বনসাই নই
আমি তো প্রকৃত বট, সমুন্নত, বিস্তৃত সবুজ
মাথা; শান্তি আমি সর্বক্ষণ, পরিশ্রান্ত পথিকের
জন্যে নিত্য সস্নেহে বিছিয়ে রাখি ছায়া। নানা পাখি,
এমনকি কীটপতঙ্গের জন্যেও বরাদ্দ আছে নিভৃত আশ্রয়।
এখনও ভালোই আছি, ঝড়ঝাপটা আসে মাঝে মাঝে,
মুষড়ে পড়ি না, মাথা উঁচু রাখি, ছায়া
গুটিয়ে নিই না। আজও বহু লোক এই পথে হেঁটে
যেতে যেতে ক্লান্তির কুয়াশা-মেঘে ঢাকা পড়ে গেলে
পরম নিশ্চিন্তে বসে আমার সবুজ ছায়াতলে, ফিরে পায়
উদ্দীপনা পুনরায়, হেঁটে চলে যায়
যে যার দৃষ্টিতে গন্তব্যের দিকে। প্রকৃত গন্তব্য কোনও, সত্যি,
আছে কি কোথাও? মরীচিকা দেখায় মোহিনী ছবি নানা ঢঙে।
ওরে মন, কূল নাই, কিনার নাইরে এ জীবন-দরিয়ার,
চাকা ঘোরে কুমোরের, কামারের হাতুড়ির ঘায়ে
ঘন ঘন কাঁপে লোহা, প্রগতির ডঙ্কা বাজে দিবসরজনী,
বিজ্ঞানের রথ ছোটে সামনের দিকে,
সানন্দে স্বীকার করি। কিন্তু আমি
টববন্দি বনসাই বনবার খোয়াব দেখি না।
২৮.৯.২০০০
বাড়ি
ঘরদোর,
উঠোন আছে;
মোটা-মিহি কণ্ঠস্বর নেই,
চারদিকে বুনো
ঝোপঝাড় আছে,
শিশুর হাসি-কান্না নেই,
ঘরে তিনটি
ঝুলন্ত বাদুড়।
২ ১ ২০০১
বিরহ
টেবিলে একটি গ্লাশ আর একটি বোতল; গ্লাশ
খালি, বোতলের আর্ধেকটি ভরা। গ্লাশ
সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে বোতলের দিকে, মনে হয়, সেই
যুগ যুগ ধরে
তাকিয়ে রয়েছে। কিন্তু বোতলটি লজ্জায় গ্লাশের
কাছে যেতে পারছে না আর গ্লাশ ভালো করে জানে
পিপাসায় বুক ফেটে মরলেও এক ফোঁটা পানি
কিছুতে পাবে না, যদি কেউ বোতল উপুড় করে
টলটলে পানি শুক্নো গলায় না ঢালে ওর; কিছু
পরে স্থুলদেহী এক লোক টেবিলের কাছে এসে দিব্যি
আয়েশি ভঙ্গিতে বোতলটি শূন্য করে ফেলে আর
বোতল এবং গ্লাশ চেয়ে থাকে পরস্পর বেদনা-কাতর।
২২/১২/২০০০
মধ্যরাতে রেস্তোরাঁয়
মধ্যরাতে রেস্তোরাঁয় কজন যুবক বসে আছে একটি
টেবিল ঘিরে। ওদের সঙ্গী একজন নিশ্চুপ বসে আছেন বহুক্ষণ।
বয়সের ভারে ঈষৎ ন্যুজ তিনি, অথচ চোখ দুটো জ্বলজ্বলে,
তার দৃষ্টি যুগ-যুগান্তরে প্রসারিত। যুবকেরা রেস্তোরাঁকে
আপন করেছে, রেস্তোরাঁ ওদের আপন বিশেষত এই মধ্যরাতে।
যুবকদের কেউ তাত্ত্বিক, কেউ কথাসাহিত্যিক, এবং কেউ কেউ নয়
অনেকেই কবি। আর বয়সের ভারে যিনি ঈষৎ ন্যুজ তিনি
একদা ছিলেন কাব্যক্ষেত্রে অধিরাজ। আজকাল উপেক্ষিত
পাঠকসমাজে, শুধু ক’জনা যুবা তাকে আমল দেয় মধ্যরাতের
রেস্তোরাঁয়। তার কোনও কোনও বাক্যে চমকে ওঠে ওরা।
রাত্রি ডাগর হলে আরও, রেস্তোরাঁয় বেয়ারাদের কেউ কেউ
টুলে বসে ঝিমোয়। টেবিল ঘিরে-বসা আড্ডাধারীদের
টুকরো টুকরো কথা, ঈষৎ ন্যুজ বয়সী লোকটার নীরবতা
ফিকে আলোকে কেমন যেন বাঙ্ময় করে তোলে সবার অজান্তে।
হঠাৎ অনেকগুলো নক্ষত্র আশরফির মতো টেবিলে নৃত্যপর!
যুবকেরা নক্ষত্রগুলো পুঁজি করে অবোধ আহ্লাদে মাতে জুয়োয়।
নির্লিপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি মৃদু হেসে দেখেন ওদের খেলা নক্ষত্র নিয়ে। তিনি
জানেন এই খেলা ক্ষণস্থায়ী; নক্ষত্রেরা নেচে নেচে যুবকদের হাতছাড়া
হবে, ফিরে যাবে নিজ নিজ স্থানে, সাঙ্গ হবে জুয়োখেলা। ওদের
চেতনায় মাথা তুলে ডুবে যাবে বিষাদগীতি। ব্যথিত যুবারা
ঈষৎ ঝুঁকে-বসা প্রবীণের দিকে তাকাবে করুণায়, তারপর যে যার
ধরনে কিছু হরিণসদৃশ পঙ্ক্তি খুঁজবে ভাবনার বশে, যেমন একদা
তিনি করতেন সফল সন্ধান যৌবনে। এই মুহূর্তে মধ্যরাতের
রেস্তোরাঁয় চেয়ার ছেড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজবেন মানস-হ্রদতীরে হাঁস?
১২.১২.২০০০
মনের বাঘের মুখে
ভোরবেলা, দুপুর অথবা রাতে তোমাদের সাথে
জানি না কখনও আর দেখা হবে কিনা, কখনও আবার গোল
হয়ে বসে গালগল্পে মশগুল হবো কিনা-কিছুই জানি না
আজ এ মুহূর্তে দূরদেশে একা একা
দিন কাটাবার কালে। যখন লোকের ভিড়ে থাকি,
বেজায় অসুস্থ আমি ডাক্তারের প্রতীক্ষায় বসে
থাকি রোগীদের ভিড়ে হাসপাতালে, একাকী তোমাদের কথা
ভাবি, মনে পড়ে আরও কারও কথা, গোধূলিমেঘের
কাছে কী-যে চাই, কী প্রার্থনা স্ট্রিট লাইটের কাছে-
নিজেই জানি না। আমি শুধু দৃষ্টিহীন
বালকের মতো অন্ধকার ঘরে একা
ব্যাকুল বেড়াচ্ছি খুঁজে কী-যে,
আমি কি নিশ্চিত জানি? টলতে টলতে যদি মনের বাঘের
মুখের গহ্বরে ঢুকে পড়ি, যাবো কি চকিতে মূর্ছা হট্ররোলে?
২০.১২.২০০০
মহার্ঘ খোরাক
লোকটার আস্তানা বলতে খুব ছোট, ভাঙাচোরা
স্যাঁতসেঁতে এক ঘর। টিনের জখমি ছাদ ফুঁড়ে
বৃষ্টি ঝরে, কখনও আবার পূর্ণিমায় জ্যোৎস্নাকণা
উদার ভঙ্গিতে নামে ঘরের ভেতর। আসবাবপত্র নেই,
একটি বিমর্ষ শার্ট, দোমড়ানো ট্রাউজার ঝোলে
পুরনো দড়িতে আর ক’টি বই নড়বড়ে চৌকিতে ছড়ানো।
লোকটা হাঁপাচ্ছে বটে ষাটের কোঠায়। নানা ব্যাধি
সোৎসাহে ধরেছে ঘিরে তাকে, চিকিৎসাবিহীন থাকে
কখনও আলস্যে আর কখনও বা নাছোড় অভাবে।
পদ্য লিখে জীবন ধারণ অসম্ভব জেনেও সে কবিতার
রূপে মজে অক্লান্ত ছুটেছে তার পেছনে সর্বদা
উড়ন্ত আঁচল দৃঢ় মুঠোয় ধরার জ্বলজ্বলে বাসনায়।
এক টুক্রো শুকনো রুটি অথবা দু’মুঠো ভাত তা-ও
ছড়ায় না ঘ্রাণ সেই ঘরে; শুধু পানি খেয়ে, অন্ত্রে
জ্বালা নিয়ে লোকটা নিশ্চুপ পড়ে থাকে বড় একা
মলিন শয্যায় আর কী আশ্চর্য এ ঘরেই আছে
অদৃশ্য ভাণ্ডার এক উপমা, উৎপ্রেক্ষাময় অজস্র পঙ্ক্তির।
হঠাৎ ক’দিন পর লোকটা হার্টের পীড়া হেতু
প্রাণহীন রইলো নিঃসঙ্গ পড়ে মলিন শয্যায়-
অকস্মাৎ ভীড়াক্রান্ত ঘরে শোকের প্রবল স্রোত
বয়ে যায়; কেউ কেউ মোছেন আড়ালে চোখ আর
খবর-শিকারি সব গন্ধ শুঁকে বেড়ায় কেবলি
খবরের। মৃত কবি পত্রিকার মহার্ঘ খোরাক।
১৬.৬.২০০০