মৃতাঞ্জলি
(আবুল হাসানের স্মৃতির উদ্দেশে)
মানুষ চ’লেই যায় শেষ অব্দি, তা’ ব’লে কি এ রকমভাবে
চ’লে যেতে হয়?
চলে গেলে, আমাদের বড়ো এলোমেলো ক’রে দূ’রে
মেঘের পালঙ্ক ভেসে ভেসে ভেসে তুমি চ’লে গেলে
আরো বেশি মেঘের ভেতরে।
মেঘে ছিলো রহস্যের হাওয়া, কী রকম স্বপ্নময় ভিন্ন বনস্থলী
কেমন নগর
ছিলো হয়তো বা।
তীরের বেবাক নৌকো ভীষণ পুড়িয়ে চলে গেলে।
কতিপয় শব্দের ভিতর বৃষ্টি আর হেমন্তের রূপ খোঁজা,
মুহূর্তের মধ্যে বহু শতাব্দীর বসন্তের শোভা,
জন্ম-জন্মান্তর দেখা খেলা ছিলো আমাদের। হঠাৎ খেলার
মাঝখানে ‘চললাম’ ব’লেই
তুমি অন্তর্হিত।
তোমাকে দিইনি বাধা, অভিভূত দেখেছি তোমার চ’লে যাওয়া-
বাধা দিলে তুমি শুনতে না।
জীবন যাপনে শিল্পে তুমি নিয়মের কাছ থেকে
স’রে গেছো বারবার, প্রস্থানেও নিয়ম মানোনি এতটুকু।
এই যাওয়া ঘরে ফেরা নয় আর, নয় নিসর্গের
অভ্যন্তর থেকে
ফিরে আসা নিরিবিলি। অনেক দশক মুছে যাবে
নিশীথের রেস্তোরাঁর আলোর মতন,
তবুও প্রত্যাবর্তন অতি গাঢ় কুয়াশায় ডুবে
থাকবে সর্বদা।
হঠাৎ এখন যদি দরজায় কড়া নাড়ো ঘন ঘন, যদি
দাঁড়াও একাকী
সন্ধ্যা-ঢাকা, খুব ফাঁকা উঠোনে, অথবা রঙচটা
কাঠের চেয়ারে
শরীর এলিয়ে দাও, অপ্রস্তুত হবো না মোটেই, ছমছমে
ভয়ে মুখ ঢাকবো না দু’হাতে আঁধারে;
বরং বাড়িয়ে দেবো হাত, সিগারেট, টলটলে
চায়ের পেয়ালা।
তখন ঘরের আর্ত আলোয় চকিতে
ভ্রান্তিহীনরূপে মনে হবে-
বসে আছি মৃত্যু নয়, ভিন্ন জীবনের মুখোমুখি; এ জীবন
গোলাপ গন্ধের মধ্যে,উদ্ভিদের রঙে,
ঝর্নার নুড়ির মধ্যে, পাতার ভেতর অন্তহীন ব’য়ে যায়।
তুমি এসে দেখে যাও রাত্তিরে বিষণ্ণ প্লাজা, ফাঁকা
ফুটপাত বুক পেতে রাখে দুঃখী কবির মন্থর
পদস্পর্শ পাবে ব’লে আর
কাতর এ শহরের চোখ ভাসে, অবিরল শোকার্ত ধারায়।
ব’সে থাকি চুপচাপ, কখনো মুখর হই চায়ের আসরে;
কখনো হঠাৎ ইচ্ছে হয়
তিন হাত মাটি খুঁড়ে, শত হাত মেঘ খুঁড়ে এক্ষুণি তোমার
মুখ দেখে আসি।
মৃত্যু
মৃত্যু যদি গন্ধ হ’য়ে ভাসে,
আমার তবে কী-ই বা যায় আসে?
মৃত্যু তুমি আলুফা নেশা নাকি
কিংবা কোনো গোপন রঙা পাখি?
আমাকে বুঝি ঠুকরে খেতে চাও-
এইতো আমি, তোমার ঠোঁটে নাও।
মৃত্যু তুমি রাঙাও কেন চোখ?
একটি নদী হবেই গাঢ় শোক।
মৃত্যু তুমি পাথরে, নীল জলে,
তৃণাঙ্কুরে বন্ধ্যা মেঘদলে
বেড়াও ব’য়ে কত যে গোপনতা-
মৃত্যু তুমি রাখো না কোনো কথা।
যে গেলো নগ্ন পায়ে
যে গেলো নগ্ন পায়ে এমনি গেলো,
কেমন নিঝুম শূন্য গেলো,
খুব একাকী উদাস গেলো।
শহরধুলো বনস্থলী, জুতো জোড়া,
কোমল মুঠি, নৈশ ভ্রমণ,
ছন্নছাড়া ঘরে ফেরা-
সবাই মাতে প্রত্যাহারে।
শব্দ শব্দ গেরস্থালি এলোবিলি
গুমরে ওঠে এলোমেলো।
প্রুফের তাড়া এলোমেলো।
যে গেলো সে নগ্ন পায়ে এমনি গেলো,
কেমন নিঝুম শূন্য গেলো,
খুব একাকী উদাস গেলো।
সত্তা কি তার ছিলো গোপন স্বপ্নমোড়া?
ছিলো কি সে রিক্ত শ্রমণ?
পৌঁছুলে সেই বিভূঁই ডেরায়
কেউ জেতে কি? কেউ কি হারে?
কেমন জেদী একরোখা সে; আগের মতো
তাকায় না আর পিছন ফিরে
ভালোবাসার গহন তীরে।
যেসব শব্দ সোহাগ ভরে ঘনিষ্ঠতায়
এসেছিলো তার নিকটে,
জ্যোৎস্নাধোয়া তীক্ষ্ম তটে,
এখন ওরা দেখছে আপন তীব্র ওড়া,
তেজী শাদা ঘোড়ার গমন,
এখন ওরা দুঃখঘেরা
মেঘের মতো ছায়ায় বাড়ে।
হেলায় ফেলে যৌবনেই দীপ্ত বছর-
নগ্ন পায়ে তবু গেলো,
খুব একাকী উদাস গেলো।
যে-কোনো দোকানে
সামগ্রী সৌন্দর্য; রাশি রাশি ওরা জগৎ সংসারে
জেগে আছে থরে থরে, কখনো বা খুব এলোমেলো,
চেতনার নানা স্তরে। এমনকি অবচেতনায়
সামগ্রীর গ্রীবা লীলায়িত; নৃত্যপর চোখ যৌথ
স্মৃতির আভায় জ্বলজ্বলে। অকস্মাৎ গুহাগুলি
জ্যোৎস্নার জোয়ারে ভেসে যায়। সুপ্রাচীন পান পাত্র,
চিত্রিত বাসন, কলসের কানা আর অলংকার
গভীর সংগীতময়। গুহাগাত্র ছায়া ধরে কত,
রাত্তিরে আগুন নিভে গেলে কেউ কেউ মাংস ছেড়ে
করে স্তব প্রত্যুষের। অনেকেই সামগ্রীর দিকে
পুনরায় ধাবমান জাগরণে নেশাগ্রস্ত প্রায়।
স্বপ্নেও সামগ্রী ঝরে, কতিপয় নান্দনিক ফোঁটা।
নানা সামগ্রীর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে বারবার
আমিও দোকানে যাই। এ রকম দেখাশোনা ভালো
লাগে ব’লে বহু ঘন্টা দোকানেই কাটে মাঝে মাঝে
এবং দোকানে গিয়ে দেখি খুব লোকজন আছে;
দোকান গুঞ্জনময়, দরাদরি চলে কমবেশি।
প্রতিটি শো-কেস যেন বর্নোচ্ছল ফুলের কেয়ারি।
দোকানে নানান দ্রব্য, প্রতিটি দ্রব্যক খুঁতখুঁতে
গ্রাহকের কাছে অতিশয় লোভনীয় করে তোলা
দোকানদারির তরকিব। আমি এক কোণে একা
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নিই এটা সেটা, কোনো কোনো
দ্রব্য হাতে তুলে, যেন নির্জন স্বপ্নাংশ নিচ্ছি তুলে,
খানিক পরখ করি; তারপর যথাস্থানে রাখি
অত্যন্ত নির্মোহভাবে। স্মিত মুখে ব্যস্ত, চটপটে
সেল্সম্যানের দিকে সলজ্জ তাকাই। পুনরায়
দৃষ্টি ঘোরে চারপাশে-প্রতিটি সামগ্রী থেকে কিছু
আভা বিচ্ছুরিত ক্ষণে ক্ষণে, দেখি তাদের অস্তিত্বে
অনেক সকালবেলা, দিগন্তের মেদুর ইশারা।
দ্রব্যের আড়ালে কিছু গোপনীয় মায়া সৃষ্টি হয়।
দোকানে অপেক্ষা করি। প্রতীক্ষা সুদীর্ঘ হ’লে বলি,
নিজেকেই বলি, তুমি এই কোণে জীবনানন্দের
হরিণ মুখস্থ করো, দ্যাখো এ দোকান নিমেষেই
আচ্ছাদিত আগাগোড়া ওডেসীর পাতায় পাতায়,
অথবা স্মরণ করো মার্বেল কুড়াতে গিয়ে দ্রুত
সে কখন খেয়েছিলো চুমো বাল্যসখিকে হঠাৎ।
কখন যে দোকানের অভ্যন্তরে আরেক দোকান
জেগে ওঠে সপ্তবর্ণ কলরব নিয়ে। সে দোকানে
কোনো দ্রব্য নেই, তবু কেমন প্রোজ্জ্বল প্রদর্শনী-
কিণ্ণরের কণ্ঠে শুনি সেলস্ম্যানের শব্দাবলী,
জলকন্যা কাউন্টারে মূল্য তালিকার চতুষ্পার্শ্বে
তোলে সমুদ্রের সুর। গ্রাহকেরা বন্দনা-মুখর।