একান্নবর্তী
একজন বুড়ো শুধু
কাশতে থাকেন,
একজন নারী ভোরে,
বাসন মাজেন,
একজন আধবুড়ো
দূরের দপ্তরে যান,
গোসলখানায় কাঁদে
ফুটন্ত তরুণী।
একজন যুবা জেবে
পুরে নেয় রোদ,
মাছে গোধূলির রঙ
চেটে নেয় জিভে,
এবং দু’চোখে তার
বার বার দোলে
অগণিত পিটিশন,
গোলাকার দড়ি
৫.২.২০০১
এবং উঠোনে মুমূর্ষু কবুতর
(মোহাম্মদ আবুল কাশেমের উদ্দেশে)
দিনরাত বছরের পর বছর এভাবে বিছানায়
সেঁটে থাকা, সামান্যই নড়াচড়া, মানে
অন্যের সাহায্যে শুধু এপাশ ওপাশ করা, ওঠা
কিংবা বসা নেই এতটুকু। এভাবেই ওষুধের,
ডেটলের এবং নিজের অস্তিত্বের দুঃসহ গন্ধের মধ্যে যাচ্ছে বয়ে
দিনগুলো, রাতগুলো। জীবনসঙ্গিনী যিনি, তার
শুশ্রূষা, সংসার চালাবার
নাছোড় সংগ্রাম এই অক্ষম আমার বড় শুষ্ক হৃদয়ের
জমিনে শিশিরবিন্দু ঝরায় নিয়ত। তার দিকে
অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, বলি না কিছুই।
না, এভাবে আর শয্যাবন্দি থাকবো না, এবার আমার
গাঝাড়া দেয়ার পালা। এইতো বিছানা থেকে নেমে
দাঁড়িয়েছি সটান মেঝেতে, দিব্যি হেঁটে যাচ্ছি একা
বাড়িটার কৃপণ বাগানে, জনাকীর্ণ ফুটপাতে। কতকাল
দেখিনি এসব দৃশ্য, এসব দোকানপাট, শুনিনি ভিড়ের
কোলাহল, স্রেফ ভুলে ছিলাম মোটরকার, বাসের গর্জন।
কী আশ্চর্য, এই তো উড়ছি আমি নীল আসমানে, ভাসমান
মেঘ চুমো খাচ্ছে বারবার আমাকে এবং নিজে
হচ্ছি রেশমের মতো মেঘ হচ্ছি বাতাসের মিহি ঢেউ; লাল,
নীল, সাদা, সবুজ, হলুদ পাখি হচ্ছি, অবিরত
ফুটছি গোলাপ, পদ্ম হয়ে, ঝরাছি বকুল হয়ে
চকিতে কোথাও। আমি আর আমি নই, অন্য কেউ একজন।
তোশক-বিছানো খাটে ভয়ানক সাঁটা নই, নই স্থাণু, নানা
ওষুধের গন্ধ আর করে না পীড়ন দিনরাত, ভালো করে
তাকাও আমার দিকে, আমার শরীরে
নক্ষত্রপুঞ্জের দ্যুতি, আমি অবিকল ডানাঅলা
দেবদূত। যখন যেখানে ইচ্ছা যেতে পারি অনায়াসে, কেউ
পারে না রুখতে গতি। হঠাৎ আমার এ কী হলো!
কোথায় অমল ডানা? সেঁটে আছি পুরনো চাদরে, অপরাগ
শয্যাত্যাগে, নানাবিধ ওষুধের ঝাঁঝাঁ গন্ধে স্বপ্নের পরাগ
ঝরে যায়, সুদূরের মেঘ শুষে নেয়
হায়, দেবদূতের মহিমা আর উঠোনে মুমূর্ষু কবুতর।
১১.৭.২০০০
ওরা দু’জন
একটি নাজুক ছোট বাড়িতে বুড়োবুড়ি
করতেন বসবাস। সন্তানসন্ততি
ছিল না তাদের কেউ। দু’জনের সীমিত সংসার
আনন্দের মধুর রোদ্দুর চাঁদিনীতে
ছিল উদ্ভাসিত, জানতাম পড়শিরা। কীযে ভালো
লাগতো তাদের দেখে দূর থেকে। কখনও সখনও
যেতাম তাদের কাছে, গল্পসল্প হতো,
পুরনো দিনের কথা রূপায়িত হতো চায়ের বাটিতে বেশ।
দু’জনের সংসার চলতো জানি প্রবীণের শেষ পেনসনে।
শুনিনি তাদের মুখে সামান্য নালিশ, নিন্দা কারও।
ভাসতেন দু’জন তৃপ্তির সরোবরে। কালো রাতে
বিছানায় দু’টি প্রাণী থাকতেন পরস্পর জড়াজড়ি করে
আর অতীতের কিছু স্মৃতি সুকান্ত পাখির মতো
উড়ে উড়ে ঘুরতো, গাইতো গান মনের প্রসন্ন গোধূলিতে।
কখনও বা পূর্ণিমা চাঁদের রোশনিতে
পড়তো ওদের মনে নিজস্ব যৌবন।
একদিন সে প্রবীণ নিলেন বিদায় জীবনের সুমধুর
সব কলরব থেকে, আর নিঃসঙ্গ সে বৃদ্ধা নিষ্প্রদীপ
ছোট ঘরটিতে রাতে বিছানায় জলভেজা চোখে
কী বিপুল শূন্যতাকে আক্রোশে করেন আলিঙ্গন।
১৫.১০.২০০০
কখনও ঝরাবে অশ্রু, কখনও আগুন
এই তো হৃৎপদ্ম আমাদের বারবার
দুলে ওঠে সুর হয়ে, দুলে ওঠে লালন সাঁইয়ের অনুপম
গান হয়ে। নিশ্চিত জেনেছি ছেউড়িয়া
নয় শুধু রুক্ষ জমি কোনও, নয় একটি ভরাট নদী ধুধু,
বৃক্ষহারা করুণ বিবর্ণ মরু নয়।
ছেউড়িয়া লালনের আপন হৃদয়,
ছেউড়িয়া অগণিত বাউলের পূণ্য ধ্যানভূমি। ছেউড়িয়া
আমাদের সবার অন্তরে ফোটা অনন্য গোলাপ।
ভয়ঙ্কর তরিকার মুখ দেখি প্রশান্তির নির্মল আসরে,
বাউল-তাড়ানো সন্ত্রাসের জন্ম হয়
ভাড়াটে লেঠেল আর অস্ত্রবাজদের অতিশয় ন্যাংটো, ক্রূর
হামলায়; লালনের গান আর একতারা করে আর্তনাদ।
আমাদের গোলাপের বুক থেকে রক্ত ঝরে কোদালের ঘায়ে,
প্রবীণ বৃক্ষেরা ভূলুণ্ঠিত। লালনের স্মৃতিসৌধ অচিরেই
ভিন্ন উঁচু দালানের গ্রীবা জিরাফের মতো শেষে
ফেলবে কদর্য ছায়া। লালন সাঁইয়ের একতারা
এতকাল পরে ফের প্রকৃত বাজবে নিদারুণ
অপমানে, ক্ষোভে, শোকে; বেদনার সুর
প্রকৃতিকে বড় বেশি করবে করুণ। এক, দুই, তিন, চার,
হাজার হাজার প্রতিবাদী একতারা
এবং দোতারা ভোরবেলা, বিষণ্ন দুপুরে, রাতে
কখনও ঝরাবে আশ্রু কখনও আগুন।
৯.১১.২০০০০
কত অগ্নিবলয় পেরিয়ে
একদা আমারও ছিল জ্বলজ্বলে যৌবনের কাল। যৌবনের
প্রত্যুষে ভেবেছি, হেসে খেলে,
খাতার সফেদ পাতা জুড়ে মাঝে মাঝে
সযত্নে সাজিয়ে কিছু শব্দের মিছিল
রঙিন সিল্কের মতো কেটে যাবে মসৃণ আমোদে
জীবন আমার বসন্তের পুষ্পঘ্রাণে, প্রেমঘোরে।
তখন ভাবিনি মোটে জনকের প্রশ্রয়, আশ্রয়
কত ক্ষণস্থায়ী, কত খটখটে, নিষ্পৃহ, নির্দয়
পরিবেশ; প্রতি মোড়ে ছদ্মবেশী আততায়ী ওঁৎ পেতে থাকে
কুটিল সংঘের নির্দেশনা প্রশ্নহীন, শর্তহীন মেনে নিয়ে
প্রতিবার। ঢের ঝড়জল
বয়ে গেছে মাথার ওপর আর বহুরূপী ভর্ৎসনা, যন্ত্রণা
সইতে হয়েছে নানা মহলের। অথচ নিজস্ব বিশ্বাসের
মাটি থেকে আজ অব্দি এক চুলও দাঁড়াইনি সরে।
বারবার কত অগ্নিবলয় পেরিয়ে
এসেছি ঝল্সে-যাওয়া দেহমন নিয়ে। যন্ত্রণায়
হয়েছি কাতর সত্য, অথচ কখনও নিরাশার পাখসাটে
যাইনি তলিয়ে পাতালের
অতল তিমিরে। শুভ আলো, যত ক্ষীণ হোক, পথ
দেখিয়ে এনেছে প্রতিবার; দেহ মনের জখম সেরে গেছে
ফুল, পাখি, শুকতারা এবং নারীর শুশ্রূষায়। কণ্টকিত
পথে হাঁটা এখনও হয়নি শেষ, রয়ে গেছে ঢের
ধূর্ত ফাঁদ আর অগ্নিবলয় এখনও। পারবো কি
অভীষ্ট সে বৃক্ষের অনন্য
ছায়ায় দাঁড়াতে, বোধি যার নাম? অন্ধদের ভিড়ে
পারবো কি নির্ভয়ে করতে উচ্চারণ আলোকিত কথামালা?
এখনও হাঁটছি দ্যাখো, হেঁটে যেতে হবে, যতই নামুক চোখে
ক্লান্তির কুয়াশা আর ছায়ারা দেখাক ভয়। এই তো অদূরে
প্রতিভাত ঝলমলে সরোবর গোধূলিতে, অপরূপ এক
নীলপদ্ম বুক খুলে দুলছে সেখানে
ছড়িয়ে প্রশান্ত আভা। পারব কি তুলে নিতে ওকে
সরোবর থেকে? হায়, আমি তো ভুলেও
শিখিনি সাঁতার কোনওকালে। বাস্তবিক
নিয়মিত তীরে এসে তরী ডোবা আমার নিয়তি।
১০.৮.২০০০