মেঘখণ্ড কান্নাময়
এক খণ্ড বেলে মাটি,
মাঝেমাঝে ঢেউ ছোঁয়।
দু’টি পাখি এসে বসে,
ঝাঁঝালো শব্দের ঝাঁপ,
ভেজা মাটি রক্তময়,
একজন পাখি মেঘে,
মেঘখণ্ড কান্নাময়।
৪ ১ ২০০১
মেটামরফসিস
কোথায় আমার ডেরা এখন, কেউ কি আমায় দেবে বলে?
খুঁজতে খুঁজতে দিন তো গেল, রাত্রি হিংস্র জন্তু হয়ে
আমায় খুবলে খেতে থাকে। ঝড়ের চোখে কাঁপছে ধমক।
দেখছি এখন ডানে বামে তফাৎ তেমন পাই না খুঁজে।
অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে ভীষণ দিশেহারা,
সর্পটিকে মালা ভেবে কুড়িয়ে নিয়ে গলায় জড়াই;
কেমন একটা গন্ধ পেয়ে আঁৎকে উঠে ছুড়ি দূরে।
তীক্ষ্ণ কাঁটার ঘায়ে পায়ে রক্ত ঝরে অবিরত।
তবে কি এই রক্তধারা বইবে শুধু? রক্ত-ফোঁটায়
জন্ম নেবে তাজা ক্ষত? চতুর্দিকে ফাঁদ ছড়ানো,
চেনাশোনা মানুষগুলো এক পলকে অচেনা হয়,
দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে, লাঠি মেরে মাথা ফাটায়!
বন্ধুবেশী শক্র থেকে গা বাঁচানো দুরূহ আজ,
কখন কে যে হাসতে হাসতে লুকোনো কোন্ অস্ত্র বুকে
দেবে গেঁথে, পাবো না টের। তাছাড়া ঢের অচেনা সব
হননপ্রিয় লোক তো আছেই রাতদুপুরে ঘাপ্টি মেরে।
গভীর রাতে একলা হাঁটি চেতনপুরের বিজন পথে-
বইতে থাকে মদির হাওয়া; না-লেখা কোন্ পদ্য এসে
আবছা নাচে দৃষ্টিপথে। অর্ফিয়ুসী বংশী শুনি,
আমার সিক্ত ক্ষতগুলো হয় মোহিনী ফুলের কুঁড়ি।
১০.৬.২০০০
রঙধনুর সাঁকো পেরিয়ে
অনেকটা পথ হেঁটে চলার পর
কেন জানি মনে হলো, আমার এই পথপরিক্রমা
আদৌ ঠিক হয়নি। আমি কি তবে
এতকাল ভুল পথে হেঁটেছি? বৃথা এই আয়ুক্ষয়?
পথে এত কাঁটা, চোখা পাথর ছড়ানো,
এত গর্ত মস্ত হা করে আছে গিলে খাওয়ার জন্যে,
এমন গিজগিজে সরীসৃপ, এমন সব বাঁধা
পেরিয়ে পথ চলবো কী করে?
আমি কি তবে এতটা পথ পেরিয়ে আসার পর
ফিরে যাবো নতুন কোনও পথ ধরতে?
সময় তো বেশি নেই। ফিরে গিয়ে
নতুন পথ ধরা সম্ভব নয় আর।
যত কাদার ঢিলই নিক্ষিপ্ত হোক আমার দিকে,
এই পথের শেষ অব্দি হাঁটতে হবে,
যত হিংস্রতাই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুক
আমার ওপর এই গোধূলিতে, চলতে আমাকে হবেই।
চারদিকে সন্ধ্যা নামছে জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে,
ওর মিশমিশে দাঁত ছিন্ন ভিন্ন করছে আমার ধৈর্যকে। হঠাৎ
এক ঝাঁক নক্ষত্র আমাকে ঘিরে জুড়ে দেয় নাচ, ওদের
আলো-ঝরনায় ধুয়ে যায় সব ক্লেদ, ক্লান্তি।
খুব সহজে আলোকিত পথে হাঁটতে থাকি,
আমার কাঁধে কোত্থেকে এক অচিন পাখি এসে বসে
গাইতে থাকে সম্মোহনী সুরে আর হাওয়ার ভেসে ভেসে
এক অপরূপ মালা হয়ে যায় আমার কণ্ঠহার!
জেনে গেছি, এখন থেকে বাস্তবের সব ধুমধাড়াক্কা, খেয়োখেয়ি
থেকে বারবার চলে যেতে হবে সেখানে, যেখানে রাখালের বাঁশির সুর
প্রেমিকের হৃদয়ের ধ্বনি, যেখানে রঙধনুর সাঁকো পেরিয়ে
যাওয়া চলে হাজার হাজার প্রজাপতির বিভায়।
১৫.৯.২০০০
শেষ রাতে
মধ্যরাতে থেকে গাঢ় মধ্যরাতে অবধি নির্ঘুম
কেটে গেছে, আজ আর নিদ্রাপরী চুমোয় নিরিবিলি
ঝরিয়ে দেবে না ঘুম দু’চোখে আমার। চোখ জুড়ে তীক্ষ্ম জ্বালা,
শুকিয়ে আছে গলা। মশারিটা খুলে ফেলি, মশার উৎপাত
বেড়েছে জেনেও, ডেঙ্গু জ্বর ভয়ঙ্কর
বিভীষিকা তৈরী করা সত্ত্বেও সম্প্রতি। তাড়াতাড়ি
লেখার টেবিলে-রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক
পান করি, যেমন মরুর বুকে পিপাসা-কাতর পথচারী।
কিছুক্ষণ বসে থেকে পুনরায় মশারি খাটিয়ে
ঘুমের আশ্রয়ে যেতে চাই। এক ফোঁটা ঘুম নেই; অকস্মাৎ
শেষ রাতে দেখি মশারির ভিতরে তিনটি খুব
উজ্জ্বল নক্ষত্র দূর থেকে ভেসে-আসা বাঁশির অনিন্দ্য সুরে
নেচে চলে অবিরাম। আমি কোনও সুদূর কালের
আদিম লোকের দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকি নিষ্পলক দীর্ঘক্ষণ।
৬.১১.২০০০
সৃজনের ধ্যান
কাদাখোঁচা পাখি এক আমাকে খোঁচায় বারবার
আক্রোশ মেটাতে যেন। এমন বেয়াড়া নিপীড়নে
বস্তুত সুস্থির থাকা অসম্ভর; অথচ মেঘের
অন্তরাল থেকে-আসা প্রগাঢ় আশ্বাসবাণী প্রাণে সহিষ্ণুতা
সর্বদা টিকিয়ে রাখে। কাঁটাময় পথে হেঁটে হেঁটে
পা দুটো রক্তাক্ত হলো সেই কবে; তবুও জোটেনি
আজও কোনও প্রকৃত নিবাস
কোথাও, যেখানে অস্তিত্বের বিকল্প প্রোজ্জ্বল অস্তিত্বকে পাবো।
কম তো হলো না পথ হাঁটা, তবু অন্তহীন পথ
রয়ে যায়, চোখ দুটি নিভে আসে কী এক ভীষণ
ধোঁয়াশায়, নানাবিধ ভৌতিক আওয়াজ, মতিভ্রম মাথা তোলে
চারপাশে, মতিচ্ছন্ন আমি ছুটি দিগ্ধিদিক। হঠাৎ আমাকে, মনে হয়,
নরখাদকের দাঁত গেঁথে ফেলে আর আমি
ভয়ার্ত চেঁচিয়ে উঠি, কিন্তু কণ্ঠস্বর স্তব্ধ অতিশয়। তবু
সেই ক্রূর দংশনের বন্দিত্ব ঘুচিয়ে ঝটকায় ছুটে যাই
বিরানায়। অকস্মাৎ মনে হয়, এই বিভীষিকা দুঃস্বপ্নের ছায়া শুধু।
কোথাও নিবাস নেই, অথচ আমার সৃজনের জন্যে এই
মুহূর্তে একটি ঘর চাই নিরিবিলি। হন্যে হয়ে
খুঁজে মরি চতুর্দিকে, নেই কিছু নেই
কোনও দিকে, শুধু বালিয়াড়ি পড়ে চোখে, দিগন্তের
ধুধু রেখা দেখা যায়, দাঁড়িয়ে রয়েছি বড় একা-
এমন সফেদ শূন্যতায় করতে হবে নিত্য সৃজনের ধ্যান।
৯.১২.২০০০
স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে
নক্ষত্রেরা মধ্যরাতে নৃত্যপর লোকটার নগ্ন আঙিনায়,
অপরূপ নৃত্যকলা তাকে পুরু শয্যার আরাম থেকে টেনে
নিয়ে আসে নক্ষত্রেরা মদির আলোয়। লোকটার চোখে,
শরীরে, হৃদয়ে জ্যোৎস্নাপ্লুত নেশা ধরে, সত্তা তার
ক্রমাগত নৃত্য হয়। লোকটা বয়সী বেশ, অথচ এখন
বয়সের ছাপ যেন ঝরে গেছে নক্ষত্রের গহন চুমোয়।
প্রত্যুষে নিঝুম আঙিনায় ক্লান্ত সে পুরুষ অচেতন, একা
পড়ে থাকে; শিশিরের ফোঁটাগুলো লেগে থাকে ঠোঁটে,
সাদা চুলে এবং ভুরুতে। কেউ তাকে জাগাবে না,
সম্ভবত এরকমই হয়ে থাকে মাঝে মাঝে, মনে হয়। যখন মেলবে
চোখ মিট মিট করে, রোদের ঝালর তাকে স্তব্ধ কলরবে
পৌঁছে দেবে প্রশান্তির দীর্ঘ ঘাটে, চাপা
হাসির আড়ালে বেদনার্ত মেঘ ভেসে
বেড়াবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে, উপোসের কাল দীর্ঘতর হবে।
অসুস্থ সে বহুদিন থেকে, তবু নক্ষত্র-খচিত এক ঘোড়া
তাকে পিঠে নিয়ে তরঙ্গিত নদী পার হয়, মেঘে মেঘে উড়ে
বহুদূরে চলে যায়, খুরের আঘাতে
খুলে যায় হীরার কপাট, তেজী ঘাড় নিয়ে সুন্দর দাঁড়ায়,
কত প্রতিশ্রুতি জ্বলে দু’টি চোখে। ক্ষণকাল পরে
অন্বেষী, উৎসুক সওয়ারকে নিয়ে যায় এক প্রাচীন প্রাসাদে,
যেখানে অপেক্ষমাণ অনেক রহস্যময় পাণ্ডুলিপি,
যারা শুদ্ধ পাঠ আশা করে পথ চেয়ে
রয়েছে নিশ্চুপ, কত যুগ ঝরে গেছে
তাদের অস্তিত্ব ছুঁয়ে। আচানক স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে অসুস্থ মানব।
শহর এখন কুয়াশার চাদর জড়িয়ে গায়ে বসে আছে
আফিমখোরের মতো। অসুস্থ লোকটা
ভীষণ কাশছে বসে কাঠের চেয়ারে, আশেপাশে নেই কেউ,
মাথার ভেতরে তার ভ্রমরের গুঞ্জরণ, মাঝে মাঝে বুকে
মাথা তোলে সূঁচের পীড়ন। লোকে বলে, যেজন জ্বরের তাপে
বকছে প্রলাপ ঘরে কী এক অজানা ঘোরে আর
শারীরিক ঝড় বেড়ে গেলে, যেন কোনও প্রতিশ্রুতি
মনে পড়ে গেল, এই ভেবে তাড়াতাড়ি
খাতার পাতায় দ্রুত নিবিড় ফুটিয়ে তোলে বকুল, গোলাপ;
অনেকেই সেই সৃজনের লীলা দেখে নিজেদের
কথোপকথনে সিদ্ধান্তের আলো জ্বেলে বলে-
অসুস্থতা, ভাবতে প্রলুব্ধ হই, প্রতিভার গূঢ় জন্মভূমি।
২০.১১.২০০০