- বইয়ের নামঃ হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অতিথি
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই দেখি, একজন লোক
আমার চেয়ারে দিব্যি বেপরোয়া বসে আছে। চোখ দুটো তার
আমাকে পরখ করে নিচ্ছে যেন, ঠোঁটে মৃদু হাসি। আমি তাকে
প্রশ্ন করি, কে আপনি এই সাত সকালে আমার
ঘরে বসে আছেন এত্তেলা না দিয়েই? এরকম আচরণ
ভদ্রোচিত নয় মোটে। আগন্তুক বিন্দুমাত্র বিব্রত না হয়ে
চেয়ারে থাকেন বসে খানিক আয়েশে, টেবিলের
বুক থেকে সহজে কুড়িয়ে নেন জীবনানন্দের ‘মাল্যবান।‘
আমাকে নিশ্চুপ দেখে বইটির পাতা
ওল্টাতে ওল্টাতে সেই অনাহুত অতিথি বলেন, ‘কী ব্যাপার,
বোবা হয়ে গেলে না কি? মুখ থেকে কথাই গায়েব? শোনো তবে,
আমি কেউকেটা নই কেউটেও নই, আমি হই
ভবঘুরে একজন, লোকে বলে আমি এই সমাজের বাতিল আপদ,
আমি হই সামান্য মানুষ, আমি হই
লালনের আখড়ার গানে-পাওয়া নিরীহ বাউল,
আমি হই তোমার মনের মানুষ হে ধূলিরঙ নাগরিক।
৭.১১.২০০০
অবচেতনের জমি
গোছা গোছা ফুল কি ফুটেছে লোকটির মেঘময়
অবচেতনের জমি জুড়ে? সে জমিনে গোধূলি
কখন যে নেমে আসে, জটিলতা সৃষ্টি হয়, লোকটি বোঝে না
কিছুতেই, অন্ধকারে অনেকটা অন্ধের মতোই
আবছা বেড়ায় ডানে বামে। আশঙ্কার বাইসন
তেড়ে আসে ডান দিক থেকে, বোঝে না সে।
আকাশে জমলে কালো মেঘ, রাজপথে
কেউ দিনদুপুরে হঠাৎ খুন হলে কিংবা কোথাও হাঙ্গামা
বাঁধলে লোকটা নিজেকেই অপরাধী ভেবে বসে আর মনের অসুখ
তাকে কুরে কুরে খায়।
বিশেষত রাতগুলো খুব ভয়াবহ চেহারায়
সম্মুখে হাজির হয়। ঘরের দেয়াল চারদিক
থেকে তীক্ষ্ণ দাঁত-নখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসে সেই
লোকটাকে লক্ষ্য করে। ঘোর অনিদ্রার প্রহরের চাপে
দম বন্ধ হয়ে আসে তার, তখন সে মৃত্যুকেই
পরম সুহৃদ ভেবে নেয়। কখনও কখনও অবচেতনের
ছায়াচ্ছন্নতায় এক মোহন উদ্যান দেখা দেয়, তার দিকে
কারও মায়াময় হাত অপরূপ মুদ্রায় এগোয়।
রোদের কামড় লোকটাকে যন্ত্রণাকাতর করে বড়, লহমায়
জ্যোৎস্নার মলমে ঠিক নিভে যায় জ্বালা। যখন সে
ঘাসে শুয়ে নক্ষত্রের উদ্দীপিত সভা দ্যাখে,
অনেক পুরনো কথা বুদ্বুদের মতো জেগে উঠে
মিশে যায় স্মৃতিমগ্ন ধূসর গুদামে। ধুলো ওড়ে
কিছুক্ষণ, অনেক মুখের ভিড়ে একটি মুখের রূপরেখা
ক্রমাগত গাঢ় হতে হতে লোকটার
নিজেরই হৃদয় হয়ে যায়। পরমুহূর্তেই তার
বুকের ভেতর এক বেয়াড়া নেউল বড় বেশি দাপাদাপি
গুরু করে; লোকটা ভীষণ ভয় পেয়ে মুখ ঢাকে। মাঝে মাঝে
আঙুলের ফাঁক দিয়ে দ্যাখে, আশঙ্কায় কাঁপে-
হয়তো অনেক কিছু এক্ষুণি হাজির হবে, অকস্মাৎ চোখে
পড়ে তার-একটি করুণ লাশ ভাসে ফিকে চাঁদের আলোয়।
ভাবে, কার এই লাশ? এটা কি অভাগা
কোনও পুরুষের, যার নাম জানবে না কেউ আর? নাকি তার?
১৭.১২.২০০০
আকাশপ্রদীপ রূপে
নক্ষত্র, সবুজ ঘাস, টলটলে শিশির এবং গোধূলির
রঙে গড়া একজন বড় একা নিশ্চুপ যাচ্ছেন হেঁটে, চোখ
তাঁর ভাসমান মেঘে, কালো যমজ পাম্পসু জোড়া
ধুলোয় সফেদপ্রায়। হাঁটছেন, তিনি হাঁটছেন
ফুটপাতে, বলা যেতে পারে, হাজার বছর ধরে। নালন্দার
গভীর জ্ঞানের আভা বিচ্ছুরিত তাঁর মুখমণ্ডলে সর্বদা।
অক্লান্ত পথিক তিনি প্রান্তরে, উদ্যানে, কখনও বা
সরাইখানার ধার ঘেঁষে, প্রজাপতিময় কোনও সর্ষেক্ষেত
বামে রেখে হেঁটে যান; দিঘির কাজল
ঠাণ্ডা জল সুস্থির আঁজলা ভরে করেন সাগ্রহে পান আর
কখনও গাছের শান্ত ছায়ায় বসেন, নানা পাখি
কাছে আসে নিকট আত্মীয় ভেবে তাঁকে।
দূর অজন্তার গুহাচিত্রের যুগল নরনারী উদাসীন
সেই পথিকের পদতলে রাখে অগণিত ঘিয়ের প্রদীপ
অন্ধকারে, কলকাতার কলরোল মেশে
ধানসিঁড়ি নদীর কল্লোলে, ট্রামলাইন বিমুগ্ধ যাত্রী করে
আকাশে বিলীন হয়, ভাবমগ্ন যাত্রীর ধূসর পাণ্ডুলিপি
অধিক উজ্জ্বলতায় আকাশ প্রদীপ রূপে প্রতিভাত হয়।
১৮.১.২০০১
আমার পড়ার ঘর থেকে
আমার পড়ার ঘর থেকে কিয়দ্দূরে
দু’জন দাঁড়িয়ে আচেহ বহুদিন থেকে। একজন দীর্ঘকায়,
হৃষ্টপুষ্ট; অন্যজন স্বাস্থ্যে ঝলসিত,
অথচ ঈষৎ খাটো, শীর্ণকায়। উভয়ে সবুজ পাতা আর
ডালপালা নিয়ে মৃত্তিকায় এবং আকাশে চোখ
রেখে চেয়ে থাকে, পরস্পর আলিঙ্গনে,
চুম্বনে অত্যন্ত অভিলাষী। বস্তুত বিচ্ছিন্ন থাকে
সর্বদাই, কালেভদ্রে দু’জন কিঞ্চিৎ হয়ে ওঠে স্পর্শময়।
কখনও কখনও মনে হয় ওরা, সেই বৃক্ষযুগল, আমার
জানালা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে ইচ্ছুক খুবই,
যেন কিছু গূঢ় কথা অথবা কাহিনী
বলার তাগিদে সেই কবে থেকে আছে প্রতীক্ষায়
দিনরাত। কিছুকাল পর এক গোধূলিবেলায়,
যেদিন কলম নিয়ে বসেছি কবিতা
লেখার অপ্রতিরোধ্য তাড়নায়, দীর্ঘকায় গাছটি ওপার
থেকে ডেকে বলে গাঢ় সকরুণ স্বরে, ‘শোনো কবি,
আমরা বিপন্ন অতিশয়, আমাদের সর্বনাশ
ঘনিয়ে আসছে দ্রুত, আমাদের দেবে বলি বড়
বেশি লোভী কিছু লোক; রক্ষা করো তুমি আমাদের। আমি
অসহায় চেয়ে থাকি, কলম দুর্বল অতি কুঠারের কাছে।
২২.১২.২০০০
আমার ভেতরে অন্য কেউ
আচমকা মনে হলো, কারা যেন ঘরের ভেতর
এসেছে অত্যন্ত সন্তর্পণে। অথচ কাউকে আমি
কোথাও দেখতে পাচ্ছি, এমন তো নয়। তাহলে কি
কল্পনা আমাকে কিছু অদৃশ্য সত্তার
মুখোমুখি দাঁড় করাবার
কৌশল নিয়েছে অগোচরে? বসে থাকি
একলা নিশ্চুপ থমথমে ঘরে। সারা
শরীর আমার যেন অন্য কারও শরীরের ভেতরে প্রবেশ
করানো হয়েছে চাতুরীর ছায়াবৃত প্রক্রিয়ায়
নিজেকে বড়ই ফাঁকা ফাঁপা মনে হয়।
আমি কি ডাকবো চড়া গলায় কাউকে? কিন্তু হায়,
কারা ছলনায় কণ্ঠ রোধ করে রেখেছে আমার। হা কপাল,
শত চেষ্টা সত্ত্বেও এখন গলা থেকে
গোঙানি ব্যতীত, হাহাকার ছাড়া কিছু
বেরুবে না কোনওমতে। গলার ভেতরে
হাজার হাজার কাঁটা ছড়ানো রয়েছে, রক্ত ঝরে অবিরাম।
আমার বিরুদ্ধে এ কেমন
ষড়যন্ত্রের মেতেছে রহস্যময় কোন সে এলাকাবাসী? তুমি,
যে আমার পথপ্রদর্শক, সম্ভবত বন্দি আজ মায়াজালে।
আমি তো শুনতে পাচ্ছি ঘণ্টাধ্বনি, মনে হয়, শুভবাদীদের।
তবে কি পুরনো কঙ্কালের হুটোপুটি
হবে শেষ অচিরেই? পূর্ণিমার আলোর জোয়ারে
ভেসে যাবে কণ্ঠকিত অমাবস্যা, আর
শ্যাওলা-জড়ানো কিছু উড়ন্ত করোটি গুঁড়ো হয়ে
ঝরে যাবে ধূধূ তেপান্তরে। কিষাণীরা ভালো ফলনের গীতে
ছন্দিত ঝংকৃত আর রাখালের বাঁশি
দিগন্তের দিকে সুদিনের সুর হয়ে মঞ্জরিত।
এখন আমার ঘরে সহজ সুন্দর অধিষ্ঠিত,
নীরবে ছড়ান তিনি কিছু ফুল চৌদিকে এবং আমি খুব
শ্রদ্ধাভরে কুড়াই সে-ফুল আর আমার ভেতরে
অন্য কেউ জেগে উঠে পূর্ণিমা সৃজনে মগ্ন হয়।
১৬.৭.২০০০