আমি তো ডুবুরি নই
আমি তো ডুবুরি নই, তবুও সমুদ্রে ডুব দিই ঘন ঘন।
ঢেউয়ের প্রহারে ক্লান্ত হই, মাঝে মাঝে ভয় হয়
হয়তো হাঙর এসে কেটে নেবে আলগোছে পা দুটো আমার,
তবু সমুদ্রের তলদেশ বারবার ছুঁতে খুব ইচ্ছে হয়।
আমার অজানা নয় এই ডুবে ফের ভেসে ওঠার কারণ-
অন্তরে রেখেছি পুরে বাসনার একটি ভ্রমর,
অপরূপ গুঞ্জরণ যার দেয় না সুস্থির হতে
কখনও আমাকে। আমি চাই সমুদ্রের তলদেশে
আন্দোলিত লতাগুল্মেলগ্ন কিছু মুক্তো তুলে নিতে-
আজীবন এই তো আমার সাধ এবং সাধনা।
১০.১২.২০০০
আমি থাকি আমারই ধরনে
আমি থাকি আমারই ধরনে; কারও ভাবনার ছাঁচে
কখনও পড়ি না ধরা, অনুমান করি। একটি সংসারে আছি
বহুদিন, অথচ সংসারী নই। নিয়ত বাজাই
আত্মলোপী একতারা, তবু বাউলের আলখাল্লা অদ্যাবধি
করিনি ধারণ অঙ্গে। আকাশের চাঁদ হাতে আসে
মধ্যরাতে, তারার নূপুর বাজে ঘরে নিস্তব্ধ প্রহরে মাঝে মাঝে।
আমার সংকেতে, কিন্তু যাদুকর
আমাকে যাবে না বলা কোনও মতে, এমনই তরিকা অধমের
আমার বাড়ির কাছে অদূরে দাঁড়ানো গাছে সবুজ পাতার
সমারোহ দেখি, ঝরা পাতার নীরব কান্না শুনি
কখনও চলার পথে, কষ্ট পাই। পথের কিনারে অসহায় একজন
যখন দাঁড়িয়ে থাকে, বেদনার্ত হয় মন। মনে হয়, সমস্ত শহর
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে এতিমের মতো। ঘরে ফিরে
কবিতার খাতা খুলে বসি, পঙ্ক্তিমালা টেনে আনি
মেঘ, রোদ, পাখি আর মানুষের মুখ থেকে, ওরা
কবি বলে আমাকেই, অথচ বলে না কেউ কেউ।
১২.১২.২০০০
আরোগ্যনিকেতনে একা
ভাসমান মেঘে মেঘে উড়াল আমার,
সকল সময় নয়, প্রায়শই। সবুজ পাতার ঘ্রাণে বুঁদ
হয়ে থাকি কখনও কখনও; মাঝেমাঝে
নদীর গভীর অন্য গভীরতা খুঁজে বিয়াবান
চর ছুঁয়ে ফেলি, মৃত সারসের পুরনো পালক
ধরায় কেমন নেশা! অসুস্থতা ভর করে হঠাৎ কখন,
বোঝা দায়, অন্তর্গত ঝাঁঝ নিভে যেতে চায়,
হাড়-হিম-করা হুহু হাওয়ায় কী যেন ভেসে আসে অতিদূর
থেকে, অস্তিত্বের নড়বড়ে কাঠামো বেদিশা বড়, কেউ নেই
ধারেকাছে, শুশ্রূষায় প্রকৃত হাতের স্পর্শ নেই এতটুকু,
ধূ ধূ শূন্যতায় ঝুলে থাকি। অসীমের ফিসফিস চতুর্দিকে।
কেমন আবছা পদধ্বনি, না-দেখা মানব-মানবীর কিছু
একান্ত ঝাপসা কণ্ঠস্বর, অতি-ব্যবহৃত
রোগীর শয্যায়, রাত তিনটায় ওয়ার্ড নিঝুম অতিশয়,
আমি একা পড়ে আছি বেগানা শবের মতো শীতল, নির্ঘুম,
কপালে কাঙ্ক্ষিত কোনও কোমল হাতের স্পর্শ নেই,
বোবা অন্ধকারের মশারি
আমাকে রয়েছে ঘিরে, জানি না কেমন ভোর ছোবে
আমাকে আবার, না কি পাবো না কখনও আর রৌদ্রের চুম্বন।
অন্ধকারে বিষকাঁটা ক্রমশ গজাতে থাকে শরীরে আমার,
ইচ্ছে হয় ভীষণ চিৎকারে স্তব্ধতাকে
গুঁড়ো করি কাচের মতোই, রোগীদের
কথা ভেবে চুপচাপ বেডে পড়ে থাকি।
কী আমার ব্যাধি? কোন্ জীবাণু আমার রক্তে ক্রিয়াপরায়ণ
তোমরা কি বলে দেবে আমাকে এখন
এমন নিঃসঙ্গ প্রহরের ঠাণ্ডা, অন্ধ স্তব্ধতায়?
কেবলি বাড়ছে যন্ত্রণা, এ কেমন আরোগ্যনিকেতন?
২০.৫.২০০০
নোআজিএল (প্যারিস)
ঈগল
অগোছালো টেবিলে ছড়ানো
কয়েকটি বই, খাতা আর
একটি কলম, শূন্য ধুধু
চেয়ার, দড়িতে ঝোলে শার্ট,
দেয়াল পোস্টারে সুসজ্জিত;
সূর্যাস্তের মুমূর্ষ আলোয়
ঘরের বাসিন্দা ফিরে আসে,
গুলিবিদ্ধ নিষ্প্রাণ ঈগল।
৫.২.২০০১
ঊনত্রিশ বছর পরেও
ঊনত্রিশ বছর পরেও এ কেমন বিবমিষা মৃত্তিকার?
ভীষণ বমনে তার নিমেষে বেরিয়ে আসে বিষণ্ন কঙ্কাল-
গুনে দেখা গেল ঠিক আটটি কঙ্কাল ওরা; দূরে
নীল আকাশের দিকে মুখ করে পড়ে আছে পথের কিনারে।
ক’জন উৎসুক পথচারী কাছে এসে ঝুঁকে শনাক্ত করার
অভিলাষে মেতে ওঠে; কারও কারও মনে
প্রশ্ন জাগে, এই আটজন হিন্দু ছিল? কেউ কেউ
মাথা চুল্কে ভাবে,
ওরা কি প্রকৃত মুসলিম নাকি কাদিয়ানী সব? কঙ্কালেরা
নিরুত্তর। অদূরে একটি পাখি গেয়ে ওঠে, ‘মানুষ, মানুষ।
১০.১২.২০০০
এ কেমন অনুভূতি
এ কেমন অনুভূতি বুদ্ধুদের মতো এখন উঠছে জেগে
বারবার অন্তরে আমার এই স্থানে বসে? এখানে আগেও
এসেছি, বসেছি বৃক্ষতলে
শ্বাসনালী শুদ্ধ করে নিতে
নিজেরই অজ্ঞাতে। তাকিয়েছি চারদিকে প্রফুল্ল দৃষ্টিতে; কত
পাখি স্বাভাবিক নৃত্যকলায় বিভোর
ডালে ডালে, সতেজ সবুজ ঘাসে। দর্শকের প্রতি বেখেয়াল
ছিল সেইসব আনন্দিত ক্ষুদ্রকায় প্রাণী সহজ বিশ্বাসে।
ওদের বিশ্বাস আমি কাচগুড়ো করিনি কখনও,
বরং সুস্নিগ্ধ উপভোগে
প্রফুল্ল হয়েছে মন। এখানে তো ছিল কতিপয়
স্মিত, স্বপ্নাতুল গাছ। হায়, আজ নেই, ক্ষীণ গুঁড়ি
রয়ে গেছে বেদনার্ত কঙ্কালের নিঝুম ভঙ্গিতে
অবিকল। হু হু হাওয়া স্মৃতি বয়ে আনে
মর্মাহত আস্তানার; কখনও এখানে ছিল গান, যুগলের
বসে-থাকা, মোটা মিহি কণ্ঠস্বর, ঘনিষ্ঠ আলাপ।
এ কোন্ বেগানা স্থানে আগন্তুক আমি আজ? নিজেকেই খুব
অচেনা লাগছে, যেন আমি নই আমি আর, এই দেহমন
অন্য কারও; ভয় হামাগুড়ি দিতে থাকে
আমার ভেতর; মাথা ঘোরে। মনে হয়,
রুক্ষ ধুলোবালির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি কোনওমতে,
এখন শীতল জলে মুখ ধুলে বেশ ভালো লাগবে আমার।
১৪.১২.২০০০
একজন নিশাচরের ডায়েরি থেকে
সকাল জড়াতে চায় দুপুরকে, দুপুর বিকেলে কী সহজে
মিশে যায় এবং বিকেল গোধূলির ইশারায়
আলিঙ্গনে লিপ্ত হয় সন্ধ্যার সহিত, সন্ধ্যা নিশীথের সাথে
বাসর-শয্যার করে আয়োজন। কতিপয় নক্ষত্র সহজে মেতে ওঠে
মিটিমিটি নিরীহ কৌতুকে। একজন ভবঘুরে মাঠে শুয়ে
ভাবনায় বুঁদ হয়ে আছে। স্তব্ধ গাছে দুটি পাখির প্রণয়।
তিনজন ফতুর জুয়াড়ি হাঁটে ফুটপাতে, রাত
খোঁয়াড়িতে টলে আর অদূরে জানালা খুলে গেলে
একটি উৎসুক মুখ নীরবে কী যেন খোঁজে, ঘুম? না কি
উধাও স্বপ্নের পদধূলি? হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে
নিশীথের বুক, কয়েকটি পাখির ডানার ঝাপটানি
যুগধ্বনি হয়ে ফের নিস্তব্ধতা হয়ে নামে চারপাশে।
একজন অসুস্থ ভিখিরি একা পুরনো পার্কের বেঞ্চে শুয়ে
নির্ঘুম গোঙায়, ভাবে হয়তো টহলদার পুলিশ তাড়িয়ে
দেবে তাকে, যেন সে কুকুর কোনও। একদা সংসার ছিল তারও,
বানে সব কিছু গেছে ভেসে। তিনজন ফতুর জুয়াড়ি এসে
ভিখিরির পুটুলির বিশদ তল্লাশি নিয়ে ফের রেখে দেয়
চরম ঘেন্নায়, আসমানে নক্ষত্রেরা শুধু মিটিমিটি হাসে।
২৬.১.২০০১