একজন প্রৌঢ়, তিনটি পুস্তক
কেমন ধূসর কাল নিশ্চিন্তে করছে গ্রাস সময়কে আর
ঘন অন্ধ কুয়াশায় চকিতে হারায়
যৌথ আর্তনাদ; ইদানীং
ভীতিচিহ্নগুলো ক্রমে প্রকট ভঙ্গিতে ছোট বাসগৃহটির
দরজা জানালা জুড়ে দাঁড়ায়, ওদের চাউনিতে তুষারের
শীতলতা জমে থাকে। দোর থেক ফিরে যায় উদাস বাউল।
ছোট বাসগৃহটিতে বসে আছেন যে প্রৌঢ়, তাঁর
মনে হলো, শহর ধূসর এক চাদর জড়িয়ে বসে আছে
শহরের অন্য কোনওখানে ভ্রমণে যাওয়ার বড়
সাধ সেই কবে থেকে, অথচ চলৎশক্তি নেই এতটুকু,
সেহেতু নিশ্চল, জবুথবু বসে আছে; রোজ নানা
পীড়ন সইছে মুখ বুজে আর অসহায় দেখছে কত না
দারুণ ইঁদুর-দৌড় চৌরাস্তায়, অলিতে গলিতে,
তিনটি পুস্তক, সম্ভবত কবিতার, মরালপ্রতিম উড়ে
আসছে পৌঢ়ের দিকে। ওদের অস্তিত্ব থেকে ঝরে
এক্তাপ্লুত বেদনার সুর, বুঝি কোনও তীরন্দাজ
তিনটি পাখির বুক ভেবে ছুঁড়েছিল তীক্ষ্ম শর। এখন তো
আহত পুস্তকগুলো ইতস্তত ধুলোয় থাকবে পড়ে, পৌঢ়
লিখবেন এলিজি; কাঁদবে ঘাস, প্রজাপতি এবং আকাশ।
২২.১১.২০০০
একটি ধূসর বক
কে হে তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো? আমাকে দেখাচ্ছো ভয় এই
থমথমে সন্ধ্যেবেলা? আমি তো শহুরে
একজন; দিনরাত হট্রগোল, আবর্জনা আর
বিষাক্ত ধোঁয়ার নিপীড়নে
ধুঁকছি বেজায়। ফুসফুস কাবু খুব, বহুরূপী সন্ত্রাসের
অবাধ দাপটে, হায়, ঘরে কি বাইরে
টেকা দায়, জেনেছি বোবার শক্র নেই,
সহজে খুলি না মুখ তাই, ফুঁসি মনের গহনে।
কী খেয়াল হলো, অকস্মাৎ বহুদিন পর ছুটে
গেলাম আপন গ্রামে শান্তির সন্ধানে। বিকেলের
শান্ত রোদে নৌকায় ভ্রমণ করি ছোট নদীবুকে। চোখে পড়ে,
একটি ধূসর বক দাঁড়ানো শান্তিতে ডোবা চরে
ধ্যানীর ধরনে একা, যদিও রয়েছে মনে মাছ
শিকারের আশা ক্ষুধা নিবৃত্তির খাঁখাঁ প্রয়োজনে।
হঠাৎ কোত্থেকে এক জাঁহাবাজ গুলি ছুটে এসে
নিঝুম ধূসর বকটিকে কী ভীষণ রাঙা করে দেয়।
টাটকা, সুস্বাদু মাছ শিকারের প্রয়োজনে উড়ে-আসা পাখি
নিজেই শিকার হলো শেষ বিকেলের রোদে। তাজা
গুলির কর্কশ শব্দ, ধোঁয়া, ছোট্র প্রাণীর বুকের রক্তধারা
স্বরণ করিয়ে দেয় পাড়াগাঁর গোধূলিতে শহুরে সন্ত্রাস।
৬.৮.২০০০
একটি বিস্মৃত নাম
বুড়োসুড়ো লোক, প্রতি রাতই প্রায়
নির্ঘুম কাটে শয্যায়। দিনে মাঝে মাঝে ঈষৎ
ঝিমুনি ধরে আর নানা হিজিবিজি ভাবনা
হাতকড়া পরিয়ে, শেকলে বেঁধে বৃদ্ধকে
দিব্যি মজা লোটে। কিছুকাল আগেও তিনি কবিতার
নানা রঙের চমৎকার সব ঘুড়ি
উড়িয়ে দিতেন নীলাকাশে। অনেকে বাহবাও দিতো,
এরকম গল্প চালু আছে প্রবীণদের মহলে।
আজ বুড়োসুড়ো লোকটা স্থবির, সকল
উচ্ছল চাঞ্চল্যের বাইরে বসে কখনও ঝিমোয়,
কখনও বা অতিশয় ঝাপসা দৃষ্টিতে আশেপাশে কী যেন
খোঁজে। কখনও কখনও ওর মানস-হ্রদে
ভেসে ওঠে একটি কি দু’টি স্মৃতিসিক্ত মুখ, কোনও
জ্বলজ্বলে নেশা-ধরানো শরীর। তাদের নাম
ঘন নীরবতা ও মধুর সুরে আবৃত্তি করে বৃদ্ধকে আচানক
চম্কে দিয়ে। একটি কটমটে, রাগান্বিত মুখের চক্ষুদ্বয় বিষ ছড়ায়।
বুড়োসুড়ো লোকটা সেই কটমটে মুখের নাম মাথা কুটেও
স্মরণের চৌহদ্দিতে আনতে অপারগ। দারুণ
অস্বস্তিতে কাটে তার অনেক প্রহর। সেই রোষদগ্ধ চেহারার
অধিকারী বহুকাল আগেই পৃথিবীর রৌদ্রজ্যোৎস্না থেকে
সরে গেছেন চিরতরে। বুড়োসুড়ো লোকটা যৌবনে সেই অপ্রসন্ন,
প্রায় ক্ষ্যাপাটে ভদ্রলোকের জীবনসঙ্গিনীর দেহ-সরোবরে
ডুবসাঁতার কেটেছে, এই অমূলক ধারণা নিয়েই
দুনিয়া থেকে মুছে গেছেন। আসল সাঁতারু কে ছিল তা কি
তিনি জানতে পেরেছিলেন কোনওদিন? কানাঘুষোর
সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচয় ছিল নিরপরাধ যুবকের, অর্থাৎ আজকের বৃদ্ধের।
বুড়োসুড়ো লোকটা রুষ্ট ভদ্রলোকের কুমারী গৃহিণীর
হৃদয়পদ্মের সুরভিতে সত্যি মজেছিল জ্বলজ্বলে যৌবনে,
কিন্তু তাকে সর্বক্ষণ ভুল শনাক্ত করেছে
ঈর্ষাকাতর স্বামী, অপরের দস্যুতা তার সত্তায় আরোপ করে
নিজে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে বারবার। আজো তার
জ্বলন্ত দৃষ্টিময় চেহারা মনে পড়ে বৃদ্ধের, যদিও বিস্মৃত নাম।
১৫.৬.২০০০
একটি হাট-করা দরজা
দরজাটা হাট-করা। ওর চারপাশে গিজগিজে ভিড়,
ভেতরে যাওয়ার জন্যে সবার কী হুটোপুটি। এ ওকে কনুই দিয়ে
ধাক্কা দিচ্ছে, কেউবা পাশের লোকটিকে আচমকা মারছে ল্যাঙ।
কেউ কেউ ক্রোধে চুল্লীর আগুন, কারও কারও ইতর বুলি শুনে কানে
দু’হাত চেপে ধরতে ইচ্ছে করে আমার। গুঁতোগুঁতির ভয়ানক এক প্রতিযোগিতায়
ক্লান্ত সবাই, কিন্তু প্রত্যেকেই দরজা পেরুতে
নাকাম। এই হট্ররোলের মধ্যে লক্ষ করি, একটি অজগর কারুকাজময়
দরজা আগলে দাঁড়ানো। দরজার সামনে গিয়ে প্রচণ্ড
আঁৎকে ওঠে লোকগুলো, পড়িমরি করে পিছিয়ে আসে।
আস্তে-সুস্থে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ভিড় এড়িয়ে। খানিক
এগুতেই চোখে পড়ে দরজার পাশে দুলছে অনুপম রমণীয়
দুটি হাত, যেন আমাকে বরণ করে নেয়ার চাওয়া দশটি
সরু আঙ্গুলে আঙ্কিত। অজগরটিকে দেখতে পাচ্ছি না,
কোথাও যেন কোনও যদুবলে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে নিমেষে।
প্রতিবন্ধকহীন প্রবেশ করি ভেতরের দরজা পেরিয়ে; ভেতরকার
দৃশ্য বর্ণনা করার ভাষা আমার অজ্ঞাত। মুগ্ধতা আমাকে
মূক করে ফেলে এক লহমায়। অপরূপ সৌন্দর্যের এমন
প্রকাশ ইতিপূর্বে বাস্তবে কি স্বপ্নে চোখ মেলে আমার দেখা
হয়নি। কী করে এক হর্ম্য, এক উদ্যান পেরিয়ে এলাম তা জড়ানো
থাক রহস্যময়তায়, এই শব্দগুচ্ছ কে যেন আমার কানে
আতরের তুলোর মতো গুঁজে দেয়। সেই শব্দরাজির নির্দেশ
অমান্য করা আমার সাধ্যাতীত।
কী করে সেই বন, সেই কাঁটা-বিছানো পথ, হাট-করা সেই
দরজা, হর্ম্য, উদ্যান থেকে ফিরে এলাম আপন ঘরে, বলতে
পারবো না। তবে ঘরে ফিরে আসতেই আমার হাতের
তিন আঙুলে বিদ্যুচ্চমক, পাহাড়ি ঝর্ণার গান। বহু দিন ধরে
বন্ধ্যা পড়ে-থাকা আমার খাতা গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে অজস্র
রঙধনুরূপী শব্দের মিছিলে।
১৫.৫.২০০০
নোআজিএল (প্যারিস)