ফুটপাত
সকালে দুপুরে কিংবা মধ্যরাতে এ ফুটপাতের কানে কানে
বলতে চেয়েছি কথা কিছুক্ষণ একা একা। ফুটপাতটির
সঙ্গে চেনা শোনা আছে বহুকাল, এই ফুটপাত দূরগামী
পথিকের মতো চলে গেছে ধীরে নদীর নিতান্ত নজদিক।
জ্যোছনাও জলধারা হ’য়ে ফুটপাতটিকে কিছু নিরিবিলি
কাহিনী শোনাতে চায়, আমি জ্যোছনায় মিশে যাই পক্ষীপ্রায়।
ফুটপাতটির সঙ্গে কথা বলি অনর্গল পারস্পর্যহীন-
দোলায় সে মাথা ঘন ঘন, কখনোবা ভ্রান্তিহীনরূপে
উদাসীন; ফুটপাত রূপকথা ভালোবাসে? তার পিঠ বারবার
কোমল বুলিয়ে দিই, যেন সে সৌন্দর্য ময়ূরের; কিন্তু এ কি
আমার নিজস্ব করতলে বহু মৃত শতাব্দীর বিষণ্নতা
জেগে ওঠে নিমেষেই ফুটপাত সোহাগ বোঝে না এতটুকু।
আমার অঢেল রক্তে চঞ্চু সে ডুবিয়ে নিতে চায় বারংবার!
বাস্তবিক লোকটাকে
বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি ন।
সাতরঙা পালকের টুপি তার মাথায়, দু’চোখ
ভীষণ অরুণবর্ণ; তার দিকে তাকালেই মনে হয়,
ভয়ংকর কিছু ব’য়ে বেড়ায় সত্তায় সারাক্ষণ।
আগুন আহার করে আর বিষলতার নির্যাস
করে পান। করো সঙ্গে কথা সে বলে না, এক ভিড়
মানুষের মধ্যে চুপ থাকবার তরিকা কেমন
আয়ত্তে রয়েছে তার। চুলের ডগায় সুর্যোদয়,
নখাগ্রে সুর্যাস্ত নিয়ে হেঁটে যায় একা ঔদাস্যের
ছায়ায় নিঃশব্দে হেঁটে যায় গোধূলিতে নেমে পড়ে
কোথায় গোপন নিচে, করে ওজু শোকের দিঘিতে।
মধ্যরাতে শহরের মধ্যপথে অভ্রের নদীতে
ভাসায় সুনীল নৌকো, রাশি রাশি বাঁশির স্থাপত্যে
বানায় সুদীর্ঘ সাঁকো সড়কে সড়কে সব দিকে।
বাতাসের, গোধূলির, নিঃসঙ্গ শহুরে কুকুরের,
পাখির ক্রীড়ার সায় আছে তার প্রতি। পাহাড়ের
কাছাকাছি থাকে, না কি হ্রদের কিনারে অতিশয়
নিরালা নিবাস তার? তাকে দেখে দৃষ্টি পুড়ে যায়।
হৃদয়ের বহুমুখী ক্ষত তার চোখ হ’য়ে জ্বলে
সর্বক্ষণ, বেড়ে যায়। ক্ষতের পাশেই স্মৃতিময়
উপত্যকা তৈরী করে লাগায় জাগর পাছপালা।
গভীর শিকড় নিমেষেই শুয়ে নেয় ক্ষতরস!
বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি না।
তবু সে প্রায়শ মধ্যরাতে আমার টেবিলে ব’সে
ছিটোয় বিস্তর কালি খাতার পাতায়, কখনো বা
ঘন ঘন করে পায়চারি কালো বারান্দায় কিংবা
খুপরিতে, মাথা নাড়ে, তাকায় আমার দিকে তীক্ষ্ম
ক্ষুধিত দৃষ্টিতে, বুঝি নেবে শুষে অস্তিত্ব আমার।
আমার শিয়রে রাখে তরবারি, আমি নিরুপায়,
রুদ্ধবাক প’ড়ে থাকি, যেন ক্লান্ত, শীর্ণ পথরেখা।
যত বলি চ’লে যাও স্বচ্ছাচারী, এখানে তোমার
প্রবেশাধিকার নেই, গেরস্থালি করো না বেবাক
তছনছ, ততবার আমাকে ভীষণ ফুঁড়ে একা
ঘরে ঢুকে প’ড়ে বসে আমার টেবিলে, খুব ভোরে
সহসা প্রস্থান করে মোরগ ডাকলে পরে। রৌদ্রে
ঘর নিরিবিলি হেসে উঠলে দেখি আমার টেবিলে
পড়ে থাকে পাতালের লতাগুল্ম, মৎস্যাকুমারীর
জলজ নিশ্বাস আর সুদূর নীলিমা এক রাশ,
প্রাচীন সোনালি তন্তু হাহাকার খানিক দিব্যতা।
যখন আমার মেধা রটে মুদ্রাক্ষরে দিগ্ধিদিক,
অথবা মাইক্রোফোনে আমার প্রতিভা আমি খুব
নিমগ্ন আবৃত্তি করি, মালা আসে, বাজে করতালি,
তখন সে ভাঙা কবরের ওপর নিঃসঙ্গ ব’সে
মড়ার খুলিতে দ্রুত তবলা বাজায়, চুমো খায়
মৃত্যুর ঘাগরা-পরা বারবণিতার ওষ্ঠময়।
বাস্তবিক লোকটাকে একেবারে পছন্দ করি না।
বিষদ আমায় প্রতি
বিষাদ আমার প্রতি প্রবল আকৃষ্ট ব’লে তাকে
আমার নিকট দেখা যায় ঘন ঘন, তার সাথে
বড়ো বেশি মেশামেশি হয়। বিষাদ আমার হাতে
মধ্যরাতে অশ্রুপাত করে অবিরত, মুখ ঢাকে
আমার বুকের অভ্যন্তরে; মাঝে-মাঝে খুনসুটি
করে, যেন বিষণ্নতা ব’লে কিছু নেই, নেই কিছু
চোখের পানির মতো ব্যথাময়। কখনো বা ঘুঁটি
চেলে ব’সে থাকে সতরঞ্জে, আমি খুব মাথা নীচু
ক’রে ভাবি, এ কেমন খেলার পদ্ধতি? প্রতিদ্বন্দ্বী
স্বেচ্ছায় হারার ছলে আমাকে হারিয়ে দেয় শুধু।
বিষাদ চৌদিকে গন্ডি এঁকে আমাকে করেছে বন্দী,
হরিণের চোখ হ’য়ে ঘোরায়, প্রান্তর রুক্ষ, ধুধু।
বিষাদ আমার জন্যে পারস্য গালিচা কিনে আনে,
কিনে আনে বাঘছাল, সোনার গেলাশ, হাতপাখা
এবং গোলাপ-পাশ। বিষাদ আমাকে কাছে টানে,
সস্নেহে আমার মুখে কেমন আপেল দেয় পুরে,
নাইয়ে বিজন হ্রদে পরায় জরির আঙরাখা।
অথচ নিজেকে দেখি নগ্ন, পোশাক গিয়েছে উড়ে
কখন কোথায় কোন্ ঝড়ে। মুখে জ্বলে ধূলিরেখা।
বিষাদ আমাকে পোষে দীর্ঘকাল ধ’রে, কতকাল
একান্ত বাহন হ’য়ে তার ঘুরেছি ভীষণ একা।
বিষাদ আমাকে ব’লে, ‘তোমাকে দিয়েছি তাল তাল
স্বপ্ন, তুমি আড়ালে নির্মাণ করো অজর প্রতিমা।
বিষাদ আমাকে রাখে প্রহরায়, যেমন ড্রাগন
তার খুব জ্বলজ্বলে গোপন সম্পদ। চতুঃসীমা
গ’লে যায়, বিষাদ নিঃশব্দে হয় শিল্পের চবন।
বিষাদ আমাকে পোষে নাকি আমি বিষাদকে পুষি-
বিষাদই বলুক আজ স্পষ্ট ভাষায় তার যা’ খুশি।
মধ্যরাতে ঘুম ভাঙলে
ইদানীং রাত কাবার না হ’তেই
আমার ঘুম ফুরিয়ে যায়। অর্থাৎ মধ্যরাতে
প্রায়শই আমার নিদ্রা তার জাল গুটিয়ে নেয়।
আর মধ্যরাতে হঠাৎ জেগে উঠলে
এক ধরনের আদিমতা আমাকে আচ্ছন্ন করে বারবার।
বিছানায় শুয়ে দেখি, চারপাশে বিশেষ্যগুলি
স্থিরচিত্র, যেন এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে
অপেক্ষমাণ যাত্রী।
বিশেষণ এখন আয়নায়, সৌন্দর্য তার গ্রীবা বেয়ে
নামছে নাভিমূলে। বিশেষণের রঙ-করা চোখের পাতা
আমার ওপর নেমে আসে
(মনে পড়ে, একদা কেউ ঝুঁকেছিলো বনঘেরা নদীর জলে)
নেমে আসে আআর শরীরের মঞ্চে।
ক্সিয়া ডালিম গাছে বসে পা দোলাচ্ছে,
তার হাত লাল নীল বল ছুঁড়েছে অবিরাম।
দুটো বল দু’হাতে পড়ছে উঠছে,
তৃতীয়টি শূন্যে।
পাশ ফিরে দেখি, বাক্যবন্ধ জমাট
পরিযায়ী পাখির পংক্তির মতো আকাশে বিস্তৃত।
সংযোগী অব্যয়ের সাঁকো ঘোলা পানির ওপর
এবং, কিন্তু যদি, আওড়ে চলেছে আর
হঠাৎ কি খেয়ালে সে আমাকে ঘুমের ঝরনার সঙ্গে
যুক্ত করার জন্যে বাড়িয়ে দিলো হাত।
অথচ কিছুতের ঘুম আসতে চায় না আর।