজন অগোচরে-
সে রূপসী, সদাসঙ্গী যার অপরূপ বীণা আর সাদা হাঁস,
বাতিল কাগজগুলো ফুল-কুড়ানোর মতো করেন সঞ্চয়
আগামীকালের কোনও কবির ব্যাকুল অঞ্জলিতে তুলে দিতে।
কোকিলের কঙ্কাল কুড়াই
উড়ে উড়ে বহুদূরে পাখির ডানার সুরে সুরে চলে যাই
কোথায় মেঘের খুব নিরিবিলি অন্দরমহলে-
‘ও ভাই, কে আছো’ বলে ডাকি। মেঘেদের
গহীন ভেতরে ডাক পৌছে যায়, অনুমান করি; তবু কেন
পাই না তিলেক সাড়া কারও। এখানে তো পাখিদের
ঝাঁক নেই, সুরের আনন্দধারা বইবার নেই অবকাশ।
উড়ে উড়ে নিত্য মেঘে থাকা, বাসা বাঁধা অসম্ভব
মনে হয়; বস্তুত অপ্রতিরোধ্য মাটির অহ্বান চিরদিন-
কাজ সেরে বাড়ি ফিরে বাজানো কলিংবেল, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা,
শিশুর অম্লান আলিঙ্গন, জানালার শিক ধরে
গোধূলির রঙ দেখা ভালো লাগে। অকস্মাৎ গলির সুন্দর
কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিধন-পর্বের জন্যে, পড়শিনী মহিলার সদ্য
সন্তান-হারানো আর্তনাদ আমাকে বিমর্ষ করে।
তবু ধোঁয়া-ওড়ানো চায়ের পেয়ালায় চুমু দিই, কবিতার
বই খুলে বসি, উড়ে উড়ে বহুদূরে গোধূলি-মেঘের দিকে
চলে যাই, মেঘবালাদের সঙ্গে কেলিপরায়ণ হয়ে উঠি।
ওলো মেঘ, ওরে মেঘ, বল তো এমন
কী পাই তোদের কাছে? তবে কেন এই শেষবেলা
উড়ে উড়ে চলে যাই বারবার তোদের সান্নিধ্যে? বল কেন
এমন কাঙাল আমি মাঝে মাঝে মনে হয়, এই তো শুনছি
তোদের মোহিনী ডাক, ভাবি, এই বুঝি ঢুকে গেলি
আমার ভেতর আর এমন ধারণা হয়, মেঘের রেশম,
গোধূলি-বিচ্ছুরণে অকৃপণ ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে যাবে শূন্যলোকে।
এই বয়সেও খুব ঝুঁকে কত কিছু গড়ি, ভাঙার খেলাও
কিছু কম খেলি না বিবাগী ঝোঁকে-ভগ্নাংশের কথা
ভেবে খেদ জাগে না কখনও। মাঝে মাঝে নিরুদ্বেগ,
নিঃস্পৃহ ওড়াই ছাই, কোকিলের কঙ্কাল কুড়াই।
২০.৯.২০০০
ক্ষ্যাপা হয়ে
যখন কবিতা আসে আমার নিকট ভালোবেসে
রূপসী মাছের মতো হৃদয়ের জলে,
আমি তো থাকি না আর স্বাভাবিক; কেমন উতলা
হয়ে যাই, বুঝি বা গানের সুরে মাতাল বাউল-রূপ ধরি।
আমি আর একতারা একাত্ম যেন বা,
বেজে উঠি; গাছের সবুজ পাতা, আসমানী নক্ষত্রেরা বাজে।
যখন কবিতা পদযুগ রাখে না আমার আখড়ায় কোনও
অভিমানে, আউলা বাউলা
হই না তখন আর, আতশবাজির মতো আর
ফুটি না, উঠি না জ্বলে। বেনামি আন্ধারে
ডুবে থাকি অষ্টপ্রহর; আমি তো
আগের মতোই ক্ষ্যাপা হয়ে নেচে গেয়ে আসমান ছুঁতে চাই।
২০.১২.২০০০